অ্যালবাম

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ছুটির দিন। সকাল নয়টা। কোমল রোদ শুয়ে আছে কাঠের ফ্লোরে। মাঝে মাঝে দু-একটা পাখির ডাক। সারা আর হাসান ড্রয়িংয়ে বসে চা খাচ্ছে। হাসানের ছোট বোন আফরাহ। স্টুডেন্ট ভিসায় কিছুদিন আগে অস্ট্রেলিয়ায় এসেছে। হাসানের অনুরোধে আফরাহ নিয়ে এসেছে তাদের পারিবারিক অ্যালবামটি। যদিও স্মৃতিময় অ্যালবামটি এখন ডাইনিং টেবিলের ওপর আছে; তবুও এটি খুলতে গিয়ে হাসানের কেমন যেন ভয় করছে।

বাইরে ব্যাকইয়ার্ডে আবনাস আর তার ফুপি আফরাহের মধ্যে চলছে খুনসুটি। আফরাহর এই একতরফা গল্প শুনে হাসান আর সারা মনে মনে হাসে। এদিকে আবনাসও মা-বাবার চেয়ে তার ফুপিকেই বেশি আপন করে নিয়েছে। চার মাস বয়সী আবনাসকে নিয়ে আফরাহর সারা দিন মাখামাখি।

আজ হাসানের খুব ভালো লাগছে। এই ভালো লাগা সে ব্যক্ত করতে পারছে না। যদিও তাদের জীবনে এ ঘটনা নতুন কিছু নয়। তারপরও যেন দুজনের জীবনে এর চেয়ে নতুন কিছু নেই। অনেকবার বলা হয়ে গেছে। আজ হাসানের ইচ্ছে করছে আরও একবার বলতে।

তিন বছর আগের ঘটনা। হাসান কয়েক দিন ধরেই হাইড পার্কে এসে বসে থাকে। বিকেল তিনটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত চলে তার এই নিথর বসে থাকা।

একদিন বিকেল পাঁচটার দিকে হাসান হঠাৎ টের পায় কেউ একজন তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

হাসান চোখ তুলে তাকাতেই আগন্তুক বলে, তুমি হাসান?

: হ্যাঁ, তুমি সারা। অনেক দিন পর।

: হ্যাঁ, প্রায় এক বছর। কী করো এখানে প্রতিদিন?

: প্রতিদিন!

: হ্যাঁ, আজ নিয়ে চার দিন ধরে তোমাকে দেখছি। ভাইব হোটেলে চাকরি করি। মিউজিয়াম স্টেশন থেকে ট্রেন ধরি। তোমাকে দেখি এই একই জায়গায় বসে থাক।

হাসান বলে, যদি তাড়া না থাকে তো বস। এই ব্যস্ত শহরে অচেনা অজানায় আমাকে দেখে কাছে এসেছ। একটু বস না প্লিজ।

সারা হাতের ব্যাগটা পাশে রেখে বসেই বলে, যত দূর মনে পড়ে, সারাক্ষণ হাসিখুশি থাকতে তুমি। কী হয়েছে তোমার? মন খারাপ কেন?

: হ্যাঁ, তাই। মনের কষ্টটা চেপে রাখতেই হাসিখুশি থাকতে চেষ্টা করি। তবে এখন আর পারছি না যে।

: আহা, বলই না।

: বলব আর কী। ক্রিসমাসের ছুটিতে এক বন্ধুকে নিয়ে আমার বড় ভাই বেড়াতে যাচ্ছিলেন স্নো মাউন্টেনে। যাওয়ার পথে অ্যাকসিডেন্টে ভাই মারা গেছেন।

: বল কী?

: আমি সারাক্ষণ পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত। ভাই আমাকে কিছু করতে দিতেন না। সেমিস্টারের পর সেমিস্টার। কী করে যে দুটো বছর কেটে গেল টের পাইনি। তারপর ভাই আমাকে জোর করে একটা ট্রেড কোর্সে ভর্তি করে দেন। এখন আর কিচ্ছু ভালো লাগছে না। ভাবছি আমিই-বা কেন বেঁচে আছি। আসলে আমার বেঁচে থাকা একেবারেই অর্থহীন।

: ওহে, তোমার দেশ যেন কোথায় বলেছিলে...ইরানে, তাই না?

: হ্যাঁ, তাই।

: তোমার মা-বাবা আর ভাই-বোন কি ওখানেই?

: বাবা নেই। কলামিস্ট ছিলেন আমার বাবা। ব্লাসফেমির অভিযোগে তাঁর ফাঁসি হয়েছে। পাঁচ বছর আগে। তারপরই ভাই চলে আসেন এখানে। আমি তখন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা করছি। এদিকে ভাইও আমার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। শেষে ডিপ্লোমা কমপ্লিট করে চলে আসি। তেহরানে আমাদের বাড়ি আছে। ওখানে মা আর ছোট বোনটা আছে।

: দুটো মেয়ে মানুষ ওখানে। সঙ্গে কেউ নেই। ওনারা তো মনে হয় অনেক কষ্টে আছে।

: কষ্ট মানে, মা এলোমেলো কথা বলেন। আর বোনটাও কেমন যেন হয়ে গেছে। তেহরান ইউনিভার্সিটিতে আইআরএ পড়ে। খুবই মেধাবী। তবে কোনো ডিসিপ্লিন নেই। থাকবেই বা কী করে।

সারা হাসি চেপে মনে মনে বলে, ডিসিপ্লিন তো তোমারও নেই। তারপর বলে, এক কাজ করো, তাদের এখানে নিয়ে এসো।

নিজের অপারগতার এক মলিন ও করুণ হাসি চেপে হাসান বলে, একি সম্ভব! মায়ের শরীরও ভালো না। আর উনি এ দেশে আসবেনও না। ছোট বোন আসতে চাচ্ছে। ব্যাংক ব্যালেন্স, স্পনসর, টিউশন ফি—আমি পাব কোথায়। আর ভালো লাগে না। বাবার ওই পরিণতির কথা মনে হলে দেশে ফিরে যেতেও ভয় হয়। ওই বাস্তবতায় টিকব কী করে। সবকিছুতেই আমার এখন ভয় করে কেবল।

: এমন স্মার্ট একটা ছেলে তুমি। এই দেখ, সত্যি বলছি, চোখ ফেরাতে পারছি না।

: কী বলছ এসব!

: আচ্ছা বুঝতে পারছি। চল, বাসায় চল।

হাসান হঠাৎ মাথা ঝাড়া দিয়ে বলে, কী বললে, বাসায়! কোন বাসায়?

: সহজ কথাটা বুঝতে পারছ না কেন। তোমার বাসায় যাব আমি।

হাসান আকাশ থেকে পড়ল যেন।

সারা অতি সহজভাবেই বলে, তোমার বাসায় আর কে থাকে?

: কেউ না। আমি একা। বাসাটা ছেড়ে দেব ভাবছি। কোথাও সাবলেটে উঠব। বাসাটা যদিও বেশ সুন্দর লোকেশনে। গ্রাউন্ড ফ্লোর। ঘাস ছাওয়া ফ্রন্ট ইয়ার্ড। দুই রুমের এত বড় বাসা। খরচ অনেক। কাজটাজ কোনো কিছুই আর ভালো লাগে না যে।

: হ্যাঁ, বুঝতে পারছি। চল, এখন বাসায় চল।

সারা হাসানের বাসায় এলে ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই বাসার চেহারা একেবারেই বদলে যায়। শাওয়ার শেষে নিকটস্থ ইরানি রেস্টুরেন্টে অর্ডার দিলে পনেরো মিনিটেই খাবার চলে আসে।

: সারা, স্বপ্ন দেখছি না তো?

: নিশ্চয়ই না। তোমার এই হাসিমুখ দেখে ভালো লাগছে।

: হুম, ঠিক তাই। কত দিন হাসি না।

: আচ্ছা হাসান, তোমার কি মনে আছে একসাথে বসে অ্যাসাইনমেন্ট করতাম। অনেক হেল্প করতে আমাকে।

: অবশ্যই মনে পড়ে। এই তো সেদিনের কথা। তোমাকে দেখলেই মনটা কেমন করত। কী এক অচেনা তৃষ্ণায় বুকটা ব্যথা করে উঠত।

: তেহরানে থাকতে কাউকে ভালোবাসতে?

: না, বাবার ওই পরিণতি আমাদের সবার মনের সুস্থতা নষ্ট করে দিয়েছে।

সারা ইচ্ছে করেই ওই প্রসঙ্গ এড়িয়ে যায়। বলে, এই যে বললে আমাকে দেখলে কী এক তৃষ্ণায় বুকটা ব্যথা করত। ওই তৃষ্ণা কি এখনো আছে?

হাসান নীরব দৃষ্টিতে সারার দিকে চেয়ে থাকে।

সারা বলে, কনভোকেশনের পর থেকে তোমাকে আর দেখিনি। তোমাকে মনে মনে খুঁজেছি। তবে খুব জোরালোভাবে খুঁজিনি। কারণ, এত জোর আমার নেই। এখানে আমার মা-বাবা আছেন। গ্র্যান্ডভিলে বাসা।

: মা-বাবার সাথে আছ। তারপরও বলছ এত জোর নেই?

কিছুক্ষণ কী যেন ভেবে সারা বলে, আমি অ্যাশফিল্ডে থাকি।

: বল কী!

: আমার মা-বাবা লেবনিজ রিফিউজি থেকে এখানে স্থায়ী হন। অনেক কঠোর অনুশাসন মেনে চলেন তো। জীবনের চেয়েও কিছু বিশ্বাস তাঁদের কাছে অনেক বড়।

: হ্যাঁ, আর বলতে হবে না। বুঝতে পারছি। এসবের ভেতরেই বড় হয়েছি। আমার মা এমনই একজন। বাবা ছিলেন পুরোপুরি বিপরীত। আলী দাস্তির শিষ্য। কতগুলো সিংহের মাঝে একটা হরিণ বাঁচতে পারে না। এখানে কোনো দোষ-গুণ বা ভালো-মন্দের প্রশ্ন নয়। এটাই বাস্তবতা।

তোমার সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের দিন এমনই কিছু কথা বলেছিলে। মনে গাঁথা আছে। ‘আমার সত্যই আমার জীবনের সত্য। আমিই আমার গুরুত্ব। তাই আমি আমার জীবনকে সম্মান করি। আমার মাঝে যে সুন্দর আছে তার পরিচর্যা করেই বাঁচতে চাই।’

নীরব দৃষ্টি বিনিময়ের একপর্যায়ে হাসানের চোখে কী যেন ঝিলিক দিয়ে ওঠে। মনের অজান্তেই দুজনে বাহুবন্ধনে...। ক্রমে রাত আরও গভীর হয়ে আসে।

তারপর কেটে গেছে তিন বছর।

তাদের তেহরানের বাড়ির কাচের আলমারিতে ছিল অ্যালবামটি। আজন্ম পরিচিত এই অ্যালবামের প্রথমেই হাসানের মা-বাবার ছোটবেলার দুটো ছবি। চা শেষ করে হাসান অ্যালবামটি খুলে ছবি দুটো মন ভরে দেখে। ছোট বোন আফরাহ দেখতে হুবহু তার মায়ের মতো। আর এই চার মাস বয়সী আবনাস দেখতে ঠিক তার বাবার মতো। কিছুক্ষণ ছবি দুটো দেখে তার মনে হয়, দুঃখ-শোক-বিরহ এসব কিছুই না। মানুষের মাঝেই বিরাজ করে মানুষ। তেহরানের ওই বেহেশত-ই-জাহরা সমাধির আস্তরণ ভেদ করে তার মা-বাবাও যেন আজ এই আফরাহ আর আবনাসের খেলা দেখছেন। নীরব হাসিতে শুনছেন তাদের একতরফা গল্প।

হঠাৎ করেই আফরাহ উচ্চস্বরে বলে, ভাবি, একটু শুনে যাও তো।

সারা বাইরে যেতেই আফরাহ স্বর নামিয়ে সারার কানের কাছে বলে, ভাবি, ওই যে বলছিলাম। ইউনিভার্সিটিতে দেখা হয়েছিল। সে আসছে। দেখ, ওখানে দাঁড়িয়ে আছে। তুমি গিয়ে ওকে ডেকে নিয়ে এসো। খুবই লাজুক।

হতবিহ্বল সারা কোমল হাসিতে আফরাহর উজ্জ্বল দুটি চোখে চেয়েই থাকে কেবল। এদিকে হাসান হাসি আড়াল করে আফরাহ আর সারার এই লুকোচুরি দেখেও না দেখার ভান করে।
...

ইসহাক হাফিজ: সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।
ইমেইল: <[email protected]>, ফেসবুক: <Ishaque Hafiz>