তিনটি মৃত্যু ও একটি জীবনযুদ্ধের গল্প

হাসপাতালের বিছানায় নাজমুল আহসান খান
হাসপাতালের বিছানায় নাজমুল আহসান খান

পরিজান বিবির ছোট ছেলের ঘরের প্রথম নাতির চেহারা দেখতে যেমন সুন্দর ঠিক তেমনি দুধে আলতা গায়ের রং। তিনি শখ করে নাতির নাম রেখেছিলেন ‘নুর ইসলাম’। সত্যিকার অর্থেই নুর ইসলামের গা দিয়ে যেন জ্যোতি ঠিকরে বের হয়। শিশু নুর ইসলাম সারাক্ষণই তার বড় আব্বার (বাবার বড় ভাই) বড় ছেলে হাসানের কোলে চড়ে ঘুরে বেড়ায়। রাতে ঘুমানো ছাড়া প্রায় সব সময়ই সে তার ভাই হাসানের কোলে কোলে ঘোরে।

নুর ইসলামের বয়স যখন এক বছর তখন তাদের এলাকায় বন্যা হয়েছিল। তার বয়স এক বছর হলেও শরীরের গঠন দেখলে মনে হতো এই ছেলের বয়স দেড় বা দুই বছর। যা হোক, বন্যার পানি নেমে যেতে শুরু করলে চারদিকে পানিবাহিত বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব শুরু হয়। এ সময় নুর ইসলাম কলেরায় আক্রান্ত হয়। ওই সময় নুর ইসলামের বাবার আরেক ভাই (মেজো চাচা) সবে এলএমএএফপি প্রশিক্ষণ নিয়ে গ্রামে ফিরে এসে প্র্যাকটিস শুরু করেছেন। তিনি কিছুটা হাত যশও অর্জন করেছেন। নুর ইসলামের চিকিৎসা শুরু হলো তার মেজো চাচার হাতেই।

কিন্তু কথায় আছে, যারে কলেরা ধরে তার আর রক্ষা নাই। নুর ইসলামের শরীর দিনে দিনে ভেঙে পড়তে থাকল। তাদের বাড়ি পদ্মার চরে। গ্রামের নাম চর ভবানীপুর। এলাকাটা কুষ্টিয়ার অন্তর্গত। কিন্তু গ্রামের লোকজনের সমস্ত কার্যক্রম পাবনা কেন্দ্রিক। কারণ কুষ্টিয়া শহরে যেতে হলে প্রমত্তা পদ্মা আর তার শাখা নদী গড়াই পাড়ি দিতে হয়। আর পাবনায় পায়ে হেঁটে বা গরুর গাড়ি করেই যাওয়া যায়।

মেজো চাচার চিকিৎসায় নুর ইসলামের কোনো উন্নতি হচ্ছিল না। ওষুধের ডোজ বাড়িয়েও কাজ হলো না। নুর ইসলামের অবস্থা একদিন চরম অবনতি হয়ে পড়ল। হাসানের এখনো পরিষ্কার মনে আছে সেই দিনের সব ঘটনা। পরিজান বিবি পরম মমতায় আদরের নাতি নুর ইসলামকে কোলে নিয়ে বসে আছেন। মেজো চাচা একের পর এক ওষুধ দিয়ে যাচ্ছেন। নুর ইসলাম তারস্বরে চিৎকার করে চলেছে। পাড়ার সব মানুষ জড়ো হয়েছে মাতুব্বর বাড়িতে। সবাই নানা কথা বলাবলি করছে। আস্তে আস্তে নুর ইসলামের কণ্ঠস্বর নিস্তেজ হয়ে আসতে থাকে। মেজো চাচা সর্বশেষ চেষ্টা হিসেবে ইনজেকশনটা দিলেন। কিন্তু সেটা আর নুর ইসলামের শরীর গ্রহণ করল না। পরিজান বিবি চিৎকার করে বলে উঠলেন, তোরা আর ওকে কষ্ট দিস নারে। তার কোলেই নুর ইসলাম মৃত্যুর কোলে ফলে পড়ে। হাসান ছোটবেলার এই স্মৃতি এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে। তার বারবারেই মনে হয় মানুষ মৃত্যুর কাছে কতটা অসহায়?

দুই.

হাসানের সঙ্গে একই অফিসে চাকরি করত আরেফিন নামে একজন। তারা একে অপরকে সম্বোধন করত ভাই বলে। হাসানের বাড়ি কুষ্টিয়ায় আর আরেফিনের বাড়ি পাবনায়। মন-মানসিকতায় দুজনের বেশ মিল থাকলেও তাদের একসঙ্গে খুব বেশি কাজ করার সুযোগ হয়নি। তারপরও যেটুকু সুযোগ হয়েছিল সেটুকুতে ছিল অনেক বেশি আন্তরিকতা আর মজা।

সপ্তাহের শুরুতে তারা দুজন অফিসের কাজে ঢাকার বাইরে যেত। আবার সপ্তাহান্তে ঢাকায় ফিরে আসত। আরেফিনের কাজ সাধারণত রাজশাহী কেন্দ্রিক আর হাসানের সারা বাংলাদেশব্যাপী। একবার হাসানের কাজ পড়ল কুষ্টিয়াতে। কাজ শেষে সেখান থেকে হাসান পাবনা হয়ে ঢাকা ফিরছিল। এমন সময় অফিস থেকে তার মোবাইলে ফোন—আরেফিন অ্যাক্সিডেন্ট করেছে সিরাজগঞ্জে। তাড়াতাড়ি সিরাজগঞ্জ হাসপাতালে যাও। সেখানে তাকে ভর্তি করা হয়েছে।

খবরটা শুনে হাসানের বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। আগের সপ্তাহেই ঠাকুরগাঁও গিয়ে আরেফিনের সঙ্গে খুনসুটি করেছে সে। হাসান গাড়িচালককে বলল সিরাজগঞ্জ যেতে। হাসানের এখনো পরিষ্কার মনে আছে হাসপাতালের বিছানায় আরেফিনের শুয়ে থাকার দৃশ্য। কেউ না বলে দিলে মনে হবে একজন সুস্থ মানুষ ঘুমাচ্ছেন। কিন্তু কে বলবে এই মানুষটা আজরাইলের সঙ্গে এক বিশাল যুদ্ধ একাই চালিয়ে যাচ্ছে। শুধু বুকটা উঠানামা করছে। আরেফিনের পরিবারের লোকজন তখনো পৌঁছাননি। চিকিৎসকেরা হাসানকে জানালেন আরেফিনের মাথায় আঘাত বেশি। তার ব্রেইন সার্জারি করাতে হবে। পরিবারের সদস্যরা আসার পর যখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। আরেফিন মারা যান। হাসানকে এখনো তাড়া করে ফেরে হাসপাতালের বেডে আরেফিনের সেই শুয়ে থাকার সেই দৃশ্য।

বাংলা স্কুলের একটি অনুষ্ঠানে নাজমুল আহসান খান
বাংলা স্কুলের একটি অনুষ্ঠানে নাজমুল আহসান খান

তিন.

মিনহাজ ভাইয়ের সঙ্গে একই হোস্টেলে থাকলেও তার সঙ্গে পরিচয় ছিল না হাসানের। পরিচয় হলো একই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে গিয়ে। মিনহাজ ভাই ছিলেন হাসানের রিপোর্টিং বস। অবশ্য তার ওপরে একজন বস ছিলেন। কিন্তু হাসানকে রিপোর্ট করতে হতো তার কাছেই। হাসানের কাজকর্ম দেখে মিনহাজ ভাই তার একটা জুতসই নাম দিয়ে দিলেন—ভোদাই। একসময় ব্যাপারটা এমন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াল, মিনহাজ ভাই হাসানকে আর নাম ধরে ডাকেন না। ডাকেন ভোদাই বলে। হাসানের কাছেও ব্যাপারটা এমন দাঁড়াল যে, সে তার আসল নামের ডাক শুনলে ভুল করে। কিন্তু ভোদাই ডাক শুনলে দ্রুত রেসপন্স করতে শুরু করল।

মিনহাজ ভাই উচ্চশিক্ষার জন্য একসময় আমেরিকায় পাড়ি জমান। হাসান তখন একেবারে অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে। মিনহাজ ভাই মনে হয় সেটা টের পেয়েছিলেন। তিনি প্রায় প্রতি সপ্তাহেই ফোন দিয়ে হাসানের সঙ্গে আলাপ করতেন। সেটা একেবারে রুটিনের মতো হয়ে গেল একসময়। শেষদিনের কথা এখনো হাসানের পরিষ্কার মনে আছে। অফিসের কাজে হাসান কুষ্টিয়া এসেছে। কুষ্টিয়া পৌঁছে সবে কাপড় বদলানো শুরু করেছে, এমন সময় মিনহাজ ভাইয়ের ফোন। কথা হলো প্রায় বিশ মিনিট ধরে। মজার ব্যাপার হচ্ছে সেদিনের বিষয়বস্তু অন্যদিনের তুলনায় একটু অন্যরকম ছিল। কথার শেষ পর্যায়ে এসে তিনি হাসানকে বললেন, শোন হাইকিংয়ে যাচ্ছি, ফিরে এসে ফোন করব।

পরদিন হাসান কাজে ব্যস্ত। ঢাকা থেকে তার কয়েকজন সহকর্মী ফোন করে তাকে বলল, মিনহাজ ভাই নাকি মারা গেছেন। হাসান তাদের সবাইকে বলল, আরে না কালই তো ওনার সঙ্গে কথা হয়েছে। আসলেই সেদিন মিনহাজ ভাই হাইকিং থেকে ফেরার পথে মারা যান একটা গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে। পরে ওনার লাশ বাংলাদেশে আনা হয়। যেদিন তার লাশ বাংলাদেশে আসে সেদিন হাসান অফিসের কাজে ঢাকার বাইরে থাকায় তাঁকে শেষবারের মতো হাসানের দেখা হয়নি। পরবর্তীতে হাসান কুমিল্লা গিয়ে তার কবর জিয়ারত করে এসেছে। পৈতৃক বাড়ির পুকুর পাড়ে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে কবর দেওয়া হয়েছে। কবরের মাঝখানে কয়েকটা খেজুরের পাতা রাখা। হাসান কোনোভাবেই নিজেকে বিশ্বাস করাতে পারছিল না এখানে মিনহাজ ভাই চিরনিদ্রায় শায়িত। সত্যি কথা বলতে কী হাসান এখন পর্যন্ত বিশ্বাস করে না, মিনহাজ ভাই মারা গেছেন। সে সব সময়ই চিন্তা করে হঠাৎ একদিন মিনহাজ ভাই ফোন দিয়ে বলবেন, আরে ভোদাই কী খবর? তুই আবার অস্ট্রেলিয়ায় কী করিস?

চার.

হাসানদের অস্ট্রেলিয়ার বাসার মালিক নাজমুল ভাই (নাজমুল আহসান খান) মধ্যবয়সী ভদ্রলোক। কঠোর পরিশ্রম করেছেন। তারপরও ওনার শরীরে বয়সের ছাপ ততটা প্রকট হয়ে ওঠেনি। এমনকি এখনো সারা দিন তিনি এত কাজ করেন, সেটা দেখে হাসান অবাক হয়ে যায়। হাসান নিজেও এতটা কাজ করার সামর্থ্য রাখে না। নাজমুল ভাই হাসানের বাবার চেয়ে বয়সে অনেক বড় হবেন। তবুও হাসান তাকে ভাই সম্বোধন করে। কারণ তার বাসায় ওঠার আগে থেকেই হাসান তাকে চিনত কমিউনিটি বাংলা স্কুলে একসঙ্গে কাজ করতে গিয়ে। অবশ্য তখন তেমন গভীর পরিচয় ছিল না। তার নিচতলার গ্র্যানি ফ্ল্যাটে ওঠার পর তাদের সঙ্গে ভালোমতো পরিচয় হয়।

বাংলাদেশে থাকাকালে হাসান মনে করত বিদেশে বাঙালিরা সবাই মিলেমিশে বসবাস করেন। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া আসার পর হাসানের সেই ভুল ভেঙেছে। ঢেঁকি যেমন স্বর্গে গেলেও ধানই ভানে বাঙালিরাও অস্ট্রেলিয়া এসে রাতারাতি বদলে যায়নি। তবে এর ব্যতিক্রমও আছে। যেমন নাজমুল ভাই। সিডনিতে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত যে কারও কাছে নাজমুল খান খুবই পরিচিত নাম। দলমত-নির্বিশেষে সবাই তাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখেন ও সম্মান করেন। তার ও আরও কয়েকজন বাঙালির ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ক্যাম্বেলটাউন এলাকার বাংলা ভাষাভাষী কমিউনিটির জন্য প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলা স্কুল। গত প্রায় সতেরো বছর ধরে এই এলাকায় বেড়ে ওঠা দ্বিতীয় প্রজন্মের বাংলাদেশিদের বাংলা ভাষার পাশাপাশি সংগীত, কবিতা ও ছড়া শেখানোর কাজটা করে যাচ্ছে এই স্কুল। এমনকি যথাযোগ্য মর্যাদায় বাংলাদেশের জাতীয় দিবসগুলো পালন করে যাচ্ছে। সেই সকল অনুষ্ঠানে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিও উপস্থিত থাকেন। তবে এই স্কুলের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো দীর্ঘ সময় ধরে কোনো ধরনের বড় ঝামেলা ছাড়াই সুন্দরভাবে পরিচালিত হয়ে আসছে। আর এটা সম্ভব হয়েছে নাজমুল ভাই ও অন্য সদস্যদের কারণে।

যা হোক নাজমুল ভাইয়ের হৃদ্‌যন্ত্রে দুবার সমস্যা দেখা দেওয়ার পর ডাক্তারেরা তার শরীরে চামড়ার নিচে একটা যন্ত্র বসিয়ে দিয়েছেন যেটা হৃৎপিণ্ডের পালস নিয়ন্ত্রণ করছে। তিনি এখন হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপনের জন্য অপেক্ষমাণ তালিকায় আছেন। কারণ তার হৃৎপিণ্ডের মাত্র কুড়ি থেকে পঁচিশ শতাংশ কাজ করে। কিছুদিন আগে হৃৎপিণ্ড আবার সমস্যা করায় তাকে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকেরা বিভিন্ন প্রকারের জটিল পরীক্ষা নিরীক্ষা করার পর আরও একটা যন্ত্র বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। দীর্ঘ ছয়-সাত ঘণ্টার অপারেশন। অপারেশন শেষ করার পর আবার তাকে কমপক্ষে দুই দিন ইনটেনসিভ কেয়ারে থাকতে হবে।

হাসানের স্ত্রী ডাক্তার। তিনি হাসানের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছেন, অপারেশন করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। ওদিকে হাসানের মনে আগের স্মৃতিগুলো ভিড় করছে। তারপরও হাসান তার গিন্নির কথায় বিশ্বাস করছে। কারণ এবার সে কোনোভাবেই নাজমুল ভাইকে হারতে দিতে চায় না। নাজমুল ভাই জীবনযুদ্ধের পরীক্ষিত সৈনিক। জীবনের প্রতিকূলতাগুলোকে একেবারে সামনাসামনি মোকাবিলা করে আজকের এই অবস্থানে এসেছেন। তাই হাসানের দৃঢ় বিশ্বাস নাজমুল ভাই এবারও জীবনের এই যুদ্ধে জিতে ফিরবেন।