মৃণাল সেন: সিনেমার মহান কারিগর

মৃণাল সেন। ছবি: সংগৃহীত
মৃণাল সেন। ছবি: সংগৃহীত

একটা পরিপূর্ণ জীবন তিনি অতিবাহিত করে চলে গেলেন। তিনি মৃণাল সেন। সিনেমার অবিসংবাদিত কারিগর। বয়স হয়েছিল পঁচানব্বই। প্রায় শত বছরের জীবন। কত দীর্ঘ পরিভ্রমণ শেষে কত যুগ যুগান্তের অভিজ্ঞতাময় একজন মানুষ ইতিহাস হলেন। ফরিদপুর থেকে কলকাতায় গিয়েছিলেন উনিশ শ চল্লিশের দিকে। তারপর প্রেমে পড়লেন কলকাতার। নিজেকে কখনো রিফিউজি ভাবতেন না। শহর কলকাতা তাঁকে নিবিড় করে নিয়েছিল। তিনিও কলকাতাকে ভালোবাসলেন। মানুষকে জানতে ও বুঝতে সেই নতুন শহরে মার্কসবাদী রাজনীতি, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে জড়ালেন নিজেকে। বহুজনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হলো। সলিল চৌধুরী, সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, তাপস সেন, উৎপল দত্ত ও বংশী চন্দ্রগুপ্ত তাঁর বন্ধু হলেন। আড্ডার ও শিল্পের সহযোগী হলেন।

নস্টালজিয়া কখনো তাঁকে তাড়িত করেনি। সেই যে, বাংলাদেশের ফরিদপুর ছেড়ে কলকাতায় গিয়েছিলেন, তারপর প্রায় পঞ্চাশ বছর পর ফরিদপুর গিয়েছিলেন সস্ত্রীক। সবকিছুই প্রায় ভুলে গিয়েছিলেন ফরিদপুরের। কিন্তু যখন ফরিদপুরের পথে গোয়ালন্দ রুটে অগ্রসর হচ্ছিলেন এক এক করে স্মৃতির জানালার দুয়ার সব খুলে যাচ্ছিল। পথে যেতে যেতে দুই পাশের জল, জনপদ আর মানুষ সব যেন চেনা অতীত হয়ে বুকের মধ্যে আছড়ে পড়ছিল। পাঁচ বছর বয়সী সেই যে, ছোট বোনটি পানিতে ডুবে মারা গিয়েছিল। প্রায় পঞ্চাশ বছর পর তার সমাধিচিহ্নের কাছে এসে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না। পুরোপুরি ভেঙে পড়লেন। ছেলে কুনাল সেনের কাছে বলে চলেন সেই স্মৃতিকথা।

সিনেমা তিনি করবেন এ রকম ভাবেননি। বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন আর অঙ্ক এসব নিয়েই কাটিয়ে দিতে পারতেন জীবনের বাকি দিনগুলো। সেই তিনিই সিনেমায় মহিরুহ হলেন। ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরিতে সিনেমা বিষয়ে বইপত্র পড়তে পড়তে ঢুকে পড়লেন সিনেমায়। যেমন ভ্লাদিমির নিলসেনের দ্য সিনেমা এজ আ গ্রাফিক আর্ট বইটি তাঁকে যেমন সিনেমার টেকনিক্যাল দিকগুলো জানতে সাহায্য করেছিল, তেমনি ছোটবেলায় দেখা চার্লি চ্যাপলিনের দ্য কিড সিনেমাটি তাঁকে সিনেমার প্রতি প্রবল আগ্রহী করে তুলেছিল। যে মহান শিল্পী চার্লি চ্যাপলিনের সিনেমা তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিল ছোটবেলায় জীবনের পরিক্রমায়, সেই মহান চ্যাপলিনের সঙ্গেই ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে মৃণাল সেন উৎসব মঞ্চ শেয়ার করেছিলেন। মৃণালের নিজের ভাষায়, ‘সবাই যখন চ্যাপলিনকে দাঁড়িয়ে করতালিতে শ্রদ্ধা জানাচ্ছিল, আমারও সৌভাগ্য হয়েছিল সেখানে থাকবার। আমি চাইছিলাম এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বলি আপনার সিনেমা আমি ভালোবাসি। আপনার সিনেমা দেখে দেখে আমি সমৃদ্ধ করছি নিজেকে।’

মৃণাল সেন। ছবি: সংগৃহীত
মৃণাল সেন। ছবি: সংগৃহীত

কাকদ্বীপে গিয়ে ভেবেছিলেন শুটিং করবেন প্রথম সিনেমার। যে জন্য লিখেছিলেন প্রথমবারের মতো চিত্রনাট্য। সলিল চৌধুরী করবেন সংগীত। ঋত্বিক ঘটক করবেন পরিচালনা। হৃষীকেশ মুখার্জি ও তাপস সেনও ছিলেন দলে। কিন্তু কাকদ্বীপে আর যাওয়া হলো না। সকল পরিকল্পনা ভেস্তে গিয়েছিল পুলিশের নজরদারিতে। পুলিশের তল্লাশি হবে জানতে পেরে চিত্রনাট্য ছিঁড়ে হাওয়ায় মিলিয়ে দেওয়ার পর উপলব্ধি করেছিলেন, ওই সিনেমা না হয়ে বরং ভালো হয়েছে। নিজের লেখা প্রথম চিত্রনাট্য কেমন যেন মনে ধরছিল না।

বলছিলেন জীবনের গল্প। নিজের কথা। রিলিজিয়নের সংস্কার কখনো স্পর্শ করেনি তাঁকে। পুজো পার্বণ, পাপ পুণ্যের হিসাব করে জীবনকে নিরানন্দ করেননি। দেশভাগের প্রভাবেও প্রভাবিত হয়ে মলিন থাকেননি। বরং মানুষের দিকে তাকিয়ে দেখেছেন। কোথায় কেমন করে পৃথিবীর মানুষ ক্ষুধা, দারিদ্র্যয় ধুঁকছে অমানবিকতার কাছে, অপরিসীম বঞ্চনার মধ্যে দিনাতিপাত করছে। এ রকম বৈশ্বিক প্রেক্ষিত থেকে মানুষের জীবনের সংকটকে অনুভব করতে করতে অগ্রসর হলেন এক বিন্দুর দিকে। সেই বিন্দুটির নাম সিনেমা। সৃষ্টির শুরুতেই নিজের কাজকে বিচার করে সিদ্ধান্ত নিলেন সিনেমা তৈরি করা তাঁর কাজ নয়। তারপর আবার করলেন আবার মুখ ফেরালেন। এই যে ঘটনাবহুল অধ্যায় সেটিই মৃণাল সেনের সিনেমার পথ পরিক্রমার সফল সূচনা। রাতভোর থেকে আমার ভুবন পর্যন্ত পাড়ি দিয়েছেন মাইলের পর মাইল পথ। সে পথে কুড়িয়ে নিয়েছেন কত কত নতুন নতুন মুখ। পাদপ্রদীপের শিখায় ঝলমল করা সেসব মুখ আজ আর কারও অচেনা নয়।

মৃণাল সেন। ছবি: সংগৃহীত
মৃণাল সেন। ছবি: সংগৃহীত

যেমন ভুবন সোম সিনেমায় ভয়েস ওভার আর্টিস্ট সেই ছেলেটির কথা। খুঁজে বের করেছিলেন সেই নতুনকে যে আজ অমিতাভ বচ্চন। ভুবন সোমের ভয়েস রেকর্ডিং করে মৃণাল সেন তাঁকে যখন তিন শ টাকা দিয়েছিলেন, আনন্দে উদ্ভাসিত অমিতাভ বলেছিলেন, ‘দাদা, এ আমার সিনেমা থেকে প্রথম উপার্জন’। মৃগয়া সিনেমায় সাঁওতাল যুবকের জন্য কে কে মহাজনকে লিখেছিলেন একটি যুবকের বিবরণ দিয়ে একটি চিঠি। বিবরণে জানা যায়, পুনায় এক ছাত্র রয়েছে যার দৈহিক গড়ন অনেকটা সেই সাঁওতাল যুবকের মতো। সেই ছাত্রের নামের প্রথম অক্ষর ম। কে কে মহাজন অনুমান করলেন। খুঁজে পেলেন সেই তাকে। মৃগয়া সিনেমায় সেই ছেলেটি অভিনয় করলেন। জীবনের প্রথম সিনেমা করলেন বিখ্যাত পরিচালক মৃণাল সেনের সঙ্গে। তার ওপর সে বছরেই ভূষিত হলেন ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ডে। মিঠুন চক্রবর্তী বলছিলেন তাঁর ক্যারিয়ার শুরুর সেই কথা। বলছিলেন মৃণাল দার মধ্যে তিনি নিজের অস্তিত্বকে খুঁজে পান। তেমন করে অভিনয়ের জন্য নিয়েছিলেন প্রায় অচেনা রঞ্জিত মল্লিক, অঞ্জন দত্ত কিংবা সুহাসিনী মুলে, নন্দিতা দাস, কৌশিক সেন এঁদেরকে। আজকে তাদের সকলেই বিখ্যাত সেলিব্রেটি। এর পাশাপাশি ভারতীয় সিনেমা জগতের বিখ্যাত অভিনেতা অভিনেত্রীদের অনেকেই যেমন নাসিরউদ্দিন শাহ, ওম পুরী. শাবানা আজমি, পঙ্কজ কাপুর, আন্নু কাপুর. সিমি গাড়োয়াল, ডিম্পল কাপাডিয়া, মমতা শংকর, মাধবী মুখোপাধ্যায়, অপর্ণা সেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, উৎপল দত্ত, ধৃতিমান চ্যাটার্জি এঁদের নিয়েও কাজ করেছেন। কাজ করেছেন ভারতীয় গণনাট্য সংস্থার থিয়েটার শিল্পীদের নিয়েও। যাঁদের মধ্যে রয়েছেন অরুণ মুখোপাধ্যায়, বিভাস চক্রবর্তী, বিজন ভট্টাচার্য ও জ্ঞানেশ মুখার্জির মতো অভিনয় শিল্পীরা।

মৃণাল সেন সিনেমার। সিনেমা মৃণাল সেনের। মৃণাল সেনের বহু সিনেমার অভিনয়শিল্পী স্ত্রী গীতা সেন। গীতা সেন ছায়ার মতো আগলে রেখেছিলেন তাঁকে আজীবন। গীতা সেনের নিজের কথায়, ‘ছবির মধ্যে যখন ডুবে থাকেন সে সময় মৃণাল সেন অসম্ভব স্বার্থপর ও সংসারের প্রতি ভীষণ উদাসীন এবং সেটা আমি মেনে নেই কারণ আমি বুঝি তাঁর সেই ভেতরের মানুষটিকে যেখানে তিনি ধ্যানী একজন শিল্পী’। সিনেমার নন্দনতত্ত্বকে জেনে বুঝে তারপর সিনেমা করতে শুরু করেছিলেন মৃণাল সেন। সে সময়টায় তাঁর সিনেমা বিষয়ে শিক্ষার পদ্ধতিটিই ছিল সিনেমা দেখা ও বই পড়া। সিনেমার বই, সাহিত্যের বই, দর্শনের বই, হাতের কাছে যখন যা পেতেন সেসব বই। এভাবে পড়তে পড়তে সিনেমা। দেখতে দেখতে সিনেমা। বানাতে বানাতে সিনেমা। নিজের কাজকে দেখে দেখে ভুল বের করে সংশোধন করতেন নিজেকে। যাতে পরের সিনেমা আরও নিখুঁত হয়। তিনি নিজেই জানালেন সে কথা এভাবে, ‘আমি যদি আমার সিনেমাগুলো আবার বানাতে পারতাম তবে হয়তো আরও নিখুঁত করে বানাতে পারতাম।’ এমনি পরিশীলিত সিনেমামনস্ক ছিলেন বলেই সৃষ্টি করেছেন তাঁর কালজয়ী সিনেমা ভুবন। ভুবন সোম, বাইশে শ্রাবণ, একদিন প্রতিদিন, আকালের সন্ধানে, খারিজ, কলকাতা ’৭১, ইন্টারভিউ, পদাতিক, তেলেগু ভাষায় ওকা উরি কথা, হিন্দি ভাষায় খণ্ডহর, একদিন আচানক, কিংবা জেনেসিস যেন একেকটি মাস্টারপিস।

সময়ের পরিক্রমায় মৃণাল সেনের সিনেমা আন্তর্জাতিক হয়ে উঠেছে। তিনি একজন মানবতাবাদী চলচ্চিত্রকার ও প্রথার বিপরীতে নতুন ধারার সিনেমার নির্মাতা। বৈশ্বিক সিনেমার পরিমণ্ডলে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন কারিগর। নান্দনিক শিল্প ও শিল্পী হয়েই চিরকাল বেঁচে থাকবেন মৃণাল সেন। বেঁচে থাকবে তাঁর সিনেমা।

(২ জানুয়ারি, ২০১৮)