শিং মাছের ঝোল আর মায়ের কোল

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী
অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

চেরাগের আলো আর বেশি জ্বলছে না। নিভু নিভু করছে। নানি কেরোসিন কবে ঢুকিয়েছে, মনে হয় ভুলে গেছে। আবার কেরোসিন দিতে হবে। চেরাগের সলতে ভালোমতো ভিজলে আলোও হবে ভালোমতো। নানির আজকাল কোনো কিছুই খেয়াল থাকে না। অথচ কয়েক বছর আগেও নানি চেরাগ নিভিয়ে দিয়ে, রোকেয়াকে কাছে নিয়ে আলাদিনের চেরাগের গল্প শোনাত। নানি এখন আর গল্প বলেন না। রোকেয়া বড় হয়েছে। স্কুলে পড়ে। নানির বানানো গল্প শোনার সময় কই। বইয়ের মধ্যেই তো কত গল্প আছে। চেরাগের বাতি আরেকটু কাছে টেনে নিয়ে রোকেয়া বই পড়ে। একের পর এক পাতা ওল্টায়। মামা কয়েক বছর হয় বাড়িতে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করে দিছে। কিন্তু পল্লিবিদ্যুৎ গরমকালে তেমন থাকে না বললেই চলে। খালি আসে আর যায়। রাতেরবেলা এক্কেবারে কম দেয়। গেলে কয়েক ঘণ্টাতেও আসে না।

নানি শুধু জলচৌকিতে বসে বসে তসবি পড়েন আর রোকেয়া গভীর মনোযোগ দিয়ে বইতে কী দেখছে, কী পড়ছে সেটা দেখেন। খানিক পরে রোকেয়া বইয়ের থেকে মুখ সরিয়ে বলে, নানি, ও নানি। আপনি কি সজাগ আছেন?

: হ, সজাগ আছি। কী কইবি কইতি পারচ।

: নানি, খালাম্মা কাইল আইব। সন্ধ্যার সময় আপনি ঘুমে আছিলেন। খালাম্মা আপনার মোবাইলে কল দিসে।

: ও আইচ্ছা। তোর মামা কি ফোন করছিল?

: না, মামা আইজকা ফোন করেনি।

নানির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। বলেন, আইজকা কয়দিন হইল পোলাডা ফোন করতাছে না। কী জানি কী হইছে। আমিতো আর করতেও পারি না। শুধু ফোন বাজলে ধরতে পারি। আনোয়ারে মোবাইল কিনা দিয়া ফোন বাজলে কেমনে ধরতে হয় শিখাইয়া দিছে। নানি দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।

: হ। আপনার বড়লোক পোলা কয়দিন ফোন করে নাই। তার লাইগা আপনার মন কানতাছে। আর কাইলকা যে আপনের মাইয়া আইব। হেইডাতো শুইনাও না শুনার মতোন আছেন। আর জিগাইলেনও না। আপনে খালি পোলা পোলা করেন। আর আপনের পোলা আপনারে গেরামে ফালাইয়া রাইখা, বউ লইয়া শহরে মেলা ভালা থাকে। শুধু কয়ডা টাকা দিয়া দেয়। আর মাঝে মইধ্যে ফোন করে। গেরামের মানুষে কয় সে নাকি বড় অফিসার।

: চুপ কর, চুপ কর। তোর কাম তুই কর। পড়ালেখা বাদ দিয়া এইসব ভেজাইল্যা কথা কস।

: উ, ভেজাইল্যা কথা। আপনার পোলার বউ ঈদের চান্দেওতো আপনারে দেখত আসে না। আর হেই বউর লাইগ্যা আপনি কত কী পাঠান।

: বউ আসে না, তোগো কারণে। তুই আর তোর খালা নাকি ওরে কী কইছস। তার লাইগ্যা আসে না। রাবেয়া নাকি কী কইছে।

: আমরা তারে কিছু কই নাই। আমরা আমগো আঞ্চলিক ভাষায় কথা কইয়া হাসতেছিলাম। সে ভাবছে তারে নিয়া হাসতেছি। মামার কাছে খালাম্মার বিরুদ্ধে কইয়া অহন আর আসে না। আইচ্ছা আমি আর খালাম্মা না হয় দোষ করছি। কিন্তু আপনে কী করছেন। আপনার দোষ কী? কইগো নানি কথা কও না কেন? রোকেয়া নানিকে নাড়া দেয়। নাহ, নানির কোনো সাড়া-শব্দ নেই। ঘুমিয়ে পড়েছেন।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে রোকেয়া হাত মুঠো করে ছাই নিয়ে পুকুরের দিকে যায়। ছাই দিয়ে ঘষে ঘষে দাঁত মাজন করে। মুখ ধুয়ে এসে চুলায় আগুন দেয়। চা বানিয়ে নানির সঙ্গে চা-মুড়ি দিয়ে নাশতা খায়। একটু ভাত-ডাল, শাক, ভাজি করে স্কুলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে থাকে।

: নানি আমি স্কুল থেইক্যা আইসা শিং মাছগুলা কাইট্যা দিমু। আপনে একটাও ধইরেন না। আপনের চোখ অহন আর আগের মতন নাই। পরে হাত কাইটবেন, মাছের কাঁটা লাগব। আর খালাম্মা যদি এর মইধ্যে আইসা পড়ে, সেও কাইট্যা শিং মাছের ঝোল রাইন্ধা দিতে পারব।

বলে রোকেয়া হেঁটে স্কুলে চলে যায়।

রাবেয়া বড় ব্যাগ নিয়ে একা একা বাড়িতে ঢোকে। ঘরে কাউকে না দেখে হাঁটতে হাঁটতে ঘরের পেছনে আসে। রাবেয়ার মা তখন হেলেঞ্চার শাক তুলছিলেন। একটা একটা করে শাক তুলে নিজের কাপড়ের কোঁচড়ের মধ্যে রাখছিলেন। রাবেয়া মায়ের পা ধরে সালাম করে।

: আম্মা আমি কতক্ষণ হইছে আইছি। আপনারে খুঁজতাছি। পরে এইখানে আইসা পাইলাম।

: তুই রাস্তা দিয়া আইতাছস, আমি এইখান থেইকা দেখছি। এত বড় ব্যাগ নিয়া আইসছ। তুই কি মেলা দিন থাকবি?

রাবেয়ার মুখ কালো হয়ে যায়। বলে, জানি না কয়দিন থাকুম।

: ক্যান, জানস না ক্যান? আর তুই একলা আইছস কেন? জামাই কই?

: সে ঢাকা। এই পরিবারে কেউ থাইকতে পারে মা কও। বড় আপা মইরা গিয়া বাঁইচা গেছে। দুলাভাই বিয়া করছে, তোমরা রোকেয়ারে নিয়া আইছ। আর আমি গিয়া উঠছি।

: তোরে উঠতে কইছিল কেডায়। তুই বইনের দেওরের লগে পিরিত শুরু করছস। তালতো ভাইরে বিয়া করবিই করবি। আমগো কী দোষ। অহন এইখানে থাকবি কয়দিন?

: যত্তদিন খুশি তত্তদিন।

লেখিকা
লেখিকা

বলে রাবেয়া রাগে জিদ করে সেখান থেকে রসুইঘরে চলে আসে। এসে দেখে তাজা শিং মাছ। ঢাকনা দিয়ে রাখা। রোকেয়া মনে হয় স্কুল থেকে এসে শিং মাছের ঝোল রাঁধবে ভেবে রেখেছে। রাবেয়া চুলার থেকে নারিকেলের মালা দিয়ে তৈরি লম্বা হাতল সমেত বিশেষ টগবা দিয়ে কিছু ছাই তুলে নেয়। পিছলা শিং মাছের সারা গায়ে ছাই মেখে কাটতে সুবিধা। পিঁড়িতে বসে বটি দিয়ে এক এক করে শিং মাছ কাটে। পুকুরে নিয়ে গিয়ে খলখলিয়ে ধুয়ে আনে। পুকুরপাড়ে মাকে একবার আড়চোখে দেখে কোনো কথা না বলে চলে আসে।

নারিকেলের শুকনা পাতা দিয়ে আগুন ধরিয়ে রান্না চড়িয়ে দেয়। এক এক করে লাকড়ি দিতে থাকে, তুষ মারতে থাকে। শিং মাছের ঝোল রান্না হয়ে যায়। ভাত রান্না আছে, শাক ভাজি আছে, ডাল আছে। ক্ষুধাও পেয়েছে। কিন্তু এখন খাবে না। রোকেয়া আসলে একসঙ্গে খাবে। রসুইঘরে ছোট্ট কাঠের মিটসেফের মধ্যে তরকারি রেখে দেয়। ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে, রাস্তার পাশে পুকুরপাড়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে রোকেয়ার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।

পুকুরের আরেকটু দূরে রাস্তার কাছে পাশের বাড়ির নুরুল হক গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকে। রাবেয়ার সেইদিকে খেয়াল নেই। কিছুক্ষণ পর স্কুল ড্রেস পরা রোকেয়াকে দেখা যায়। রোকেয়া আসতে থাকে। নুরুল হক অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। রোকেয়া সেইদিকে তাকায় না। হঠাৎ করে রাবেয়ার চোখে পড়ে। চট করে এসে রোকেয়ার হাত ধরে টান মেরে নুরুল হকের সামনে গিয়ে বলে, চাইয়া চাইয়া কী দেখতাছ? মাইয়া মানুষ দেখলেই চাইয়া থাকন লাগে? চোখ দুইটারে ঘুইট্যা এমনে ডিম ভাইঙা গুইল্যা দিমু। 


নুরুল হক অপ্রস্তুত হয়ে কিছু না বলে দৌড়ের ওপর হেঁটে চলে যায়।

রোকেয়া বলে, খালাম্মা আপনি এইডা ঠিক করেন নাই। সে চাইয়া ছিল। সে কী আমারে কিছু কইছে! অনেক পোলাইতো মাইয়া দেখলে চাইয়া থাকে, তাতে কী হইছে।

: চাইয়া থাকব ক্যান! আইজ চাইয়া থাকব। কাইল কথা কইব। পরে প্রেমের প্রস্তাব দিব। এগুলারে আমি চিনি। চল ঘরে চল।

রসুইঘরে চাটি বিছিয়ে দুজনে খেতে বসে। রোকেয়া নানিকে ডাক দেয়। ভাত-তরকারি যেই মিটসেফে রাখা আছে, তার পাশে পিঁড়ি নিয়ে নানি বসেন। রাবেয়া, রোকেয়া দুজনকে বেড়ে দেন। শাক দেন, ডাল দেন, কিন্তু শিং মাছ দেওয়ার সময় দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। আমার আনোয়ারের বড় শখ শিং মাছের ঝোলের। পোলাডা ছোটবেলা থেইকাই শিং মাছের পাগল। শিং মাছ হইলে আর কিছু লাগে না। থালা থালা ভাত অনায়াসে খাইয়া ফেলত। যেইদিন পুকুরে মাছ ধরা হইতো, সেই দিন আমার গলা চাইপা ধইরা কইত, আম্মা আইজকা সব শিং মাছ আমি খামু, আর কারোরে দিমু না। মা কাপড়ের আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছে নেন।

রোকেয়া বলে, শিং মাছ খাওনের শখ। আইলে খাইব। শিং মাছের ঝোল রাইন্ধা রাখুম। মামাতো শুনছি কয়েক দিনের মইধ্যে আইব।

: হ আইজ, কাইলের মইধ্যে আমারে মোবাইলে জানাইব কইছে। বউও আইবার পারে, বউয়ের মাও। তাই ভাবতাছি, আলগা ঝামিলা না থাইকলেই ভালা।

রাবেয়া ভাত খাওয়া বন্ধ করে দিয়ে বলে, আম্মা আপনে আমারে আলগা ঝামিলা কইতে পারলেন! আমি আপনার মাইয়া। আপনার পোলা আপনারে মাসে মাসে টাকা দেয়, মোবাইল কিনা দিচে, কারেন্ট আইনা দিচে। তাই আপনে আমারে পর মনে করলেন। রাবেয়া ভাতের থালা রেখে উঠে যায়।

রোকেয়া বলে, নানি আপনি ঠিক করেন নাই।

: আমি কী ঠিক করি নাই? আমি কোনো দিন রাবেয়ার থাকা নিয়া কিছু কইছি। শুধু আনোয়ারের বউ আইসবো দেইখা কইছি। আমার একটা মাত্র পোলার বউ, শহরের বড় ঘরের মাইয়া। কোনো অহংকার নাই। বাড়িত আইতে আমার লাইগা কত কী আনে। আমারে কত ইজ্জত করে, পোলা যেমন শিক্ষিত অফিসার হইছে, পোলার বউও হইছে। রাবেয়ারও তো এমনেই মেজাজ গরম। জামাইর বাড়িত কী হইছে, কিছুতো এখনো শুনলাম না। কিছু নিয়া হয়তো রাগ দেখাইয়া চইলা আসছে। আবার আনোয়ারের বউরে যদি উলটাপালটা কিছু কইয়া ফালায়! তাই ডরাই।

রোকেয়া বলে, হেইডা ছাড়াও আপনার পোলা আর পোলার বউর লাইগা আপনার টান বেশি। খালাম্মার লাইগা, আমাগোর লাইগা আপনার টান কম।

নানি গোস্যা করে বলেন, হ কম। তোরা নিজেরাই যহন এরুম কইতাছস। আমি আর কী কমু। আমার পোলা আমার সাত রাজার ধন, ‘সোনার আংটি ব্যাকা হইলেও ভালা।’

রাবেয়া মাটির ঢেলার থেকে দাঁড়িয়ে সব শুনছিল। রাবেয়া বলে, আমি কেন আইছি শুনবেন? আমার শাশুড়ি সবকিছুতে শুধু মাইয়াগো ভাগ খোঁজে। নারিকেল পাড়লে, মাছ ধরলে, ধান-চাল সবকিছু আগে মাইয়াগো বাড়িত দিব। তারপর আমগো লাইগা রাখব। এখন শুরু করছে, গত মাসে ঢাকা থেইকা আসতে আপনাগো জামাই আমার লাইগা এক জোড়া স্বর্ণের বালা আনছে। হেইডা দেইখা আমার শাশুড়ি বলে, ওনার ছোট মাইয়ারেও হেইডার মতো এক জোড়া বানাইয়া দিতে। আমার মাথা হইয়া গেছে গরম। আমার স্বামী আমারে দিছে। হেইডা ওনার মাইয়ারেও দিতে হইব ক্যান! আমিও মুখ ফুলাইয়া আইজকা চইলা আইছি।

নানি, নাতনি কিছুই বলে না। চুপ করে নিচের দিকে তাকিয়ে ভাত খাওয়া শেষ করে। রাবেয়া শোবার ঘরে গিয়ে মনের দুঃখে কাঁদতে থাকে। রাবেয়ার ভ্যানিটি ব্যাগে ফোন বাজতেই থাকে, বাজতেই থাকে। রাবেয়া উঠে ফোন ধরে, কথা বলতে থাকে দীর্ঘক্ষণ।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। দূর থেকে কিছু শেয়ালের হুক্কা হুয়া ডাক শোনা যাচ্ছে। ঝিঁঝি পোকা অনবরত ডেকে যাচ্ছে তার সঙ্গে ব্যাঙের ঘ্যানর ঘ্যনরতো আছেই। রাবেয়া মায়ের কাছে আসে। মা জলচৌকিতে বসে তসবি পড়তে থাকেন। রোকেয়া বসে বসে অঙ্ক কষছে।

রাবেয়া বলে, আপনাগো জামাই ঢাকা থেইকা আইতাছে। আসতে আসতে রাত হইব। কী রান্না করুম।

: দেশি মোরগ একটা জবাই কর। শোন রাতা মোরগগুলো ধরিস না। দুইটাই তো মোরগ। কত দিনের, কত সোহাগের মোরগ দুইটা আমার। আনোয়ারে ফোন করছে। সামনে ছুটির দিনে বউ লইয়া আইব। বউর মাও নাকি আইবার পারে। তহন দেশি মোরগ আরেকডা জবাই করুম। আর এক্কেবারে না হইলে রাতা মোরগে হাত দিমু। আর না হইলে থাকব। ছোটডা জবাই করলেও করতে পারি। কিন্তু বড়ডা আমার অনেক পুরান। হেইডা কারোরে দিমু না।

রাবেয়া আইচ্ছা আম্মা বলে রোকেয়াকে নিয়ে চলে যায়। মোরগ জবাই করে, রান্না করে। এদিকে রাত বাড়তে থাকে। রোকেয়া আর নানি ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে যায়।

রাবেয়া কাপড় বদলে মাড় দেওয়া নীল রঙের কাপড়খানা পরে। গায়ে পাউডার মাখে, মাথায় চুলে সুগন্ধি তেল লাগিয়ে খোঁপা করে। ছোট্ট আয়না খানা মুখের সামনে ধরে তিব্বত স্নো লাগায়। ঠোঁটে হালকা খয়েরি রঙের লিপস্টিক লাগিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। সময় যেন আজ যেতেই চায় না। রাত আরও বাড়ে। এক সময় কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ হয়। দরজার ওপর টকটক শব্দ হয় কয়েকবার। রাবেয়া দরজা খুলে দেয়।

পরদিন রাবেয়া চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়। স্বামী এসেছে নিয়ে যাওয়ার জন্য। রোকেয়া বাধা হয়ে দাঁড়ায়, নাহ আপনারা এক পাও যাইবেন না। কাইলকা মেহমান আইব, আপনারা তারপর যাইবেন। নানি ভদ্রতাবশত জামাইকে দুই একবার থাকার জন্য বলে। কিন্তু মেয়েকে সাধে না। অবশেষে জামাই রাবেয়াকে রেখে নিজে চলে যান, জরুরি কাজ থাকায়। পরের সপ্তাহে এসে রাবেয়াকে নিয়ে যাবেন।

পরদিন সকাল থেকেই রান্নাবান্নার আয়োজন শুরু হয়। বাড়ির পাশের কাজের মেয়ে কুলসুমকে ডেকে পাঠান নানি। ছেলে, ছেলের বউ আর ছেলের শাশুড়ি এসেছে। শহরের মানুষ গ্রামের রান্না পছন্দ করবে কিনা। থাক না করুক। ছেলে করলেই হবে। ছেলের জন্য আলাদা শিং মাছের ঝোল করতে হবে।

নানি লোক দিয়ে পুকুর থেকে মাছ ধরান। আলাদা করে শিং মাছের ঝোল ছেলের জন্য রান্না করান। রাতা মোরগ জবাই করার ইচ্ছে ছিল না। মানুষ বেশি দেখে রাতা মোরগ ছোটটা জবাই করান। তবুও বড়টাতে হাত দেন না। হাঁসের ডিমের ব্যবস্থা করেন।

ছেলে, ছেলের বউ আর বউয়ের মা বাড়িতে আসার সঙ্গে সঙ্গেই সবাই মিলে তাদের আপ্যায়ন করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। রাবেয়া রসুই ঘরেই রান্না নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায়। রোকেয়া ট্যাং–এর শরবত গুলে সবাইকে দেয়।

আনোয়ার এসেই মাকে সালাম দেয়। মা জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খায়। আনোয়ার বলে, আম্মা আমি আর আপনার বউই আসতাম। পরে দেখলাম আম্মু মেয়েকে একা দিতে একটু নারাজ। বুঝেনতো রাবেয়ার একটু মাথায় সমস্যা আছে। তাই উনি মেয়েকে একা দিলেন না। মা অবাক হয়ে বলেন, রাবেয়ার মাথায় সমস্যা আছে!

কিছু না বলে মা এক গ্লাস কাগজি লেবুর শরবত বানিয়ে নিয়ে আসেন। ছেলেকে বলেন, সবাইতো ট্যাংয়ের শরবত খায়। তুমিতো বাবা ওই কাগজি লেবুর শরবতই খাও। তোমার লাগানো গাছের। এখন এই গেলাস খাও।

: না আম্মা। সবাই ট্যাংয়ের শরবত খেলেও আপনাদের বউ জার্নি করে দেখলাম শরবত খেতে পারছে না। এটা দিলে হয়তো খেতে পারবে। দাঁড়ান আমি দিয়ে আসি। ছেলে শরবতের গ্লাস হাতে করে চলে যায়।

মা কিছুই বলেন না। চুপ করে শুধু ছেলের যাওয়া দেখেন।

রাবেয়া একটানা খাটুনি করে সবার জন্য ভাত-তরকারি বেড়ে দেয়। সবাই খেতে বসলে, মা আপ্যায়ন করতে আসেন। ছেলে সব সময় মোরগের রানের টুকরা খেতে পছন্দ করে। আবার যদি ছেলের বউকে দিয়ে দেয় তাই মা ভয়ে রানের দুই টুকরার মধ্যে এক টুকরা আগে বউয়ের পাতে তুলে দিয়ে আরেক টুকরা ছেলের পাতে দিতে যান। ছেলে মায়ের হাত ধরে চামচ সমেত টুকরাটা শাশুড়ির পাতে দিয়ে বলে, আম্মু একেবারে আমাদের ঘরের রাতা মোরগ। আপনার নিশ্চয়ই পছন্দ হবে।

বউ তখন আগ বাড়িয়ে বলে, আরে মোরগের চেয়েও শিং মাছটা সেইরকম হইছে। আমিতো সব খেয়েই ফেললাম। আম্মু খেয়েই দেখ না। এই নাও বাকিগুলো তোমার। শিং মাছের বাটিটা আনোয়ারের কাছে দিয়ে বলে, আম্মুকে দাও। আনোয়ার বাটির সবগুলো শিং মাছ শাশুড়িকে ঢেলে দেয়। মা স্তম্ভিত হয়ে যান। মার মুখ দিয়ে বেরিয়ে যেতে চায়, এই শিং মাছ শুধু আমার আনোয়ারের। তোরা কেউ খেতে পারবি না। তোদের কাউকে খেতে দেব না। কিন্তু মার গলা আড়ষ্ট হয়ে যায়। তিনি দাঁড়িয়ে আর এই দৃশ্য দেখতে পারেন না। দ্রুত হেঁটে গিয়ে নিজের জলচৌকিতে হেলান দিয়ে শুয়ে থাকেন।

এরপর অনেকটা সময় কেটে যায়,। মা আর কিছুই বলতে পারেন না। তখন প্রায় ঘুমেই। ছেলে বিদায় নেওয়ার জন্য মায়ের জলচৌকিতে আসে। বলে, আম্মাতো দেখছি ঘুমে। জাগানো ঠিক হবে কিনা। মা চোখ মেলে বলেন, বাবা তুমি আমারে কত দিন ঘুমের থেকে জাগাইছ। কত রাইত ঘুমাইতে দেও নাই, এখন জাগাও না কেন!

ছেলে বলে, আপনি ঘুমে কিনা তাই ভাবছিলাম। এখনতো দেখছি জেগে আছেন। এই কথা বলে আনোয়ার মায়ের চৌকির ওপর এপাশ থেকে ওপাশ লম্বা কাঠের তাকের দিকের তাকিয়ে লাফ দিয়ে উঠে বলে, আম্মা আপনার হাতে বানানো আমসত্ত্ব কত দিন খাই না। তাকের থেকে আমসত্ত্বের বৈয়াম নিয়ে কোনদিকে না তাকিয়ে গপাগপ করে খেতে থাকে। মা পরম তৃপ্তিতে ছেলের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকেন। নিজের ছেলেকে শেষবারের মতো পরীক্ষা করার জন্য বলেন, বাবা এইডা তোমার আম্মুরে খাইতে দিবা না?

আনোয়ার খাওয়া বন্ধ করে বলে, ও হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন, আম্মা। আমিতো ভুলেই গিয়েছিলাম। আম্মু আমসত্ত্ব খুব পছন্দ করবেন। ছেলে মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমসত্ত্বগুলো নিয়ে শাশুড়ির কাছে চলে যায়। মা আর উঠে আসেন না। ছেলেকে বিদায় জানানোর জন্যও এগিয়ে যান না।

রাবেয়া, রোকেয়া সবাইকে বিদায় জানিয়ে বাকি কাজগুলো করতে থাকে। মা তিন–চার দিন চুপচাপ থাকেন। কারও সাথে তেমন কথাও বলেন না, খাওয়া-দাওয়াও তেমন করেন না।

তিন–চার দিন পর রোকেয়া স্কুল থেকে আসার সময় হয়। রাবেয়া রান্নাবান্না সব শেষ করে বাড়ির সামনে রাস্তার পাশে পুকুরপাড়ে গিয়ে দাঁড়ায়। নুরুল হক গাছের নিচে নিজেকে আড়াল করে দাঁড়ায় যেন খালাম্মা না দেখতে পায়। স্কুল ড্রেস পরা রোকেয়া আসতে থাকে। নুরুল হক অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কাছাকাছি এসে রোকেয়া মজা করে ডাক দেয়, খাল্লাম্মা! ও খালাম্মা!

খালাম্মা শব্দটা শুনেই নুরুল হক লুঙ্গির কাছা মেরে নিজের জীবন বাঁচিয়ে হাঁটু সমান কাঁদা পানিতে খেতের মধ্যে নেমে দৌড়তে শুরু করে। রাবেয়া, রোকেয়া দুজনে হাসতে হাসতে বাড়ির দিকে আসে।

এদিকে মা পাশের বাড়ির কুলসুমকে ডাক দেন। কুলসুমকে নিয়ে নিজের প্রিয় বড় রাতা মোরগটা জবাই করেন, রান্না করেন। রাবেয়া, রোকেয়াকে চাটি বিছিয়ে খেতে দেন। নিজে বেড়ে দেন। রাতা মোরগের এক টুকরা রান রাবেয়ার পাতে দেন, আরেক টুকরা রোকেয়ার পাতে দেন। বেছে বেছে ভালো জিনিসগুলো রাবেয়া, রোকেয়াকে খেতে দেন। রাবেয়া বলে, আম্মা আইজকা আপনার কী হইছে।

রোকেয়া বলে, তুমি বুঝবা না। তোমার মাথায় বুদ্ধি কম। খাওয়া শেষ কর। ঘরে যাইয়া পরে কমু।

মা কিছুই বলেন না, শুধু উদাস দৃষ্টিতে বাইরে যে পথ দিয়ে ছেলে চলে গিয়েছিল, সে পথের দিকেই তাকিয়ে থাকেন।
...

নূর নাজমা: সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।