নারীর প্রসব-উত্তর বিষণ্নতা

সপরিবার আন্দ্রিয়া ইয়েটস (ছবিতে বাঁয়ে), আন্দ্রিয়া ইয়েটস ও রাস্টি ইয়েটস (ডানে ওপরে) এবং আন্দ্রিয়া ইয়েটসের পঞ্চম সন্তান (ডানে নিচে)
সপরিবার আন্দ্রিয়া ইয়েটস (ছবিতে বাঁয়ে), আন্দ্রিয়া ইয়েটস ও রাস্টি ইয়েটস (ডানে ওপরে) এবং আন্দ্রিয়া ইয়েটসের পঞ্চম সন্তান (ডানে নিচে)

জুন মাসের ২০ তারিখ। সকাল নয়টা। ২০০১ সাল। সেদিন ৯১১-এর অপারেটর একটি অদ্ভুত কল পেলেন।

ওপাশ থেকে একজন নারী হিমশীতল কণ্ঠে বললেন, ‘আমার একজন পুলিশ অফিসার লাগবে।’

অপারেটর বললেন, ‘অবশ্যই ম্যাম, বাট হোয়াট ইজ ইয়োর ইমারজেন্সি?’

যুক্তরাষ্ট্রে ৯১১-এ কল করে পুলিশ চাইলেই পুলিশ পাওয়া যায় এবং কয়েক মিনিটের মধ্যেই পুলিশি সাহায্য এসে হাজির হয়। কোনো ক্ষেত্রে দুই মিনিটের মধ্যেই পুলিশি সাহায্য পাওয়া যায়। এটা এদের চ্যালেঞ্জ। তবে তার আগে অবশ্যই কারণ ও ঘটনার বর্ণনা বিস্তারিতভাবে বলতে হবে। না হলে দেখা গেল গ্যাং ওয়ার হচ্ছে এবং ৯১১ অপারেটর মাত্র একজন অফিসার পাঠিয়ে বসলেন। বেচারা সেখানেই নিহত হবেন। আবার উল্টোটা হলেও ঝামেলা। স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া চলছে, দেখা গেল এক ব্যাটালিয়ন পুলিশ সোয়াট টিমের সঙ্গে হেলিকপ্টার নিয়ে হাজির, এফবিআইও ওই পথেই আছে।

কাজেই কল পাওয়ার পর অপারেটর একদম বিস্তারিতভাবে জেনে নেন—কেন পুলিশ লাগবে, যার বিরুদ্ধে লাগবে তার সঙ্গে অস্ত্র আছে কিনা, ওরা সংখ্যায় কতজন, মারমুখী কিনা ইত্যাদি।

নারী আবার অপারেটরকে বললেন, আমার একজন অফিসার লাগবে।

অপারেটর যতই জিজ্ঞেস করেন কেন লাগবে, ওই নারীর একই জবাব, তার একজন অফিসার লাগবে।

৯১১ অপারেটর নারীর ঠিকানা নিয়ে বললেন, ঠিক আছে আমি পুলিশ পাঠাচ্ছি।

এদিকে যে নারী ৯১১-এ কল করেছিলেন, তিনি ৯১১-এ কথা বলে নিজের স্বামীকে ফোন দিলেন। ভদ্রলোক নাসায় কাজ করেন। সকাল নয়টায় মাত্র অফিসে এসেছেন। ফোন রিসিভ করতেই তাঁর স্ত্রী তাঁকে বললেন, তোমাকে এখুনি বাড়ি ফিরে আসতে হবে। এখুনি।

ভদ্রলোক কোনো কথা বাড়ালেন না। বুঝলেন কোনো একটা সমস্যা হয়েছে। তিনি বাড়ির দিকে রওনা হলেন।

বাড়ি এসে দেখেন তার পুরো বাড়ি পুলিশ, মেডিকেল ডাক্তার ও সরকারি লোকজনে গিজগিজ করছে। কাউকে ভেতরে ঢুকতে বা বেরোতে দেওয়া হচ্ছে না। তিনি নিজের পরিচয় দিয়ে ঘটনা কী জানতে চাইলেন।

পুলিশ জানাল, তাঁর স্ত্রী তাদের পাঁচ সন্তানকে মেরে ফেলেছে।

ভদ্রলোক শোকের ধাক্কা সামলাতে সামলাতেই দেখেন তাঁর স্ত্রীকে হাতকড়া পরিয়ে পুলিশ বাড়ি থেকে বের করে এনে গাড়িতে ওঠাচ্ছে। ভদ্রমহিলার চেহারায় কোনো অভিব্যক্তি নেই। তিনি হাউমাউ কান্নায় ভেঙে পড়লেন।

এ ঘটনায় পুরো যুক্তরাষ্ট্র ফুঁসে উঠল। সবাই পাঁচ সন্তান হত্যাকারী মায়ের সর্বোচ্চ শাস্তি চায়।

পুলিশ অফিসার সাক্ষ্য দিতে গিয়ে কেঁদে ফেললেন। তিনি তার সাক্ষ্যে বলেন, ‘প্রথমে আমার মনে হয়েছিল মেঝেতে পুতুল পড়ে আছে। গায়ে হাত দিয়ে দেখি এটা মানব শিশু। নিথর। নিষ্পলক আমার দিকেই যেন তাকিয়ে আছে। তারপর আসামি আমাকে দেখাল আরও চারজন বিছানায় শুয়ে আছে। একটা তিন বছরের ছেলের কোলে ছয় মাস বয়সী একটি বাচ্চা মেয়েকে দেখলাম। সবাই মৃত। আমার ক্যারিয়ারে এত কঠিন সময় আমাকে কখনই দেখতে হয়নি।’

অদ্ভুত শোনালেও সত্য, ওই নারীর পাশে এসে দাঁড়ালেন তাঁর স্বামী। তিনি বারবার মিডিয়া ও আদালতকে বলতে থাকলেন, আমার স্ত্রী মানসিকভাবে অসুস্থ। তিনি তাঁর সন্তানদের অত্যন্ত ভালোবাসতেন। তাঁর মতন মা হয় না। সে একজন চমৎকার স্ত্রী। সে সুস্থ মাথায় এই হত্যাকাণ্ড কিছুতেই করতে পারে না।

ওদিকে কিছু মিডিয়া তার স্বভাব মতো রসিয়ে রসিয়ে ঘটনাটাকে উপস্থাপন করার চেষ্টা করল এমনভাবে যে, আসলে ভদ্রলোক নিজেই খুনি। না হলে পাঁচ সন্তান হারাবার পর একজন বাবা কীভাবে মিডিয়ার সামনে হাসিমুখে কথা বলতে পারেন? কেন তিনি নিজের খুনি স্ত্রীকে বাঁচাবার চেষ্টা করছেন? কেন?

যে নারী এই ঘটনা ঘটিয়েছিলেন তাঁর নাম আন্দ্রিয়া ইয়েটস।

সত্য ঘটনা হচ্ছে, আন্দ্রিয়া ইয়েটস আসলেই একজন মানসিক রোগী ছিলেন। সাইকোলজিতে একে পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন (প্রসব-উত্তর বিষণ্নতা) বলে। শিশু জন্মের পরে প্রায় সব মায়েরই এমনটা হয়ে থাকে। এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি ঘটনা। শরীরে ম্যাসিভ হরমোনাল চেঞ্জের জন্য এমনটা ঘটে। আমাদের দেশের বেশির ভাগ লোকই যা জানেন না।

এই সময়ে মায়েরা স্বামীদের খুন করে ফেলতে চান অথবা আত্মহত্যা করতে চান। অথবা এমন কিছু করতে চান, যা সুস্থ মাথার মানুষ কল্পনাও করতে পারেন না। বিদেশে এই রোগের ভালো চিকিৎসা আছে। তারা মনস্তত্ত্ববিদের কাছে যান, কাউন্সেলিং করেন, ওষুধ খান, সুস্থও হয়ে যান।

আমাদের দেশে প্রথমেই মেয়েকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। শাশুড়ি-ননদরা মুখ বাঁকিয়ে বলবেন, আমরা আর মা হই নাই। সবই ঢং আর ফুটানি! মেয়ের মাও বলবেন, মানিয়ে নে মা...মানিয়ে নে। বোনও বলবেন, মানিয়ে নে।

স্বামীতো কিছুই শুনতে চাইবেন না, বোঝাতো বহুদূর। হয়তো বলবেন, দেখো, নানান টেনশনে এমনিতেই আমার মাথা গরম থাকে। তোমার এই সব ফালতু ঢং শুনতে ইচ্ছা করছে না।

আর পাড়া-প্রতিবেশীর কথা বাদ। চারদিকে ফুসুর ফুসুর, জানেন ভাবি, তিনতলার ভাবিটা না...হিহিহি।

গৃহিণী আন্দ্রিয়া ইয়েটসের তৃতীয় সন্তান জন্মের পর থেকেই তাঁর মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যেতে থাকে। তিনি পাগলের মতোই সন্তানদের ভালোবাসতেন। কিন্তু একই সঙ্গে তাঁর পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন তাঁকে খেয়ে ফেলছিল। নিজের সন্তানদের যাতে ক্ষতি না করতে পারেন, সে জন্য তিনি আত্মহত্যা করতে চাইলেন দুবার। দুইবারই তিনি ব্যর্থ হলেন। ডাক্তার তাঁকে অ্যান্টি ডিপ্রেশন ওষুধ দিলেন। তিনি কিছুদিন খেলেন। তারপর সুস্থ হয়ে গেছেন ভেবে খাওয়া বন্ধ করে দিলেন।

স্বামী ভাবলেন আরেকটা সন্তান এলে হয়তো স্ত্রী সুস্থ হয়ে উঠবেন। কিন্তু উল্টোটা ঘটল। চার সন্তানদের পর অবস্থা আরও বাজে হলো। এর মধ্যে ডিপ্রেশনের ওষুধ মাঝ পথে বন্ধ করে আবার শুরু করায় ব্রেনও এলোমেলো হয়ে গেল।

পঞ্চম সন্তানের জন্ম পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলল। ডাক্তারের কাউন্সেলিং, হাইডোজের ওষুধ বা পরিবারের সাহচর্য, কিছুই কাজে এল না। তিনি একে একে পাঁচটা বাচ্চাকেই বাথটাবের পানিতে চুবিয়ে মারলেন।

ছোট চার বাচ্চা কিছুই বোঝেনি। তারা চুপচাপ মরে গেছে। বড় ছেলেটা ভেবেছিল মা হয়তো তাকে কোনো দুষ্টামির জন্য শাস্তি দিচ্ছে। বাথটাবের পানিতে চুবানি খেতে খেতে সে কাঁদতে কাঁদতে বলছিল, ‘I'll be good. I'll be good.’

বাঙালি বাচ্চা হলে যে বলত, আমি আর করব না মা, আর করব না।

মাকে যখন জিজ্ঞেস করা হয় কাজগুলো তুমি কেন করলে? তিনি বলেন, ‘আমার এক ছেলে বড় হয়ে সিরিয়াল কিলার হতো, আরেকটা ড্রাগ অ্যাডিক্ট। আর মেয়ে হতো বেশ্যা।’

‘তোমাকে এই কথা কে বলেছে?’

‘শয়তান।’

‘শয়তান তোমাকে নিজে বলেছে?’

‘হু।’

আন্দ্রিয়া ইয়েটসের স্বামী রাস্টি ইয়েটস ট্রায়ালের শেষ দিন পর্যন্ত স্ত্রীর পক্ষে ছিলেন। আমেরিকান আদালত আন্দ্রিয়াকে সন্তান হত্যার দায় থেকে মুক্ত ঘোষণা করল। তবে তাঁকে মানসিক রোগের চিকিৎসার নির্দেশ দিল। ওই নারী এখনো মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। হয়তো আজীবন তাই থাকবেন।

রাস্টির সঙ্গে তাঁর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। রাস্টি আবার বিয়ে করে এখন নতুনভাবে জীবন শুরু করেছেন। তাঁর নতুন সংসারে এখন একটি শিশু। তবে এখনো তিনি প্রায়ই আন্দ্রিয়ার খোঁজ নিতে হাসপাতালে যান।

হিউস্টনের একটি কবরস্থানে বিরাট একটা ফলকে লেখা আছে—‘ইয়েটস’ এবং তার নিচেই নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে পাঁচ ভাইবোন।

এ ধরনের ঘটনাটা কি আমাদের দেশে ঘটে না? প্রায়ই দেখা যাচ্ছে মায়ের হাতে সন্তান খুন। স্ত্রীর হাতে স্বামী খুন। প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে গেছে নবজাতকের মা। কিংবা মায়ের আত্মহত্যা।

আমরা তখন কী করি? কথা ছাড়া মেয়ের দোষ দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলি।

এই এক ঘটনার পর পুরো যুক্তরাষ্ট্র নড়েচড়ে বসেছিল। পোস্টপার্টেম ডিপ্রেশনকে এরা হাইয়েস্ট প্রায়োরিটি দিয়ে চিকিৎসা করে। এরা শিক্ষিত জাতি। তারা বোঝে যে মানসিক রোগ মানেই পাগল নয়। সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো মানেই উন্মাদ নয়। পাগল হলেই কেবল কাউন্সেলিং করতে হয় না। বরং রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা করানোই বুদ্ধিমানের কাজ।

কয়েক দিন আগে আমাদের দেশে ডিপ্রেশনে আক্রান্ত এক মেয়ের আত্মহত্যার ঘটনা শুনে এই ঘটনা মনে পড়ে গেল এবং আমি নিশ্চিত, আমরা আমাদের স্বভাব মতন সবাই মিলে মেয়েটিকে নিয়ে ছি ছি করছি।

মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে কেবল সুশিক্ষাই নয় বরং খানিকটা সুবুদ্ধিও দান করুন।