স্মার্টফোন আসক্তি ও একটি শেষকৃত্য

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

আজকাল বিভিন্ন ব্লগ, প্রতিষ্ঠান ও গবেষণা থেকে জানতে পারছি, স্মার্টফোনের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার শারীরিক, মানসিক, আত্মিক ও আধ্যাত্মিক জীবনে কত খারাপ প্রভাব ফেলছে! এমনকি বিজ্ঞানীরা এখন এই বিষয়কে গণস্বাস্থ্যের সচেতনতার একটি অংশ হিসেবে দেখেছেন। পশ্চিমা বিশ্ব স্মার্টফোন রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার খুলেছে, যেন মানুষ এই আসক্তি থেকে মুক্ত থাকতে পারে। পত্র-পত্রিকায় নানাভাবে দেখানো হচ্ছে কীভাবে স্মার্টফোনের পরিমিত ব্যবহার করা যায়। যদিও পাশেই দেখা যায়, একটা প্রলোভনযুক্ত বিজ্ঞাপন থাকে, হয় স্মার্টফোনের কিংবা আরেকটি তথ্যপ্রযুক্তির গ্যাজেটের। ফলে এই আসক্তি থেকে মুক্ত থাকাটাও অনেক সময় আর হয়ে ওঠে না। চেষ্টা করলে মনে হয় ড্রাগের আসক্তি থেকে মুক্ত হওয়া যায়, কেননা একটা পরিবারে হয়তো একজনই ড্রাগে আসক্ত। কিন্তু সেলফোন–স্মার্টফোন আসক্তিতে সবাইই কি ভুগছি না?

আমি নিজে তথ্যপ্রযুক্তির একজন ছাত্রী। গত প্রায় বেশ কিছু বছর ধরে প্রবাসে পড়াশোনা করছি। দিনের একটা দীর্ঘ সময় আমাকে ল্যাপটপের সামনে বসে কাজ করতে হয়। পরিবারের সবার সঙ্গে কথা বলতে মনের মধ্যে একটা আকুলি-বিকুলি কাজ করে। তাই স্মার্টফোনেও বেশ কিছু সময় দিতে হয়। আমি মানুষ, আমার ইলেকট্রনিক ডিভাইসের বাইরেও একটা জীবন থাকা উচিত। এসব কারণে সন্ধ্যায় বাসায় ফেরার আগে মাঝে মাঝে ল্যাপটপ, স্মার্টফোন ও ট্যাব—এ জাতীয় যত ডিভাইস আছে, অফিসে লক করে রেখে আসি। সন্ধ্যায় প্রিয় মানুষটার সঙ্গে সময় কাটাই, নয়তো ছবি আঁকি, নয়তো এই হেঁড়ে গলায় একটা গান ধরি, ডায়েরি লিখি কিংবা মজার কোনো রান্না করি। এ জন্য সাস্কাতুনের কোনো মানুষ আমাকে সন্ধ্যার পর খুঁজে না পেলে পরে যখন জিজ্ঞাসা করেন, এ রকম সবকিছু থেকে দূরে থাকার কারণ কী? তারা বলেন, আমাকে খুঁজে পান না। এ জন্য আমি অনেক বিনয়ের সঙ্গে ক্ষমা চেয়ে নিই। কিন্তু সম্পূর্ণ বিষয়টা বুঝিয়ে বললে তারা বোঝেন।

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

এর মধ্যে কেউ কেউ আবার ভয় দেখান। সেটা কী রকম? একটা ইমার্জেন্সি খবর এলে কীভাবে পাব? আসলে একটা রূঢ় বাস্তবতা হচ্ছে, যেদিন দেশ ছেড়ে চলে এসেছি, সেদিন অনেক মায়া ছেড়ে আসতে হয়েছে। এই ভয়াবহ বিষয়টি মেনে নিয়েছিলাম, যেকোনো মুহূর্তে পরিবারের যেকোনো ইমার্জেন্সি হতে পারে (অনেক সময় আমরা ভাবতে চাই না, এ রকম ইমার্জেন্সিও হতে পারে)। সেরকম যদি হয়, তাহলে কী করব? আমি কী আদৌ এত দূরে বসে কোনো সাহায্য করতে পারব? রাতেরবেলা হঠাৎ একটা ইমার্জেন্সি খবর পেয়ে আমি ঠিক সেই মুহূর্তে কিছু কী করতে পারব? আর স্মার্টফোন আসার আগে মানুষের কী ইমার্জেন্সি হতো না? তখন তারা কীভাবে সামাল দিতেন? আর সেরকম যদি ইমার্জেন্সি খবর হয়, যা আমাকে এই মুহূর্তে জানতেই হবে, এ জন্য একটা ইমার্জেন্সি ল্যান্ডফোন আছে আমার বাসায়, যে নম্বর কয়েকজন কাছের মানুষ ছাড়া আর কেউ জানেন না। সেখানেই আমি প্রয়োজনীয় খবরটা পাই।

একটা ভয়, আতঙ্ক ও ইমার্জেন্সিকে জীবনের সঙ্গে মেলাতে গিয়ে আমরা আসলে কীসের দিকে যাচ্ছি? একটা সামাজিক আয়োজনে গেলে, সবার সেলফি তোলার একটা ঝোঁক ওঠে। যাই দেখছে, যাই করছে, তারই একটা সেলফি। দাওয়াতে রান্না ভালো হয়েছে, রান্নার সঙ্গে সেলফি। ভাবির শাড়িটা সুন্দর, তার সঙ্গে সেলফি। একটা গ্রুপ ছবি তুলতে চাইলে, কেউই আর সেই ছবি থেকে বাদ পড়তে চান না, এ জন্য এসেছে গ্রুপফি। এদিকে বাচ্চা কান্নাকাটি করছে, সেদিকে বাবা-মায়ের হুঁশ নেই। বাচ্চাকে একটা ট্যাব বা স্মার্টফোন দিয়ে বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বাচ্চা সেই ডিভাইসের দিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে আছে। অনেক বাবা-মা হয়তো বাচ্চার দুই-তিন বছর বয়স পর্যন্ত জানেনই না, বাচ্চার একটা পারমানেন্ট লার্নিং ডিজঅ্যাবিলিটি হয়ে গিয়েছে। বিশেষ করে আজকাল অনেক বাচ্চা দেরিতে কথা বলা শিখছে। একজন বাচ্চা যদি সব সময় দেখে, একটা ডিভাইস তার দিকে তাকিয়ে কথা বলছে, তাকে ভালো সময় দিচ্ছে, তাকে কখনোই এটা জিজ্ঞাসা করে বিরক্ত (!) করছে না, ‘বাবু, তোমার নাম কী?’, সেই বাচ্চা কেন সামাজিক অনুষ্ঠানে মানুষের সঙ্গে কথা বলবে? সেতো দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এই একটা সেটআপে অভ্যস্ত যে, তার কাছে কেউ কোনো রেসপন্স বা উত্তর আশা করে না। তার সবচেয়ে প্রিয় সঙ্গী, সার্বক্ষণিক খেলার সাথি ডিভাইসটি তো তাকে জোর করে না একটা আদরের বুলি মুখ ফুটে বলার জন্য। সে তাহলে কেন কথা বলবে?

এমনিতেই প্রবাসে আমরা দেশের মানুষদের চেয়ে একা থাকি। পরিবার, আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব থেকে কত দূরে থাকি! সবাইই আমরা যার যার স্বপ্ন পূরণ কিংবা শুধু সাধারণ জীবিকা নির্বাহ করার জন্য সব সময়ই পরিশ্রম করি। কার এত সময় আছে অন্য একজনকে সময় দেওয়ার? কারও বাসায় দাওয়াতের অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান—এই দুইটা জিনিস এমনিতে আমি খুব উপভোগ করি। এই জায়গাগুলোতে গিয়ে দেশের মানুষের সঙ্গে একটু সময় কাটানোর সুযোগ পাই। কিন্তু সব সময় কী কোয়ালিটি সময়টা পাই? দাওয়াতে গেলে টিনএজ ছেলেমেয়েগুলো মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে ঘাড় নিচু করে ডিভাইসটির দিকে তাকিয়ে আছে। পুরুষ সদস্যগুলোও একসঙ্গে সবাই টিভি স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে। নারীরাও একটু পর পর সেলফি তুলছে বা যিনি একটু কথা কম বলেন, তিনি একটা কর্নার বেছে নিয়ে মোবাইল ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছেন। এই আসক্তি ড্রাগ আসক্তির চেয়ে কীভাবে কোনো অংশে কম? ফলে একা প্রবাস জীবনে সবাই যেন আমরা আরও একা হয়ে পড়ছি।

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

একবার সাস্কাতুনের থিয়েটারে বাংলাদেশি সিনেমা এসেছে। এই সুযোগ হাতছাড়া করব না। গেলাম সিনেমা দেখতে। সিনেমা শুরু করার আগে অনেকবার পর্দায় দেখানো হচ্ছে, অনুগ্রহ করে সিনেমা চলাকালে মোবাইল ফোনটি যেন আমরা ব্যবহার না করি। আসলে অন্ধকার ঘরে সিনেমার পর্দায় মনোযোগ দিয়ে নিজের দেশের একটা সিনেমা দেখব, এর থেকে আনন্দের বিষয় আর কী হতে পারে? এর মধ্যেই কয়েকজন তার মোবাইল ফোন বের করে ফেসবুক চেক করছে। তাও একবার না, একটু পর পর। অন্ধকার ঘরে সেলফি তুলছে। আমার মাথায় প্রশ্ন এল, এই অন্ধকার ঘরের সেলফিতে তাকে কয়জন লাইক দেবেন? সবচেয়ে বড় কথা, আশপাশের মানুষের অনেক বিরক্তির কারণ হচ্ছে তারা। আসলে মানুষের বিরক্তির প্রভাবক হওয়া কিংবা বিরক্তির কারণ হওয়ার মধ্যে খুব আনন্দের কিছু থাকার কথা না। তা ছাড়া, সারাক্ষণ ফেসবুকের সঙ্গে থাকা মানে মাথার মধ্যে সারাক্ষণ এক দল মানুষের কোলাহলের মধ্যে থাকা। সেখানে নিজের জন্য সময় কীভাবে পাব আমরা?

একটা কথা বলে রাখি। ব্যক্তিগত জীবনে আমি ফেসবুক ব্যবহার করি না। বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকে জানতে পেরেছি, এই একটি অ্যাপ আমাদের মস্তিষ্ক ও আমাদের স্বভাবকে কী ভয়াবহভাবে নিয়ন্ত্রণ করে! আমাদের আচরণ আগে থেকেই প্রেডিক্ট করা যায় এবং সেই অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ফেসবুকের আনলিমিটেড স্ক্রলিং কীভাবে একটা মানুষকে স্মার্টফোন ছেড়ে যেতে দেয় না—এই বিষয়টি আমাকে সব সময়ই ভাবায়। বিয়ে-শাদি, বেবি শাওয়ার, সন্তান হওয়া, ডিভোর্স হওয়া, মৃত্যুবরণ—সবকিছুই যেন ফেসবুককে ঘিরে। যেন ফেসবুক না থাকলে জীবনঘনিষ্ঠ এই সব ঘটনাগুলো ম্লান হয়ে যেত। কিন্তু কীভাবে আমার জীবনের নিয়ন্ত্রণ স্রষ্টা ছাড়া একটা অ্যাপের হাতে তুলে দিই?

তো যে কথায় ছিলাম। গত বছর সাস্কাতুনে হঠাৎ দুই গ্রুপ মানুষের মধ্যে ঝগড়া বেঁধে যায়। এত বছর থাকতে থাকতে আমরা সবাই আসলে আপন মানুষের মতো মিলেমিশে থাকি। তো একদিন দেখলাম, গ্রুপ ইমেইলে জঘন্য রকমের আঘাত করে এক পক্ষ আরেক পক্ষকে লিখছে। কিন্তু যেই দুই ব্যক্তি নিয়ে এত ঝামেলা, তারা কিন্তু এগুলোর মধ্যে নাই। অনেকটা ‘যার বিয়ে তার খবর নাই, পাড়াপড়শির ঘুম নাই’। তো যে-ই এসে ইমেইলে কিছু বলছেন, সেই যেন সম্মানটা হারাচ্ছেন। কেউ এই ঝামেলা থামাতে গেলেও অসম্মানিত হচ্ছেন। আর কথোপকথনগুলো এমন ছিল যে, সবারই কিছু না কিছু আঘাত করে বলতে ইচ্ছা হচ্ছে। আমার মনের মধ্যে একটা সন্দেহ এল, এই সম্পূর্ণ ঝামেলার একটা বড় নিয়ামক হতে পারে ফেসবুক। দু-একজন পরিচিতজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, তারা বললেন, হ্যাঁ, ফেসবুক আসলে অন্যতম কারণ যেখানে এই ধরনের বিষয় নিয়ে আঘাত করে কথা বলা হচ্ছে। ফেসবুকে বলে অনেক দিন একের পর এক ঘটনা ঘটেছে, যার ফল এই ইমেইল গ্রুপে ঝগড়া।

আসলে এ ধরনের ভার্চুয়াল জগৎ আমাদের কাছাকাছি আনতে আনতে এত বেশি কাছে এনে ফেলেছে যে, কাউকে কষ্ট দিয়ে, আঘাত দিয়ে কথা বলার সুযোগ অনেক বেশি। আগে যেমন পায়ে হেঁটে মানুষটার সামনে গিয়ে চোখে চোখ রেখে একটা কটু কথা বলতে নিলে একে তো দুঃসাহস লাগত, তার ওপর যাত্রা পথে অনেক সময় সুন্দর পাখি, গাছ, কিংবা মানুষ দেখে রাগ অনেকটা পড়ে যেত। ফলে যে কথাগুলো আঘাত করার জন্য রেডি ছিল, সেগুলো যেন হাওয়া! কিন্তু এখন আমরা দিনে বা রাতে যেকোনো সময়, যেকোনো মানুষকে আঘাত করে দূরে ঠেলে দিতে পারি। জীবনের কিছু কিছু ক্ষেত্রে চুপ করে থেকে পরে ঠান্ডা মাথায় উত্তর দেওয়াটা অনেক কঠিন একটা কাজ। ওই চুপ করে থাকার সময়টা আমরা কেন যেন নিতে চাই না। এ জন্যই হয়তো আদিকালে মুনি-ঋষি-অলি-বুজুর্গ ব্যক্তিরা মৌন সাধনায় নিমগ্ন হতেন। পবিত্র কোরআন শরিফেও দেখি, আল্লাহ তালা মৌনতার নির্দেশ দিয়েছিলেন হজরত জাকারিয়া (আ.)–কে, যখন তিনি আল্লাহর কাছে নিদর্শন চেয়েছিলেন।

আমরা আসলে সাস্কাতুনের অনেক মানুষ সেদিন ভুলে গিয়েছিলাম, দিন একদিন আমারও ফুরাবে। যে যেই ধর্মেরই হই না কেন, এই মাটিতে যদি মৃত্যু লেখা থাকে, সেদিন আমাদের মৃত্যুর পরে গোসল, দাফন, কবর/দাহ এই সাস্কাটুনবাসীরাই কিন্তু করবেন। এত ছোট্ট একটা শহর, সবাই সবাইকে চিনি। কারও মৃত্যুর খবর পেলে না গিয়ে কি থাকতে পারব? কিংবা আমরা কেউ কী চাই যে, কেউ আমাদের মৃত্যুর খবর পেলে প্রথমেই এটা মনে করবে, এই ব্যক্তি এর আগে কতজন মানুষকে আঘাত করে কথা বলেছিলেন? পণ্য দাসত্ব আর স্মার্টফোনের ভার্চুয়াল এ যুগে এই ভাবনাগুলো আমাদের মাথা থেকে অনেক সময় দূরে সরে যায়।

পরিশেষে একটা ছোট ঘটনা দিয়ে লেখাটা শেষ করছি। কয়েক দিন আগেই একটা শেষকৃত্যে গেলাম। ১২ বছর বয়সী এক ছোট্ট সোনামণি দুরারোগ্য ক্যানসারের সঙ্গে লড়ে অনেক সাহসিকতার সঙ্গে এই পৃথিবীর যাত্রা শেষ করেছে। যেদিন খবরটি পেলাম মনের ভেতরটা কেমন যেন করে উঠল! তার বাবা-মাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি। আর বাচ্চাটিকেও মাঝে মাঝে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে খেলতে দেখতাম। সবাই যেভাবে পেরেছে, চেষ্টা করেছে বাচ্চাটির বাবা-মায়ের পাশে দাঁড়াতে। আমরাও তাকে শেষ বিদায় জানানোর জন্য ফিউনারেল হোমে যাই। বাইরে সেদিন বৃষ্টির মতো ঝিরঝিরে তুষার পড়ছে। ছোটবেলায় শুনতাম, কোনো মৃত্যুর পরে বৃষ্টি হলে বলে সেটা শুভ লক্ষণ। মনে মনে বাচ্চাটির আত্মার প্রশান্তির জন্য দোয়া করছিলাম।

ফিউনারেল হোমে গিয়ে দেখি, থমথমে একটা পরিবেশ। বাবা-মায়ের সে যে কী কান্না! আসলে সন্তান হারানোর কষ্ট শুধুমাত্র যিনি সন্তান হারিয়েছেন, তিনিই বুঝতে পারেন, আর কেউ না। কিন্তু বাবা-মায়ের সেই কষ্ট বেশিক্ষণ যেন দেখা যায় না। যখন কফিনের ভেতরে ছোট্ট সোনামণির নিথর দেহটি কাছ থেকে দেখলাম, কী যে সুন্দর তাকে লাগছিল? কে বলবে সে মৃত? কী যে প্রশান্তি তার চোখে-মুখে! সব কষ্ট থেকে যেন স্রষ্টা তাকে মুক্তি দিয়েছেন। গায়ে হালকা গোলাপি রঙের পাঞ্জাবি। চেহারাটা কী যে সুন্দর! কী যে সুন্দর! চোখের পানি আটকে রাখা কষ্ট। তারপরেও সেই ছোট্ট সোনামণির চেহারাটা বারবার দেখতে ইচ্ছা করছে। তাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছি আর বারবার দোয়া করছি, মহান স্রষ্টা যেন এই সন্তানের বাবা-মায়ের এই ভয়াবহ কষ্ট দূর করে দেন, এই শোক যেন দূর করে দেন।

আমি জানি না, কেন, কিন্তু মাথায় কেন যেন এল, কেউ নিশ্চয়ই এখন এ রকম পরিবেশে ছবি বা সেলফি তুলবে না। ছবি তো দূরের কথা, মোবাইল ফোন পর্যন্ত বের করবে না। আচ্ছা, কীভাবে এই গভীর মুহূর্তে একটা ফালতু ডিভাইসের কথা মাথায় এল? মানুষের মস্তিষ্ক মুহূর্তের মধ্যেই কত বিচিত্র ভাবনা ভাবতে পারে, যেখানে পরিস্থিতির সঙ্গে ভাবনার কোনো সম্পর্ক নেই।

কিছুক্ষণ পর অবাক হয়ে দেখলাম, একাধিক ব্যক্তি এসে সবকিছু স্মার্টফোনে ভিডিও করছেন, কফিনের মধ্যে ফোনটা অনেকখানি ঢুকিয়ে ফেলেছেন। মোটেও মৃত ব্যক্তির স্মৃতি ধরে রাখার চেষ্টা না, কেন যেন মনে হচ্ছিল, স্বভাব বা অভ্যাসবশত মোবাইল হাতে নিয়ে এই কাজটি করছেন। কেন আমরা আইফোন নিয়ে মাতামাতি করি, যখন ‘আই’ বা আমিটাকে চিনতে পারছি না? কেন একটা লাশের কফিনের মধ্যে ফোন ঢুকিয়ে ছবি তোলার চেষ্টা করতে হবে? যে চলে গিয়েছে, তাকে কি আটকাতে পারব? তার স্মৃতি কি ধরে রাখতে পারব? বাচ্চাটির বাবা-মা কি কম চেষ্টা করেছিল আদরের বুকের মানিককে একটু বেশি সময়ের জন্য ধরে রাখতে? যেহেতু ডাক্তার শেষ জবাব দিয়ে দিয়েছিলেন, বাবা-মা বলে সারাক্ষণ বাচ্চাটিকে ধরে দাঁড়িয়ে থাকতেন। যেন চলে যাওয়ার সময় তারা সন্তানের পাশে থাকতে পারেন।

অন্তত সন্তান হারানো সেই বাবা-মাকে মনে হয় একটু সম্মান আমরা জানাতে পারতাম, হয় শোক প্রকাশ করে, কিংবা মৌন থেকে, স্মার্টফোন কফিনের মধ্যে ঢুকিয়ে ছবি তুলে না।
...

রিফাত জাহান: পিএইচডি শিক্ষার্থী, ডিপার্টমেন্ট অব কমপিউটার সায়েন্স, ইউনিভার্সিটি অব সাস্কাচেওয়ান, সাস্কাতুন, কানাডা।