কাল্পনিক ঈশপ, তিন্নি আর বাগানের গল্প

কাঁটাযুক্ত সেই গোলাপের একাংশ
কাঁটাযুক্ত সেই গোলাপের একাংশ

ফুলে ফুলে ভরা বাগান দেখলে প্রথমে হৃদয় উদ্বেলিত হয়। দুই সপ্তাহ পর সেই একই হৃদয় হয় কম্পিত। কারণ আর কিছুই না, কাজের পরিমাণ! যত বেশি ফুল, অন্তত তার সোয়া গুণ বেশি কাজ। আমাদের বাসার সামনের বাগানটিকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগে রয়েছে সামনের দিকের ফুলে ভরা গাছ যেগুলো যথেষ্ট ভদ্র সমস্ত। কিন্তু ঠিক তার পেছনেই আমাজনের ঘোর জঙ্গল। জঙ্গলটি তৈরি করেছে মাত্র পাঁচটি গোলাপ গাছ—একেকটা গাছ আরেকটার চাইতে ঝুপসি মার্কা।

যেই গাছটি সকলের নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে, সেই গাছের গায়ে এত কাঁটা যে পিন ফোটানোর জায়গা নেই। আমি তো আমি, আমার ধারণা সেই গাছের পাতাগুলোও কাঁটার জ্বালায় অস্থির। সেদিন দুর্ভেদ্য জঙ্গল ভেদ করার উদ্দেশ্যে লম্বা কাঁচি বাগিয়ে প্রায় পনেরো মিনিট চেষ্টা চালিয়েছি। এতে অন্তত দশটা কাঁটা গ্লাভস ভেদ করে আমাকে নাস্তানাবুদ করার পর ক্ষমা দিতে বাধ্য হয়েছি। গাছের দল ফুট সোলজার হিসেবে রেখেছে কালো পিঁপড়াদের। আজীবন দেশেশুনে এসেছি কালো পিঁপড়া কামড়ায় না। দেশের পত্রিকা অস্ট্রেলিয়ায় আসে না বলে এখানকার পিঁপড়ার দল এই নিয়ম সম্পর্কে অজ্ঞ। সুযোগ পেলেই কামড় দেয়। দাপাদাপি করতে করতে বাগান থেকে বের হওয়ার মুখে স্পষ্ট টের পেলাম কাঁটাওয়ালা গোলাপ গাছটি খিক খিক করে হাসছে। ভাগ্য ভালো মানুষ গাছদের হাসি শুনতে পায় না। আসলেই হাসি শুনতে পেলে রাগ করে আবার গিয়ে নিশ্চয়ই আরও খোঁচা খেয়ে ফিরতে হতো।

গাছটিকে দেখে আমার ঈশপের কথা মনে পড়ল। ছোটবেলায় আমাদের সবার প্রিয় গল্পকার ছিল ঈশপ। ঈশপের বইবিহীন তৎকালীন সময়ে বাংলায় একটি ঘরও ছিল না বলেই মনে হয়। ঈশপ যদি এই গাছটিকে দেখতেন, তবে নিশ্চয়ই এ রকম কোনো একটি গল্প বানিয়ে ফেলতেন।

গোলাপগাছের গায়ে কেন এত কাঁটা?

সে অনেককাল আগের কথা। এক দেশে ছিল একটি গোলাপ বাগান। গোলাপ বাগানে হরেক রকমের গোলাপ গাছ। সবাই মিলে মিশে দিন কাটায়। মৌমাছির গুঞ্জন আর পিঁপড়ের কর্মব্যস্ততায় বাগান দিনের বেলায় থাকে মুখরিত। সাঁঝবেলায় সমস্ত কোলাহল ফুরালে যখন সব গাছ ঘুমায়, তখন কেবল মাত্র জেগে থাকে একটি গোলাপ গাছ। এই গাছটির মনে অনেক দুঃখ। কারণ তার গায়ে কোনো কাঁটা নেই। কাঁটাবিহীন গোলাপগাছের সংসারে সম্মান কম বলে বাকি গোলাপেরা তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। তার ওপর ছেলেমেয়ের দল ফুল ছিঁড়তে এলে প্রথমে তার ফুলগুলিই ছিঁড়ে নিয়ে যায়। দুপুরে একটু শান্তিমতো ঘুমানোর জো নেই। মৌমাছির দল তার থেকেই সবচেয়ে বেশি ফুলের রেণু নেয়। অলস প্রেমিকেরা লাল গোলাপ ছিঁড়তে গিয়ে কাঁটার খোঁচা খেয়ে শেষমেশ তার গাছ থেকেই সাদা ফুল ছিঁড়ে নিয়ে যায়। দুঃখে দুঃখে তার রাতে ঘুম আসে না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে।

দীর্ঘশ্বাস শুনে এগিয়ে আসে তার বন্ধু ঝিঁঝি পোকা। ‘কী হলো সাদা গোলাপ, তোমার মনে দুঃখটা কীসের?’ গোলাপের দুঃখের কথা শুনে ঝিঁঝির মনও আর্দ্র হয়। ‘শোনো বন্ধু, তোমাকে একটা পরামর্শ দিই। তোমার এই সমস্যা সমাধান করতে পারে কেবলমাত্র দেবরাজ জিউস। তুমি তার কাছে যাও।’

পরের দিন সকালবেলাতেই গোলাপ গাছ দেবরাজ জিউসের কাছে যাওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়ে। হাঁটতে হাঁটতে পথ আর ফুরোয় না। এক দিঘির পাশে বিশ্রাম নিতে বসে তার দেখা হয় এক ব্যাঙের সঙ্গে।

ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর। সাদা গোলাপ, তুমি কোথায় যাচ্ছ?

দেবরাজ জিউসের কাছে, আমার গায়ে কাঁটা বসাতে। আচ্ছা তুমি কি জানো তার বাসা আর কত দূর?

ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর। জানি তো, ওই মেঘের পরে তার বাসা। আর চার ক্রোশ হাঁটলেই পেয়ে যাবে। আচ্ছা তুমি যখন যাচ্ছই, তখন আমার একটা উপকার করতে পারবে?

হ্যাঁ বল।

দেবরাজ জিউসকে জিজ্ঞেস করো তো আমার গায়ে কেন এত বিশ্রী দাগ। এই দাগের জন্য জলের নিচের এক কাঁকড়া আমাকে বিয়ে করতে রাজি হচ্ছে না।

অবশ্যই জিজ্ঞেস করব আর উপায়ও নিয়ে আসব।

আর শোনো, গিয়ে জিউসের পরে মাথা ঠেকাতে যেন ভুলো না। উনি আমাদের সৃষ্টিকর্তা।

গোলাপ আবার যাত্রা শুরু করে এবং শেষ পর্যন্ত মেঘের পরে জিউসের প্রাসাদে গিয়ে পৌঁছায়। দেবরাজ জিউসের সভায় গিয়ে তার সামনে মাথা নিচু করে সম্মান দেখিয়ে গোলাপ তার দুঃখের কথা খুলে বলে। জিউস বললেন, ‘হুম, তাহলে তোমার গায়ে কাঁটা চাই, এই তো?’

জি ভগবান। এমন কাঁটা চাই যেন বাগানের বাকি গোলাপ লজ্জায় পড়ে যায়। এত বেশি কাঁটা চাই যেন কেউ আমাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য না করতে পারে।

বটে। তা তুমি নিশ্চিত তো? কারণ আমি এমন মন্ত্র ব্যবহার করব যেটা কিন্তু আর ফেরত নেওয়া যায় না। তুমি পরে এসে আবার বলবে কাঁটা চাই না, তা হবে না।

ভগবান, এই কাঁটাই আমার জীবনের সব চাওয়া। আমি আর কিছুই চাইব না।

তথাস্তু!

জিউস হাত নাড়াতেই সাদা গোলাপ গাছটির সর্বাঙ্গ কাঁটায় ভরে যায়। গোলাপ আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়।

আর কিছু?

জি ভগবান। দিঘির ব্যাঙ জানতে চায় কেন আপনি তার গায়ে এত বিশ্রী দাগ দিলেন যে তার কাঁকড়ার সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে না।

ব্যাঙকে বলো ওই দাগ না থাকলে সে সবুজ পাতা আর জলের মাঝে লুকিয়ে থাকতে পারবে না, সাপ এসে খেয়ে ফেলবে। তখন কাঁকড়া তো কাঁকড়া, কাউকেই বিয়ে করার মতো অবস্থায় থাকবে না।

গোলাপ গাছ খুশিমনে তার বাগানে ফিরে এল। আসবার পথে ব্যাঙকেও তার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে এল। বাগানে আসবার পর বাকি গোলাপরা তো তাকে দেখে হতভম্ব। এত কাঁটা যে সূচ ফুটানোর জায়গা নেই। সাদা গোলাপ গর্বে বুক ফুলিয়ে বাগানের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকল।

লেখিকা
লেখিকা

কিন্তু কিছুদিন পরেই সে হতাশায় পড়ল। কারণ তার কাছে কেউ আসতে চায় না। যে মৌমাছির গুঞ্জনে তার দুপুরে ঘুম আসত না, সেই মৌমাছির দল এখন অন্য গোলাপ থেকে রেণু নেয়। ছোট ছেলেমেয়েরা কাছেই আসে না। এমনকি অন্য গাছও তার পাশে থাকতে চায় না কাঁটার অত্যাচারে। তার ফুলগুলো ঝরে পড়ে গেলেও মালি এসে ছেঁটে দেয় না, কাঁটার খোঁচার ভয়ে। মৌমাছির পরাগায়ন বন্ধ হওয়ায় বংশবৃদ্ধিও কমে গেছে। দুঃখে দুঃখে সে আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার একসময়ের বন্ধু ঝিঁঝিকে ডাকাডাকি করে।

বন্ধু তুমি আর আস না কেন?

কী করব বল সাদা গোলাপ, তোমার গায়ে এত কাঁটা। কাছে আসলে যে আমার জীবন সংশয় হবে।

গোলাপ হতাশ হয়ে ভাবে, হায় আগেই ভালো ছিলাম!

মোরাল অব দ্য স্টোরি—ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না।

ঈশপের মতো করে লেখা গল্প আজকের দিনে আর চলে না। সুতরাং আমাকে যদি এই গোলাপের গল্প লিখতে দেওয়া হয় তবে আমি লিখব এইরকম—

গোলাপ গাছের গায়ে কেন এত কাঁটা?

এই গল্প আমাদের চারপাশেরই গল্প; এমন কোনো দূর দেশের কথা না। তিন্নি নামের একটি মানুষের বাগানে থাকত একটি সাদা গোলাপ গাছ। গাছটির মনে অনেক দুঃখ, কারণ তার গায়ে কোনো কাঁটা নেই। টাকা ছাড়া যেমন মানুষের তার সমাজে কোনো সম্মান নেই, কাঁটাবিহীন গোলাপের তেমনি নেই কোনো সম্মান সেই বাগানে। অন্য গোলাপগাছ যখন সগর্বে তাদের কাঁটার দৈর্ঘ্য মিলিমিটারে মাপামাপির চেষ্টা করে, তখন সাদা গোলাপ পাতা দিয়ে তার শরীর ঢেকে রাখে। তাতেও শেষ রক্ষা হয় না। তিন্নি বাগানে কাজ করতে এলে প্রথমেই তার গাছটিকে ছাটে কারণ সে নিরাপদ। মৌমাছিরা তার ফুলের সমস্ত রেণু নিয়ে যায়। তিন্নির বাসায় কোনো ছোট ছেলেপিলে বেড়াতে এলে সে তার ফুলগুলোই বাচ্চাদের উপহার দেয় এবং অন্যান্য গাছের কাঁটা থেকে ছেলেমেয়েদের সাবধান করে দেয়। এ ছাড়া, বাগানের সমস্ত গোলাপ গাছ তাকে ‘ন্যাংটা বাবা’ ডাকে যাতে সে যথেষ্ট অপমানিত বোধ করে। দুঃখে দুঃখে জেরবার সাদা গোলাপ শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে আর নিজের কপালকে দোষারোপ করে। দীর্ঘশ্বাস শুনে এগিয়ে এল তার পরানের বন্ধু ঝিঁঝি পোকা।

কীরে দোস্ত, তোর মন এত খারাপ কেন?

গোলাপ কাঁদো কাঁদো মুখে তার দুঃখের কথা খুলে বলে।

হুম, জটিল সমস্যা। ঝিঁঝি মাথা নাড়ে। কিন্তু দোস্ত, তোকে কাঁটা ছাড়াই দেখতে কিন্তু খুব ভালো লাগে। কাঁটা দিয়ে করবিটা কী? খালি সবাইকে খোঁচা দেওয়া ছাড়া আর এর কোনো কাজ নাই।

গোলাপের এতে মন ভালো হয় না। তাই ঝিঁঝি পরামর্শ দেয়, তাহলে তুই একবার দেবরাজ জিউসের কাছে যা। শুনেছি তিনি অসাধ্যসাধন করতে পারেন।

ঝিঁঝিঁকে ধন্যবাদ দিয়ে গোলাপ পরের দিন সকালেই দেবরাজ জিউসের খোঁজে বেরিয়ে পড়ে। তিন দিন তিন রাত হাঁটার পরেও জিউসের দেখা মেলে না। পরিশ্রান্ত গোলাপ এক দিঘির পাশে বসে বিশ্রাম নিতে। তাকে দেখে এগিয়ে আসে সেই এলাকার টাউট বলে খ্যাত ফিচলে ব্যাঙ।

কী হে গোলাপ ভাই। তোমাকে তো এই এলাকার বলে মনে হচ্ছে না।

নারে ভাই, আমি এসেছি ওই দূরের জায়গা থেকে। আমি দেবরাজ জিউসের খোঁজে বেরিয়েছি।

দেবরাজ জিউস? এ ব্যাটা আবার কে?

আরে উনি তো সৃষ্টিকর্তা। অসাধ্যসাধন করতে পারেন। ওওও আগে বলবে না? আরে আমার সঙ্গে তো জিউসের দহরম-মহরম। এই পরশুদিনও একসঙ্গে বসে চা খেলুম।

গোলাপ এবারে নড়েচড়ে বসে। বাপরে, এই ব্যাঙ তো দেবতা পর্যায়ের ব্যাঙ!

তা ব্যাঙ ভাই, আমায় বলবে তুমি কোথায় গেলে জিউসকে পাব?

ব্যাঙ তার পা দিয়ে নিজের কান চুলকাতে চুলকাতে নিচু স্বরে বলল, অবশ্যই, তবে কিছু খরচাপাতি আছে। এত বড় দেবতা কী আর যাকে তাকে দেখা দেয়?

গোলাপ মানিব্যাগ খুলে দেখে তাতে এক শ ডলারের মতো আছে। ব্যাঙকে মানিব্যাগ দেখিয়ে বলে, এতে হবে?

মাত্র? ব্যাঙ হতাশার ভঙ্গি করে খপ করে টাকাটা তুলে নেয়। কী আর করব, জিউসকে নিজের পকেট থেকেই কিছু দিতে হবে। হাজার হোক, তুমি অতিথি মানুষ।

ব্যাঙের প্রতি কৃতজ্ঞতায় গোলাপের মন ভরে যায়। ব্যাঙ তাকে নিয়ে চলে সবচেয়ে কাছের সিনেমাহলে যেখানে জিউসের ওপরে একটি ফ্যান্টাসি ফিল্ম দেখাচ্ছে। সবচেয়ে কম দামের টিকিট কিনে সে গোলাপকে সিনেমা হলে ঢুকিয়ে দিয়ে বলে, এই যে, জিউস এইখানেই আসবে। যত ইচ্ছে মনের কথা বলো।

ব্যাঙ শিস বাজাতে বাজাতে দিঘির দিকে রওনা হয়। গার্লফ্রেন্ড কাঁকড়াকে নিয়ে সন্ধ্যায় এক পার্টিতে যাওয়ার কথা। পার্টির খরচের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। আনন্দই আনন্দ, আহা।

ওদিকে গোলাপ কে জিউস, কে প্রমিথিউস আর কে অ্যাপোলো সব প্যাঁচ পাকিয়ে তব্দা খেয়ে হলে বসে রইল। সে কথা বলতে গেলেই আশপাশের মানুষ হুংকার দিয়ে ওঠে, চুপ করুন। ডায়ালগ শুনতে পাচ্ছি না। জিউস একজন দেবরাজ কিন্তু এদিকে মর্ত্যলোকে বিভিন্ন সৃষ্টির সঙ্গে তার ওঠাবসা। নিত্য স্ত্রীর দুঃখের কারণ হচ্ছে। এসব দেখে গোলাপ অস্থির হয়ে বাইরে বের হয়ে হলের গেটে বসে কপাল চাপড়াতে থাকে। তাকে দেখে পানি হাতে এগিয়ে এল হলের গেটকিপার ইঁদুর।

গোলাপের কাহিনি শুনে কিচকিচ করে বলল, সব তো তোমারই দোষ। ব্যাঙের পাল্লায় পড়েছ, ঝিঁঝির পাল্লায় পড়েছ। তোমার নিজের বিচার বুদ্ধি নাই?

গোলাপ দুঃখের স্বরে বলল, ব্যাঙ তো ফিচলে বুঝতে পারছি। কিন্তু ঝিঁঝিঁকে কিছু বল না। ওতো ঠিক পরামর্শই দিয়েছিল। সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কে এই সমস্যার সমাধান করবে?

ইঁদুর রাগত স্বরে বলে, এই তোমার মতো গাছপালা-প্রাণীদের জন্যই পৃথিবী এত পিছিয়ে আছে। আরে সৃষ্টিকর্তা বলে কিছু নেই। বুঝলে? সব বিগ ব্যাং–এর খেলা।

কোন ব্যাঙ?

আরে এই ব্যাঙ মানে প্রাণী ব্যাঙ না। মহাকাশ নক্ষত্র উল্কা—এসব সায়েন্সের ব্যাপার স্যাপার। পৃথিবীর প্রথম প্রাণ হচ্ছে অ্যামিবা। এই সব সৃষ্টিকর্তার কাজ না।

এ রকম অদ্ভুত কথা শুনে গোলাপের মাথা ঘুরতে থাকে। এই সব তো তার আগে জানা ছিল না! তবে কী সায়েন্স পারবে তার গায়ে কাঁটা বসাতে?

ইঁদুর ভুরু কুঁচকে বলে, না পারার কোনো কারণ দেখি না। সায়েন্স সব পারে। তবে তার জন্য তোমাকে আগে সায়েন্সের ওপর কোর্স করতে হবে। নতুবা কিছু বুঝবেই না।

কোর্সে এই সায়েন্স ভদ্রলোককে পাওয়া যাবে?

যাবে।

কিন্তু আমার সব টাকা শেষ।

ব্যাপার না। ক্রেডিট কার্ড আছে না?

নাই।

তাও ব্যাপার না। চলো আমি তোমাকে আজকে একটা ক্রেডিট কার্ড দিই, সঙ্গে কোর্সে ভর্তি করিয়ে দিই। আমি সামান্য ফি নেই। তেমন কিছুই না।

ক্রেডিট কার্ড থেকে বিশাল সুদে ক্যাশ অ্যাডভান্স নিয়ে কোর্সে ভর্তির টাকা ইঁদুরের হাতে তুলে দিল গোলাপ। ইঁদুর একগাদা কাগজপত্র ধরিয়ে দিয়ে বলল সে নাকি ইমেইলে সব পাবে।

বাসায় ফেরার পথে হঠাৎ গোলাপের মনে হলো যে ইমেইল ব্যাপারটা আসলে কী? তিন্নির বাসার ঠিকানা তো সে জানে, কিন্তু তার সঙ্গে তো কোনো ই শব্দ নেই। ব্যাপার জানতে সে কোর্সের প্রতিষ্ঠানের ঠিকানায় চলে গেল। গিয়ে তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। এই কোর্সে ভর্তি হতে হলে নাকি সায়েন্সের ওপরে ব্যাচেলর ডিগ্রি থাকতে হয়। গোলাপ বেচারা বাগানের স্কুল ছাড়া অন্য কোনো স্কুলেই পড়েনি। তার চেয়েও ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে এই ইঁদুর সাহেবকে ওখানে কেউ চেনে না এবং তারা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিল যে তাদের কোনো ফিল্ড এজেন্ট বা শাখা কিছুই নেই।

দুই দুইবার ঠগের পাল্লায় পড়ে গোলাপ কাঁদতে কাঁদতে বাসায় রওনা দিল। ক্রেডিট কার্ড নেওয়ার সময় ইঁদুর অনেক কাগজ দেখিয়েছে। গোলাপের মনে হতে থাকে নিশ্চয়ই ওগুলো জালিয়াতি কাগজ। কখন পুলিশ এসে তাকে ধরবে এই আতঙ্কে সে অস্থির হয়ে তার বাগানে ঢোকে। তাকে দেখে ঝিঁঝি এগিয়ে আসে। কিন্তু কান্না দেখে কিছু না বলে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিতে থাকে।

সাদা গোলাপের দাঁড়ানোর জায়গাটা একদম তিন্নির ড্রয়িংরুমের সঙ্গে। কাজ না থাকলেই তিন্নি টিভি দেখে। সাদা গোলাপ পর্দার ফাঁক দিয়ে মনের দুঃখ ভুলতে টিভি দেখা শুরু করল। হঠাৎ মিনিট পাঁচেক পর এক বিজ্ঞাপন দেখে তার চক্ষু চড়কগাছ। একদম ঘরের পাশে একটা বিউটি পারলারের বিজ্ঞাপন। সেই পারলার চোখের নিমেষে মানুষের ভোল পালটে দেয়। গোলাপ নিজের চোখে একটি সাধারণ মেয়েকে মডেলে রূপান্তরিত হতে দেখে সেই পারলারে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।

পারলারের বিউটিশিয়ানরা তার এই অভিনব অনুরোধ শুনে অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে পড়ল। কারণ আজকালকার যুগে নতুন কিছু করা মানেই হিপ। তারা বানিংস থেকে সুপারগ্লু জাতীয় কঠিন আঠা কিনে ঝরে পড়া গোলাপ কাঁটা জোগাড় করে গোলাপ গাছের গায়ে লাগিয়ে দিল। শুধু লাগিয়েই ক্ষান্ত হলো না, তার অন্তত গোটা বিশেক ছবি তুলল। এগুলো নাকি বিভিন্ন ফ্যাশন ম্যাগাজিনে পাঠানো হবে।

নতুন কাঁটাযুক্ত আবরণ পেয়ে সাদা গোলাপ গর্বিত ভাবে বাগানে দাঁড়িয়ে রইল। কিন্তু কিছুদিন পরেই সে কঠিন ডিপ্রেশনে পড়ে গেল। তিন্নি ভুলেও তার গাছ ছাটতে আসে না। তাই নতুন ফুল আগের মতো আসে না। মৌমাছি রেণু নেয় না, তাই পরাগায়ন হয় না। এমনকি জীবনহানির সংশয়ে তার বন্ধু ঝিঁঝিঁও কাছে আসে না। ডিপ্রেশনে পড়ে সে আবার পারলারে ফেরত গেল তার কাঁটাগুলো তুলে ফেলার জন্য। তখনই প্রথম টের পাওয়া গেল যে আঠা সুপার না, সুপার ডুপার গ্লু। কাঁটা ভাঙা যাবে, কিন্তু শরীর থেকে আর ওঠানো যাবে না।

গোলাপ হতাশ হয়ে ভাবে, হায় আগেই ভালো ছিলাম।

মোরাল অব দ্য স্টোরি: যাচাই না করে কারও দেওয়া তথ্য চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা বোকামি। আর রবি ঠাকুরের অমর বাণী—যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই। যাহা পাই তাহা চাই না।
...

সামারা তিন্নি: মেলবোর্ন, ভিক্টোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া।