বঙ্গবন্ধুর ছায়ায় এক বিকেল

বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের পাশে লেখকের মেয়ে তাহিয়া
বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের পাশে লেখকের মেয়ে তাহিয়া

আপনি যে দেশেই যান না কেন, সেই দেশের সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ ধারণ করার পাশাপাশি শেকড়ের সন্ধান করাও জরুরি। তাহলেই আপনি বৈশ্বিক নাগরিক হয়ে উঠবেন। আর বর্তমানের দুনিয়ায় দেশপ্রেম ও মূল্যবোধ, এগুলো আর ভৌগোলিক সীমারেখার গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বরং বিশ্বমানবতার কল্যাণই এখন সবার কাম্য। এমন ধ্যান ধারণা নিয়ে যাতে প্রবাসী পরবর্তী প্রজন্ম বেড়ে উঠতে পারে তাই অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় দিবসগুলোর পাশাপাশি বাংলাদেশের জাতীয় দিবস ও জাতীয় নেতাদের সঙ্গে তাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়াটা আমাদের সকলেরই কর্তব্য। তাই যখন জানতে পারলাম, সিডনির বুকে বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে, তখন থেকেই মনের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা কাজ করছিল, কবে তাঁকে দেখতে যাব।

দেশে থাকতে মনে সাহস জোগাড় করতে না পারার কারণে ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরের সামনের রাস্তা দিয়ে অনেকবার গেলেও ভেতরে ঢোকার সাহস করিনি। কারণ, ভয়াল ১৫ আগস্টের নিদর্শন আমাকে মানসিকভাবে খুবই আঘাত করত এবং সেই ক্ষত সারতে অনেক দিন লেগে যেত।

আমি আমার মেয়ে তাহিয়াকে একদিন বললাম, সিডনিতে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য আছে, আমরা দেখতে যাব। সে একবাক্যে রাজি হলো এবং বলল, বাবা উনিতো আমাদের ফাদার অব দ্য নেশন। আমি বললাম, হ্যাঁ, তিনি আমাদের জাতির পিতা। ওনার নেতৃত্বেই আমরা স্বাধীন সার্বভৌম একটা দেশ পেয়েছিলাম। আমার কথা শুনে তাহিয়া বিজ্ঞের মতো ঘাড় নেড়ে সায় দিল।

ক্যাম্পাসে রাস্তার দুই পাশে গাছ
ক্যাম্পাসে রাস্তার দুই পাশে গাছ

আমরা সিডনি আসার পর দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই আমি তাহিয়াকে এখানকার কমিউনিটি বাংলা স্কুলে নিয়ে যাই। সেখানে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চার পাশাপাশি বাংলাদেশের জাতীয় দিবসগুলো যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করা হয়। পাশাপাশি বাসাতেও আমরা বাংলায় কথা বলি। যদিও ওর স্কুলের ভাষা ইংরেজি। ইদানীং ব্যাপারটা এমন হয়েছে, তাহিয়াকে কোনো কিছু বোঝাতে গিয়ে যদি ইংরেজিতে বলি, সে বলে বাবা বাংলায় বল। তাহিয়ার আঁকার হাত ভালো। ইতিমধ্যে সে বাংলা স্কুল থেকে পুরস্কারও পেয়েছে। তাই শিক্ষিকারা ওকে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের পোর্ট্রেট আঁকতে দিয়েছে। সেগুলো সে পরম মমতা নিয়ে এঁকেছে। এরপর আমাকে বলেছে, বাবা পরেরবার আমি শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি আঁকব। আমি বললাম তাহলেতো খুবই ভালো হয়।

এর মধ্যেই স্কুল হলিডে শুরু হয়ে গেল। আমারও অফিস ছুটি। তাই অখণ্ড অবসর। তখনই পরিকল্পনা করে ফেললাম বঙ্গবন্ধুকে দেখতে যাওয়ার। ওয়েস্টার্ন সিডনি ইউনিভার্সিটিতে (প্যারামাটা ক্যাম্পাসে) আমার একসময়ের ছাত্রী রেহানা পড়ে। ওকে আগে থেকেই জানিয়ে রাখলাম। কারণ শহরে গেলে পার্কিং নিয়ে আমি মহা ঝামেলায় পড়ি। অবশেষে ২ জানুয়ারি (২০১৯) সকালবেলা আমরা তৈরি হয়ে ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে রেহানার ডরমিটরিতে পৌঁছে গেলাম। সে আগে থেকে তৈরিই ছিল। আমরা ওর ডরমিটরির পাশেই গাড়ি পার্ক করে একটু হালকা নাশতা করে নিলাম। তারপর রেহানা আমাদের পথে দেখিয়ে নিয়ে চলল। রেহেনার ডরমিটরিটি উত্তর ক্যাম্পাসে আর বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য দক্ষিণ ক্যাম্পাসে তাই বেশ কিছুটা পায়ে হাঁটা পথ।

আমি ছেলে রায়ানকে কাঁধে নিয়ে নিলাম। তাহিয়া আর রেহানা গল্প করতে করতে আমাদের সামনে থেকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। ফুটপাত দিয়ে হাঁটার পর একটা জায়গায় গিয়ে রাস্তা পার হতে হয়। ওখানে রাস্তাটা গাছগাছালির মধ্যে দিয়ে গেছে। সেখান দিয়ে যাওয়ার সময়ই মনটা শান্ত হয়ে গেল। আমি আসলে মনে মনে তৈরি হচ্ছিলাম বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সামনাসামনি দাঁড়াবার জন্য। উঁচু পথ পার হয়ে নিচে নেমেই মনটা ভালো হয়ে গেল। একটা ছায়া সুশীতল রাস্তা দুই পাশের গাছের ডাল বেড়ে উঠে রাস্তাটাকে প্রায় ঢেকে দিয়েছে। এরপর আরও কিছুক্ষণ হাঁটার পর দক্ষিণ ক্যাম্পাস। তার মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম আর রেহানাকে আমরা বারবার জিজ্ঞেস করছিলাম, আর কত দূর? অবশেষে আন্তর্জাতিক সমুদ্র শাসন কেন্দ্রের ভবনের সামনে তাঁকে দেখতে পেলাম। নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে আছেন বঙ্গবন্ধু।

ছেলে ও মেয়েসহ লেখক
ছেলে ও মেয়েসহ লেখক

তাঁকে সামনাসামনি দেখার পর মনের মধ্যে এক ধরনের অদ্ভুত অনুভূতি খেলা করছিল। যেটা একই সঙ্গে বিস্ময় ও আনন্দ আবার শোকেরও। তাহিয়া একে একে বিভিন্ন প্রশ্ন করে যাচ্ছিল। রেহানাই তার উত্তর দিচ্ছিল। আমি কিছুক্ষণের জন্য অন্য জগতে হারিয়ে গিয়েছিলাম। দুই চোখে ঝাপসা দেখা শুরু করলাম। তারপরই সংবিৎ ফিরে পেয়ে রেহানাকে বললাম তাঁর সঙ্গে আমাদের ছবি তুলে দিতে। আমি আর তাহিয়া তৈরিই ছিলাম কিন্তু রায়ান খোলা জায়গা পেয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছিল। ওকেও ধরে আনা হলো। ছবি তোলার সময় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে পড়া কত স্মৃতি ভিড় করছিল মনে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে তাঁর সাধারণ জীবনযাপনের প্রণালি কেন জানি বারবার মনে পড়ছিল। একবার ‘সাপ্তাহিক’ পত্রিকায় একটা লেখা পড়েছিলাম। লেখকের ছোট বয়সে তার বাবা তাকে আর ছোট ভাইকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। ওই দিন কোনো একটা অনুষ্ঠান চলছিল। বঙ্গবন্ধু লেখকের ছোট ভাইকে তাঁর কোলে নিয়ে নিয়েছিলেন। তাঁরা যতক্ষণ ওখানে ছিলেন তার ছোট ভাই বঙ্গবন্ধুর কোলেই ছিলেন। এই ঘটনা ওনার শিশুমনে দাগ কেটেছিল, তাই উনি মনে রেখেছেন।

আমারও বারবার মনে হচ্ছিল বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে হয়তো রায়ানকে কোলে নিয়ে বলতেন, এ যে দেখি বাংলাদেশের দামাল ছেলে, সারাক্ষণ দৌড়ে বেড়ায়। এমনই আরও হাজারো কল্পনা মনের মধ্যে খেলা করছিল। ছবি তোলা শেষ করে আমরা পাশেই ক্যানটিনে কিছুক্ষণ বসলাম। বন্ধের সময় তাই ক্যানটিন বন্ধ। আমরা ফাঁকা চেয়ারগুলোতে বসলাম। সেখানেও তাহিয়া বিভিন্ন রকম প্রশ্নবাণে আমাদের জর্জরিত করছিল। ওখানে বসে আমি মনে মনে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ দিলাম। সাত সমুদ্র তেরো নদীর এই পাড়ের মানুষও এখন যেকোনো সময় চাইলে তাঁর দর্শন পেতে পারেন, যেমন তিনি ছিলেন সবার মুজিব ভাই।

অস্ট্রেলিয়াতে বসবাসরত বাংলাদেশিরাও যেকোনো সময় চলে যেতে পারেন ওয়েস্টার্ন সিডনি ইউনিভার্সিটির প্যারামাটা দক্ষিণ ক্যাম্পাসে। সেখানে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ ভাস্কর্য। আর ক্যাম্পাসটাও অনেক সুন্দর। চারদিকে ছায়াঢাকা সুশীতল রাস্তাঘাট। আপনার মনকে নিমেষেই শান্ত করে দেবে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ইতিহাস থেকে তাঁর নাম মুছে ফেলার যত বেশি চেষ্টা হয়েছে ততই তিনি বাংলাদেশিদের মননে স্থান করে নিয়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারের দেশ অস্ট্রেলিয়াতেও বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ ভাস্কর্য স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে।

ফেরার সময় বারবার মনের মধ্যে বেজে চলছিল—‘যত দিন রবে পদ্মা, মেঘনা, গঙ্গা, যমুনা বহমান/ তত দিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।’