নেকলেস

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

সকাল থেকেই আমি ছটফট করছি। অস্বস্তি ভাবটা জোঁকের মতো চুষে চুষে খাচ্ছে আমাকে। অবশ্য আমার এই অবস্থার জন্য দায়ী আমি নিজেই। আমি আজ সকালে একটা নেকলেস চুরি করেছি। আমার বান্ধবী আদিবার নতুন বিয়ে হলো। বিয়েতে যেতে পারিনি। তাই বিয়ের অভিনন্দন জানাতে ভাবলাম দেখা করে আসি। খালি হাতেও যাইনি কিন্তু। সুন্দর একটা ফুলদানি কিনেছিলাম আদিবার জন্য। সে আবার খুব ফুল পছন্দ করে কি না! কিন্তু গিয়ে দেখি সে কী কাণ্ড! ফুল পাগলি ওই আদিবা কোথায়? গাভর্তি গয়না পরে টুকটুকে একটা বউ বসে ছিল বিছানার এক কোণে। আমায় দেখে সে কী হাসি। টেনে ধরে ডাইনিং টেবিলে নিয়ে বসাল। এত বড় ডাইনিং টেবিল, এত বাহারি খাবার আর মিষ্টিতে ভরপুর থাকতে পারে, তা ছিল আমার ধারণার বাইরে। টেবিলে আবার খাদ্যসামগ্রী ছাড়াও আরও অনেক দৃষ্টিনন্দন জিনিসে ভর্তি। এই যেমন মোমবাতি, ফুলদানি আরও কত কী!

আমি খেতে খেতে ফুলদানিগুলো দেখলাম। আদিবার জন্য কেনা ফুলদানিটা ছুড়ে ফেলে দিতে মন চাইল! আচ্ছা, আমি যে কত দোকান ঘুরে ফুলদানিটা কিনলাম, কই কোথাও তো আদিবার টেবিলে রাখা ফুলদানি চোখে পড়ল না! এগুলো মনে হয় বিদেশি। ফুলদানি যে এত সুন্দর হতে পারে তা আমি জানতামই না! কিন্তু ফুলদানির কি এত সুন্দর হওয়া উচিত? তাতে রাখা হবে ফুল। ফুলের চেয়ে ফুলদানি দৃষ্টিনন্দন হবে কেন?

আমি যখন এই সব অপ্রয়োজনীয় কথা ভাবছিলাম, আদিবা একটা ধাক্কা দিয়ে আমার চিন্তার ব্যাঘাত ঘটিয়ে দিল। বাচ্চাদের মতো লাফালাফি শুরু করল বিয়েতে পাওয়া গয়না আমাকে দেখাবে বলে। আমি দেখতে লাগলাম। আরে বাবা! কত গয়না হতে পারে মানুষের? আদিবা একটা একটা করে বের করছে আর বিছানায় রাখছে। নেকলেস, ঝুমকো, চুড়ি, আংটি আরও কত কিছু, আমি তো নামটাও জানি না। আমি গয়না দেখছিলাম কম আর আদিবাকে দেখছিলাম বেশি।

হঠাৎ কী মনে করে যেন একটা নেকলেস ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেললাম! আমি কিন্তু চোর নই। আদিবাকে দেখে হিংসাও জাগেনি মনে। আবার এমনও নয় যে আমার নুন আনতে পান্তা ফুরায়! আদিবার মতো টাকার বিছানায় ঘুমাই না, কিন্তু ছোটখাটো একটা চাকরি করে দিন চলে যায় আমার। তাহলে নেকলেসটা চুরি করলাম কেন? ওহ হো! আসলে তা আমি নিজেই জানি না। হয়তো আমারও আদিবার মতো গয়না পরে সেজেগুঁজে বসে থাকার বাসনা জেগেছিল! কে জানে?

আদিবার গয়নার পসরায় আমি ভুলেই গিয়েছিলাম চুরির কথা। এখন বাসায় এসে ছটফট শুরু হয়ে গেছে। কেন চুরি করলাম? কী করে পারলাম? কী হবে এটা দিয়ে? আদিবা যখন বুঝতে পারবে তখন কী হবে? শুনেছি ধনীদের বাড়িতে সিসি ক্যামেরা লাগানো থাকে। যদি আমার চুরির ঘটনা কেউ দেখে ফেলে?

এতসব ভাবতে ভাবতে নেকলেসটা বের করে গলায় পরলাম। বাহ! আমাকে তো ভালোই মানায়। রেখে দেব নাকি? কী যে বোকা আমি! রেখে দিলে তো সবাই জিজ্ঞেস করবে কোথায় পেলাম এই নেকলেস? ধরা পড়ে যাব। বিক্রি করে দিতে হবে। কত টাকা পাওয়া যাবে? নিশ্চয়ই অনেক। এটা হিরা নাকি সোনা? কিংবা হিরা, সোনা, চুনি, পান্না সবকিছুর সন্নিবেশও হতে পারে। কত সুন্দর এই সব জিনিস। চুরি করে আনলাম বলে অন্তত গলায় পরে নিজেকে দেখতে তো পারলাম! কেমন দেখায় আমাকে। ফোনটা হাতে নিলাম একটা ছবি তোলার জন্য। হঠাৎ মনে হলো আদিবা তো ফোন করল না! সে কী বুঝতে পারেনি একটা নেকলেস গায়েব? ঠিক সেই সময় কলিং বেল বাজল। আমি তড়িঘড়ি করে নেকলেসটা একটা ড্রয়ারে রেখে দৌড়ে গেলাম দরজা খুলতে।

লেখিকা
লেখিকা

সে কী! আদিবা দাঁড়িয়ে। সেই বউ বউ আবেশটা নেই। কেমন হন্তদন্ত চেহারা। আমায় দেখেই জড়িয়ে ধরল খুব দ্রুত। হাউমাউ করে কেঁদে চলছে। বহু কষ্টে বাসার ভেতরে এনে বসালাম। ওর অবস্থা দেখে নেকলেসের কথা ভুলেই গেলাম। বললাম, এত রাতে এখানে?

আদিবা যা বলল তার জন্য আমি কখনোই প্রস্তুত ছিলাম না। আমি ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসার পর ও আর ওর শাশুড়ি মিলে গয়না গোছাচ্ছিল। হঠাৎ খেয়াল করল একটা নেকলেস গায়েব। শাশুড়ি আদিবাকে জিজ্ঞেস করল। কিন্তু সে বেচারী তো কিছুই জানে না। ওর শাশুড়ি কিছুতেই বিশ্বাস করলেন না। তিনি ভাবলেন আদিবা ওই নেকলেস চুরি করে বিক্রি করে দিয়েছে। রেগেমেগে তিনি আদিবাকে বাসা থেকে বের করে দিলেন। বলে দিলেন গয়না ছাড়া বাসায় ঢোকা নিষিদ্ধ। এই রাতে মেয়েটি কোনো কূল কিনারা খুঁজে না পেয়ে আমার কাছে এল একটুখানি আশ্রয়ের আশায়।

আমি এক মিনিট দেরি না করে নেকলেসটা এনে ওর হাতে দিলাম। বললাম ভুলে হয়তো আমার ব্যাগের সঙ্গে আটকে গিয়েছিল, আমি নিজেই দিয়ে আসতাম! ও এসে ভালোই করেছে, ওর জিনিস ওই নিয়ে যাক। আদিবা ভয়ে আর শোকে এমন পাথর হয়ে ছিল যে নেকলেস হাতে নিয়েই দৌড় দিল। কিছুই জানতে চাইল না। আমিও বেঁচে গেলাম লজ্জার কাহিনি লুকাতে পেরে!

কিন্তু এই চুরি আজ আমায় বড় একটা শিক্ষা দিল। সকালে আদিবার ডাইনিংয়ের ওই দামি দামি ফুলদানির মূল্য আমি এখন বুঝলাম। এ সমাজে প্রাকৃতিক ফুলের চাইতে সিরামিকের ওই ফুলদানি বেশি মূল্যবান। ফুল ফেলে দিতে দ্বিধাবোধ করে না কেউ কিন্তু ফুলদানির কোনো ক্ষতি যেন না হয় লক্ষ্য সে দিকেই। হঠাৎ আমার আদিবাকে মনে হলো ফুল আর ওর গয়নাগুলো একেকটা মহা মূল্যবান ফুলদানি। সুখে থাকুক আদিবা নামের ফুলটি। সারা দিনের ছটফট ভাবটা কেটে গেল একদম।

কাজী সাবরিনা তাবাসসুম: মিলান, ইতালি।