মাধবীলতা ও ভালোবাসার রং

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

মাধবীলতার সঙ্গে কখন আমার দেখা হয়েছিল তার দিনক্ষণ ঠিক মনে নেই। তবে এটুকু মনে পড়ে প্রথম দেখাতেই মাধবীলতাকে আমি ভালোবেসে ছিলাম। কী যে চাপা রূপ ছিল তার। তখন আমার রঙিন কৈশোর। ঘর বুঝি না, সংসার বুঝি না, আমি বুঝি তখন শুধু রঙিন এক পৃথিবী। কত দিন দুর থেকে দেখেছি, কত দিন কাছ থেকে দেখেছি মাধবীলতাকে। কী যে স্নিগ্ধতা তার, কতবার ফিরে ফিরে দেখেছি মাধবীলতাকে, কে রেখেছে তার হিসাব।

তখন সবেমাত্র স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে পা রেখেছি। কলেজের খুব সঙ্গেই আমার এক বান্ধবীর বাসা ছিল। যেদিন খুব সকালে কলেজে পৌঁছাতাম তার বাসায় চলে যেতাম। সেখানেই প্রথম দেখা পাই মাধবীলতার। আমি তাকে জিজ্ঞেস করি কী নাম রে ফুলগুলোর। সে বলে মাধবীলতা।

আমি চমকে উঠি নামটার সৌন্দর্যে। মনে মনে বললাম, সৃষ্টিকর্তা যদি কখনো আমার ঘরে সন্তান সৃষ্টি করেন, তার কেউ একজন যেন মাধবীলতা হয়। সৃষ্টিকর্তার বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই, তিনি আমাকে মাধবীলতা দেননি, দিয়েছেন অপূর্ব-সুবর্ণ। তবু মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে হয় মন ভরে কাউকে সারা দিন মাধবীলতা ডাকি।

এরপর অনেক বেলা বয়ে যায়। ছোট্ট অপূর্বকে একটা স্কুলে ভর্তি করালাম। তাকে ক্লাসে পাঠিয়ে মাঝে মাঝে খোলা মাঠের এককোণে আমি চুপচাপ বসে থাকতাম। আড়চোখে দেখতাম আরেকজনও ঠিক একই ভাবে বসে আছে। তার মেয়েও আমার ছেলের সঙ্গে একই ক্লাসে। মাঝে মাঝে তার সঙ্গে টুকটাক কথা হয়। এ কথা সে কথা বলতে বলতে একসময় তার সঙ্গে কিছুটা সখ্যও গড়ে উঠল। ফুলের নামে তার নাম ছিল, কিন্তু আমি তাকে দুষ্টামি করে বলতাম, তুমি তো মাধবীলতা। কোনো আপত্তি করত না শুধু একটু হাসত।

লেখিকা
লেখিকা

সে জানত আমি আইন বিষয়ে পড়াশোনা করছি এবং আমেরিকায় যাওয়ার ভিসা প্রসেসিং চলছে। কারণ আমার বর সেখানেই পড়াশোনা করছে। মাঝে মাঝে জানতে চাইত আমি কবে যাব। একদিন আমি প্রশ্ন করে বসলাম, কেন সব সময় এ কথা জানতে চায় সে? দেখলাম সে কেমন ঝরে পড়া মাধবীর মতো মলিন হয়ে গেল। অনেকটা আমার চাপাচাপিতে সেদিন সে যা বলেছিল তার সারাংশ ছিল—তার বরকে সে অনেক ভালোবাসে। কোনো দিন তাকে ছাড়া থাকবে এ কথা সে কল্পনাও করতে পারে না। তার মেয়েটাও বাবা ছাড়া কিছুই বোঝে না। কিন্তু কিছুদিন আগে সে জানতে পারে তার বর দুই মাস আগে তারই কলিগকে বিয়ে করেছে এবং এবার ভালোবাসা দিবসে তার বর তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে মাধবী আর তার মেয়ের সঙ্গে দেখা করিয়ে দিতে চায়। সব ভালোবাসা দিবসে তার বর নাকি তাদের বিয়ের যতগুলো বছর পার হয়েছে ততগুলো গোলাপ আর মোমবাতি নিয়ে আসে। তার সঙ্গে এমন কোনো আয়োজন থাকে যাতে মাধবী চমকে যায়। তাই এবারও সে ভাবছিল হয়তো প্রতিবছরর মতো এবারও তার বর তাকে একইভাবে অবাক করা কোনো কিছু করবে।

সব শোনার পর আমি যেন পাথর বনে গেলাম। কী বলা উচিত তাও বুঝতে পারছিলাম না। বললাম তার ফ্যামিলিকে জানাতে। তখন সে বলল তাদের ভালোবাসার বিয়ে। ছয় বৎসর আগে এক ভালোবাসা দিবসে সে তার হাত ধরে বাবার বাড়ি থেকে পালিয়েছিল। তাই নিজেকে সে বাবার বাড়িতে ছোট করতে পারবে না। সে আমার কাছে জানতে চাইল আমি তাকে কোনো আইনি সহায়তার পথ বলতে পারব কিনা। আমি বললাম, হ্যাঁ তুমি তাকে ডিভোর্স করতে পার। সে এবার ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। সে বলে, তার চোখ থেকে তো এখনো বাসর রাতের স্মৃতি একটুও ম্লান হয়নি। জীবনে কখনো তাকে ছাড়া সে থাকবে এটা তার ভাবনারও বাইরে। বরং সে তার বরের দ্বিতীয় স্ত্রীকে শাস্তি দিতে চায় এবং সে যাতে তাদের জীবন থেকে সরে যায়, তাই সে চাচ্ছে।

আমি বড় আশ্চর্য এতখানি যে মেয়েটা তার বরকে ভালোবাসতে পারে, সে বর কীসের আশায় অন্য সুখ খুঁজতে যায়। একজীবনে কয়জনকেই এক আসনে বসানো যায়? কী ছোট্ট একটা জীবন আমাদের। দুজন মানুষ যখনই বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনে নিজেদের আবদ্ধ করে তখনইতো মন থেকে সব অপবিত্রতা ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে ফেলা উচিত। তাহলে কোনো এক ভালোবাসা দিবসে এসে মাধবীলতাগুলো আর তাদের রং হারায় না। ভালোবাসা তখন তীরে ফেলা নোঙর হয়ে জীবনকে মাধবীলতা হয়ে জড়িয়ে রাখে।