বাংলাদেশি অস্ট্রেলিয়ানের অস্ট্রেলিয়া ডে উদ্যাপন

চোখ ধাঁধানো আতশবাজি
চোখ ধাঁধানো আতশবাজি

প্রতিবছর ২৬ জানুয়ারি অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় দিবস হিসেবে উদ্‌যাপন করা হয় অস্ট্রেলিয়া ডে। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, এদিন ক্যাপ্টেন আর্থার ফিলিপের নেতৃত্বে ফার্স্ট ফ্লিটের প্রথম জাহাজটা নোঙর ফেলেছিল সিডনির পোর্ট জ্যাকসনে। তাই এখানকার আদিবাসীদের কাছে দিবসটা দুঃখের। কারণ এদিন থেকেই তাদের স্বাধীনতা হরণের কাজটা শুরু হয়েছিল। তারপরের ইতিহাস অনেক রক্তের আর গ্লানির। তাই প্রতিবছর ২৬ জানুয়ারি আদিবাসীরা পালন করেন অন্যভাবে। তারা দাবি জানিয়ে আসছেন জাতীয় দিবস থেকে এই দিনটি বাদ দেওয়ার জন্য। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ানদের কাছে অবশ্য দিবসটা একটা উৎসবের দিন। শিশুদের কাছেও অনেক আনন্দের। কারণ এদিন তাদের বাবা-মায়ের অফিস ছুটি থাকায় তাদের নিয়ে কোথাও না কোথাও ঘুরতে যায়। তাই বাবা-মায়ের চেয়ে শিশুরাই বেশি করে মনে রাখে দিনটা।

এবার অস্ট্রেলিয়া ডে আসার আগেই আমরা কোনো জায়গায় দিনব্যাপী ঘোরার একটা পরিকল্পনা করে রেখেছিলাম। কিন্তু পরবর্তীতে সেই পরিকল্পনা বাদ দিয়ে আমরা অস্ট্রেলিয়া ডে পালন করি। অস্ট্রেলিয়া ডের মেলায় বাচ্চাদের জন্য অনেক ধরনের বিনোদনের ব্যবস্থা থাকে। সিডনিতে অস্ট্রেলিয়া ডে উদ্‌যাপন করা হয় প্যারামাটা পার্কে। অবশ্য সিডনির আরও কয়েক জায়গায় এই দিবস উদ্‌যাপন করা হয়। কিন্তু প্যারামাটা পার্কেরটা সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ ও দীর্ঘ সময় ধরে চলে। শুরু হয় সকাল ছয়টায় আর শেষ হয় রাত নয়টায়।

ছুটির দিনে আমাদের মেয়ে তাহিয়া একটু দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে। আর ছেলে রায়ান সেই সাত সকালেই উঠে বসে থাকে। তারপর সবাইকে জ্বালিয়ে মারে। তাহিয়া উঠতে উঠতে আমরা স্বামী-স্ত্রী দুজন নাশতা তৈরি করে ফেললাম। তারপর নাশতা শেষ করে ওয়েস্টমিডে বন্ধু ননির বাসার উদ্দেশে রওনা দিলাম। গাড়ি চালিয়ে গেলে রায়ান আর তাহিয়া দুজনই ক্লান্ত ও বিরক্ত বোধ করে। তাই ট্রেনে রওনা হলাম। দুই জায়গায় ট্রেন বদলাতে হবে। পুরো রাস্তায় রায়ান সারাক্ষণই ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে কোনো না কোনো কিছু দেখে তার অব্যক্ত ভাষায় আমাদের বর্ণনা দিয়ে গেল। সেদিন ছিল ভয়ানক গরম। তাপমাত্রা চল্লিশের ঘর অতিক্রম করেছিল। তাই ননির বাসায় পৌঁছে আমরা বিকেলের আগে বাইরে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।

ননির বাসার পাশেই প্যারামাটা পার্ক। হেঁটে গেলে মিনিট পাঁচেকের পথ। বিথি ভাবির হাতের সুস্বাদু বিরিয়ানি খেয়ে আমরা যে যার মতো বিশ্রাম নিতে শুরু করলাম। আর বাচ্চারা তাদের মতো করে খেলাধুলা চালিয়ে গেল। বন্ধু ননি ও বিথি ভাবিদের তিন সন্তান। প্রহর, নাজিহা ও নাবিহা। রায়ান প্রহরের সঙ্গে আর তাহিয়া নাজিহার সঙ্গে খেলাধুলা চালিয়ে গেল। নাবিহা তার মতো করে সময় কাটাল। এভাবে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলে বারান্দার দরজার নেটের ওপাশ থেকে শীতল বাতাসের স্পর্শ পেয়ে বুঝলাম, বাইরের তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে এসেছে।

শিশুদের জন্য রাইড
শিশুদের জন্য রাইড

আমরা বেরিয়ে পড়লাম। বিথি ভাবি আমাদের বললেন, আমরা সকালে গিয়ে সব রাইড চড়ে এসেছি। আপনারা যান। আমরা একটু পরে আপনাদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছি। এ ছাড়া, এই ফাঁকে আমি একটু নাশতারও ব্যবস্থা করে ফেলব। আমরা হাঁটাপথে পার্কের প্রবেশপথে পৌঁছে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। নানারকম বাহারি পতাকায় পার্ক সাজানো হয়েছে। পার্কের ভেতরে অস্ট্রেলিয়া ডের জন্য আবার আলাদাভাবে অস্থায়ী গেট নির্মাণ করা হয়েছে। সেটা দিয়ে ঢুকেই আমরা লাল নীল বাহারি বর্ণের ত্রিকোণাকৃতি কাগজ দিয়ে সাজানো ঘেরা জায়গা দেখতে পেলাম। তাহিয়া বলল, বাবা সকালবেলা এখানে হট এয়ার বেলুন ছিল। সেটা পার হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতেই ‘ক্রিসেন্ট’। সেখানে মঞ্চ সাজানো আর তার সামনের বিশাল খোলা জায়গায় দর্শকদের বসার ব্যবস্থা। শুধুমাত্র ঘাসের ওপরে চুনের লাইন দিয়ে অনেকটা স্টেডিয়ামে বসার জায়গার আদল দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। সেখানে সারি সারি বসার জায়গার পাশাপাশি ওপরে নিচে ওঠার জন্য আবার কিছু জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে। আমরা মঞ্চকে পাশ কাটিয়ে সামনে এগিয়ে গেলাম। তখনো অনুষ্ঠান সেভাবে শুরু হয়নি। সবে রিহার্সাল চলছে।

প্রবেশ পথ
প্রবেশ পথ

মঞ্চের পাশেই একটা জায়গায় অস্ট্রেলিয়ার ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য হাতেকলমে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে সিডনি থেকে অস্ট্রেলিয়ার অন্য রাজ্যগুলোর রাজধানীর দূরত্ব দেখানোর পাশাপাশি একটা নামফলক দাঁড় করা আছে। তার পাশেই একটা গবাদিপশুর খামার। সেখানে হাঁস, মুরগি, গরু, এমনকি ভেড়ার মূর্তিও স্থান পেয়েছে। আছে উঁচু পানির ট্যাংক। সঙ্গে আছে বিভিন্ন প্রকার ফসল যেমন মিষ্টি কুমড়া, পাতা কপি ইত্যাদি।

এ ছাড়া ছিল বিভিন্ন রকমের চাকা আর পুরো জায়গাটার পেছনে ছিল খড়ের গাদার সারি। আর ফুল ও গাছের পাতা দিয়ে একটা সদর দরজার মতো বানানো। সেখানে দাঁড়িয়ে সবাই ছবি তুলছিল আর বাচ্চারা ঘুরেফিরে সব দেখছিল। অতি উৎসাহী কিছু মাকে দেখলাম তাদের বাচ্চাদের গরু ও ভেড়ার পিঠে তুলে দিয়ে ছবি তুলতে। খামারটাকে পাশ কাটিয়ে সামনে এগোতেই বাচ্চাদের খেলাধুলার রাইডগুলো চোখে পড়ল। অস্ট্রেলিয়ার প্রায় সব মেলাতেই একই ধরনের রাইড থাকে। বাম্পার কার, স্লাইড, জাম্পিং ক্যাসেল, বিভিন্ন রকমের দোলনা আর খেলনার দোকান।

খামারের মডেল
খামারের মডেল

তাহিয়া এর আগে রাইডগুলোর প্রায় সবগুলোতেই চড়েছে। তাই শুধুমাত্র উঁচু একটা দোলনার টিকিট কিনে দিলাম। সেটা থেকে নেমেই তাহিয়া বলল, বাবা মাথা ঘুরছে, পানি খাব। দেখলাম অনেকগুলো ভ্রাম্যমাণ পানির ট্যাপের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে পানি খাওয়াও যায় আবার বোতলে ভরে নেওয়াও যায়। একটু পরেই ননিরা সপরিবারে চলে এলে আমরা মঞ্চের সামনে একটা জায়গায় অবস্থান নিলাম। বাচ্চারা একেবারে মঞ্চের সামনের অস্থায়ী মাদুরে মোড়ানো জায়গায় নাচানাচি চালিয়ে গেল। পরে একসময় ক্লান্ত হয়ে আমাদের সঙ্গে এসে বসে পড়ল। তারপর বিথি ভাবির বানানো পেঁয়াজি আর ছোলার সঙ্গে মুড়ি দিয়ে ভরপেট নাশতা সেরে নিয়ে আমরা কনসার্ট উপভোগ করতে লাগলাম।

শিল্পীদের সবারই বয়স মাঝ বয়সের ওপরে। তাই দর্শকদের মধ্যে মধ্যবয়সী ও প্রৌঢ়রা দ্রুত নিজেদের সম্পৃক্ত করে হাততালি ও চিৎকার করে উচ্ছ্বাস জানাচ্ছিলেন। আমরাও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছিলাম। আসলে সামনাসামনি যেকোনো সংগীতানুষ্ঠান মনে দোলা দেয়। আপনি সেটা বোঝেন বা না বোঝেন। আমরাও একেকটা গানের শেষে চিৎকার করে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে যাচ্ছিলাম। ওদিকে মঞ্চের আলোর খেলা রায়ান আর প্রহরকে খুবই অবাক করেছিল। তারা এক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে দেখছিল। অবশেষে রাত নয়টার সময় শুরু হলো চোখ ধাঁধানো আতশবাজি। চলল পুরো দশ মিনিট ধরে। রায়ান আর প্রহর এক মুহূর্তের জন্যও সেদিক থেকে চোখ না ফিরিয়ে সেটা দেখে গেল। অবশেষে আতশবাজির খেলা শেষ হলে আমরা বাসার পথ ধরলাম। হাজার হাজার মানুষ সবাই শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে হেঁটে যাচ্ছেন। কোনো প্রকার বিশৃঙ্খলা নেই। বিথি ভাবি বললেন, এই ব্যাপারটা আমার খুব ভালো লাগে।

হট এয়ার বেলুন
হট এয়ার বেলুন

এভাবে আমাদের অস্ট্রেলিয়া ডে উদ্‌যাপন শেষ হলো। তবে এখানে একটা ব্যাপার সবার সঙ্গে শেয়ার করার লোভ সামলাতে পারছি না। অস্ট্রেলিয়া দে উপলক্ষে গত বছর তাহিয়া আর রায়ানের জন্য অস্ট্রেলিয়ার হলুদ রঙের টিশার্ট কিনেছিলাম। আর আমার জন্য সুপারশপ এলডি থেকে নীল রঙের একটা টিশার্ট কিনেছিলাম। এর বুকের ওপরে লেখা ‘আই অ্যাম নট ড্রাংক, আই অ্যাম জাস্ট অস্ট্রেলিয়ান’। রাস্তাঘাটে যতজন এই টিশার্টটা দেখেছিল বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়ান, তারা বলছিলেন নাইস টি শার্ট। তার মধ্যে নারীও ছিলেন বেশ কয়েকজন। গিন্নিকে বললাম, দেখ আমার রুচি কিন্তু খারাপ না। শুনে গিন্নি বলল, হ্যাঁ আপনি ধীরে ধীরে অস্ট্রেলিয়ান হয়ে যাচ্ছেন।

ননিদের বাসায় পৌঁছে একটু বিশ্রাম নিয়েই আমরা স্টেশনের দিকে পা বাড়ালাম। পথিমধ্যে একদল পুলিশের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। একজন পুলিশ আমার টি শার্টের লেখাটা দেখে আমাকে একটা স্যালুট দিয়ে বললেন, ‘স্যালুট স্যার অ্যাজ ইউ আর!’ উত্তরে আমি তাদের ধন্যবাদ দিলাম। সেটা দেখে তাহিয়া অনেক আনন্দ পেয়ে বলল, বাবা তোমাকে পুলিশ স্যালুট দিল কেন? আমি মজা করে বললাম আমরা আসলে অনেক ভালো মানুষ তাই স্যালুট দিয়েছে।

মাঠে দর্শক
মাঠে দর্শক

আসলেই অস্ট্রেলিয়ায় জীবনযাপন অনেক মজার, যদি আপনি একটু খোলা মন নিয়ে সবার সঙ্গে মেশেন। আর বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া ডে উদ্‌যাপনের লক্ষ্যই হচ্ছে, অভিবাসী ও স্থানীয়দের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করা। বিভিন্ন দেশ থেকে আগত সব অস্ট্রেলিয়ানই যেন সমান অধিকার নিয়ে দেশটিতে বসবাস করে। পুলিশের স্যালুট পেয়ে আমি আর তাহিয়া খুশি হয়ে স্লোগান ধরলাম। আমি বলি, অজি অজি অজি তাহিয়া বলে, ওই ওই ওই।
...

লেখকের ইমেইল: <[email protected]>