নীল অপরাজিতা

নীল ফুল। সংগৃহীত
নীল ফুল। সংগৃহীত

কী আশ্চর্য এত বড় সাহস! টুম্পা বিরক্ত মুখে ঘড়ি দেখছে। সে এসে বসে আছে অস্টিনের এক স্টেক হাউসে। আর অর্ণব নামে ভদ্রলোকের কোনো খবর নেই? আর দশ মিনিট দেখে এখুনি বাসায় ফোন দিয়ে মাকে মানা করে দেবে। এমনিতেও মানা করত, কিন্তু এখন কাজটা আরও সহজ হয়ে গেল।
এমন সময় একজন বাঙালি ছেলে এসে ঢুকল। হাতে একটা নীল ফুলের তোড়া। বেশ হেলে দুলে হাঁটে।
—সরি, দেরি হয়ে গেল।
ছেলের চেহারা খারাপ না। টুম্পা বিরক্ত মুখে বেশ অভদ্রভাবেই শুরু করল—আমি আসলে বেশিক্ষণ বসব না। আম্মু খুব বিরক্ত করে, তাই এসেছি। আপনি প্লিজ বাসায় গিয়ে বলবেন আমাকে আপনার পছন্দ না।
এবার অর্ণবের বেশ মেজাজ খারাপ হলো। যদিও জানত সে একটু ভিন্ন ধরনের মেয়ের সঙ্গেই দেখা করতে এসেছে। মেয়ে একা একা দেশের বাইরে পড়াশোনা শেষ করে চাকরিতে ঢুকেছে। সাহস আর স্মার্টনেস আছে। অর্ণবের মা ছেলেকে বিয়ে করানোর জন্য অস্থির। গ্রিন কার্ডের এমন অবস্থা, দেশে যাওয়া সম্ভব নয়। দুই পরিবারের কথা হয়েছে। অর্ণব পেশায় ডাক্তার। সব মিলিয়ে মায়ের গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে সে বিয়ের কন্যা দেখতে এসেছে। কিন্তু মেয়ে তো মনে হচ্ছে ঝালমরিচ। যদিও তার মায়ের ডেটাবেইস মোতাবেক মেয়ে অতি শান্ত, সাত–পাঁচে নাই টাইপ।

অর্ণব কৌতুক করে বলল, আপনি এমনভাবে অনুরোধ করছেন যে, আমি আপনাকে বলেছি আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে। নাটকীয়তার দরকার নাই। আমরা অ্যাডাল্ট। একসঙ্গে বসে ডিনার খাব। কথা বলব। কেউ আমাদের বিয়ে করতে জোর করবে না।
ঝাড়ি খেয়ে মনে হলো কাজ হলো। মেয়ে হাত বাড়িয়ে ফুলের তোড়াটা স্পর্শ করল। তারপর বলল—ফুলগুলো সুন্দর!
যথানিয়মে ভাবগাম্ভীর্য বজায় রেখে খাওয়া দাওয়া শুরু হলো। এতক্ষণে অর্ণব টুম্পাকে একটু খেয়াল করার সময় পেল। সবার আগে চোখের ভারী কালো মোটা ফ্রেমের চশমাটা দেখা যাচ্ছে। এই যুগে এই চশমাগুলো ফ্যাশন। এতে চেহারায় একটা আঁতেল ভাব আসে আর জোর করে কিছু রূপ কমিয়ে দেওয়া যায়। চব্বিশ বছর বয়সের একটি মেয়ে জীবনে এখনো অনেক কিছু দেখেনি। তাই একরোখা জিদ্দি ভাব থাকবেই। এই পর্যন্ত তাকে ভদ্রতা করে হাসতে দেখা গেল না। গাল ফুলিয়ে আছে আর গালটা এমনিতেও একটু ফোলা ফোলা। নাকটা বোঁচা। মিষ্টি কিঞ্চিৎ চৈনিক মুখাবয়ব। অর্ণবের মনে হলো, একে খুব সহজে রাগানো যাবে। সে একটু মজা করার চেষ্টা চালাল।
—তা বিয়ে না করার এই সিদ্ধান্তের হেতু কি?
মেয়ে এবার মুখ তুলল। আমার একা থাকতে ভালো লাগে। আমার ওপর দিয়ে কেউ মাতব্বরি করলে আমি ঠিক টলারেট করতে পারি না। আমাকে বাসায় কখনো কোনো কিছু ঠিক শেয়ার করতে হয়নি।
—হুম। তোমার কোনো বন্ধু নেই?
টুম্পা ঠোঁট উল্টে উত্তর দিল, ওমা বন্ধু থাকবে না কেন? অনেক বন্ধু আছে। কিন্তু আমার নিজস্ব স্পেস জরুরি। বিয়ে একটা ফেইল্ড সামাজিক প্রথা। দুই–তিন জেনারেশন পর এমনিতেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
অর্ণব মনে মনে বলে বেশ ইন্টারেস্টিং মেয়ে।
—তাহলে তুমি লিভিং টুগেদারে বিশ্বাসী?
নাহ, আমি আমার বাসায় কোনো লোককে থাকতে দেব না।
অর্ণব ভেবে পাচ্ছে না, তার মা এই উদ্ভট মেয়েকে কোত্থেকে জোগাড় করল।
—এক সময় যদি লোনলি লাগে তখন কি করবে?
আমার বিড়াল আছে। তা ছাড়া বাচ্চা অ্যাডপ্ট করা যায়। সুস্মিতা সেন করেছে। নিকোল কিডম্যান করেছিল, অ্যাঞ্জেলিনা করেছে।
অর্ণব এরপর চুপচাপ খেয়েদেয়ে চলেই এসেছিল। কিন্তু কেন যেন অপরিণত আর ফোলা গালের পাগলি মেয়েটাকে তার ভালো লেগেছিল। একে জয় করার চ্যালেঞ্জ আছে। কিন্তু সব শুনে অর্ণবের মা বেঁকে বসলেন।
—বাবা কোনো দরকার নেই। পাগল ছাগল মনে হচ্ছে।
এরপর তিন বছর কোনো খোঁজ ছিল না।
মা অনেক মেয়ে দেখাল। কেন যেন অর্ণবের আর কাউকেই ভালো লাগেনি। সে হসপিটালে অনকোলজিস্ট হিসেবে জয়েন করল।

দুই.
পেশেন্টকে দেখে অর্ণব একটু চমকে উঠল। সে অনকোলজিস্ট। ব্রেস্ট ক্যানসার নিয়েই কাজ করে। এই মেয়েকে ডাক্তার বলে দিয়েছেন, তার স্টেজ টু ক্যানসার।
আমি আপনাকে চিনতে পেরেছি।
—আমিও।
আমাকে সত্যি করে বলেন কত দিন বাঁচব? আমার তো কত প্ল্যান ছিল জীবন নিয়ে।
—ভালো হয়ে যাবে। আজকাল সারভাইভাল রেট অনেক ভালো। তা ছাড়া তুমি ইয়াং, এনার্জেটিক।
তারপর প্রায়ই রিপোর্ট নিয়ে অর্ণব যোগাযোগ করত।
মেয়েটার মনের জোর অতটা নয়, যতটা প্রথম দেখায় মনে হয়েছিল। মৃত্যু ভয় মানুষকে অসহায় করে তোলে। কেমোথেরাপির পর সে বেশ কাহিল হয়ে গেল। মাথায় একটা ক্যাপ পড়ত। একটা পরচুলাও ব্যবহার করত।
একদিন হেসে বলেছিল, আচ্ছা আমার সঙ্গে আপনার বিয়ে হলে কেমন হতো? আমার জন্য কেউ অন্তত কাঁদত। আমার স্বামী আমার কবরটা দেখতে যেত একগুচ্ছ নীল ফুল নিয়ে। আমার না এ রকম ভাবতে বেশ রোমান্টিক লাগে। কিংবা আমি ওপারে কারও জন্য অপেক্ষা করছি। এ রকম ভাবতেও ভালো লাগে। আমি অনেক নিয়ার ডেথ এক্সপেরিয়েন্সের কাহিনি পড়েছি। নিজের পরিচিত মৃত মানুষকে টানেলের মতো একটা জায়গার শেষে গিয়ে দেখতে পায় মানুষ। আমি ওরকম একটা টানেলের শেষে অপেক্ষা করে আছি আর আমার জন্য কেউ আসছে, ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং।
অর্ণব একটা সর্বনাশের ছায়া দেখে। সে বলে, ধুর কিছু হবে না তোমার। এই সমস্ত বাজে জিনিস পড়বে না।
মেডিকেল স্ট্যাটেসটিকসকে ভুল প্রমাণ করে ক্যানসার ছড়িয়ে গেল। টুম্পাকে বাঁচানো গেল না।
মৃত্যুর খবর হাসপাতাল থেকে তাকে জানিয়েছিল। কতটুকু দুঃখ পাওয়া উচিত সে জানে না। কিন্তু সে ডেডবডি দেশে নেওয়ার আগে দেখতে যায়নি।

তিন.
অর্ণবের বিয়ে হয়েছে পাঁচ বছর। দুটো ফুটফুটে মেয়ে তার। বহুদিন দেশে যাওয়া হয় না। বিয়েও আমেরিকাতেই হলো। বউ মিতু লক্ষ্মী মেয়ে। আহ্লাদী মাঝে মাঝে বলে, এই আমি মরে গেলে কিন্তু আর বিয়ে করবে না।
—আর আমি যদি আগে মরে যাই?
খবরদার ওই পার গিয়ে হুরের দিকে তাকাবে না।
অর্ণব হেসে বলে, হায় হায় আমার দেখি জনম জনম এই আহ্লাদীর সঙ্গেই পার করতে হবে।
তবে মিতুর কোনো সামান্য অসুখ বিসুখে সে উতলা হয়ে যায়। তখন আর তাকে ডাক্তার মনে হয় না। যেন কাউকে আর হারাতে চায় না।
কেন যেন টুম্পার কথা মিতুকে সে বলতে পারেনি। খণ্ড খণ্ড টুকরো স্মৃতির অপূর্ণ এক সম্পর্ক সমন্ধে কী বা বলা যায়? খুব যে ওই পাগলি মেয়ের কথা মনে পড়ে, তাও না। মাঝে মাঝে আকাশ কালো করা বৃষ্টির দিনে হঠাৎ হয়তো একটা গান শুনে বুক হাহাকার করে ওঠে,

‘আমি ওপার হয়ে বসে আছি,
ওগো দয়াময়,
পারে লয়ে যাও আমায়।’

এপ্রিল মাসের কোনো একসময় গাড়ি চালাতে চালাতে হঠাৎ চোখ আটকে যায় ব্লু বনেট নামক ঘাস ফুলে। ওই সময় অস্টিনে পুরো সবুজ ঘাস জুড়ে নীল ফুলের উদ্যান। চমকে উঠে মনে হয় কী যেন করা হয়নি জীবনে।
তার পরের বছর, সে যখন দেশে গেল কাউকে কিছু না বলেই বনানী কবরস্থানে এল। কিছুক্ষণ এলোমেলো হেঁটেছে। একসময় গেটে নাম দিতে তারা কবরটা দেখিয়ে দিল। একগুচ্ছ নীল ফুল সেখানে দেওয়া তার অতি জরুরি ছিল।

*ইশরাত মাহেরীন জয়া, ডালাস, টেক্সাস, যুক্তরাষ্ট্র।