শহীদদের ঔজ্জ্বল্য মুছে যাবে না

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশে আমার দুরন্ত শৈশব কেটেছে এক ছোট্ট বাজারের পাশে রোদে পুড়ে, জলে ভিজে, হিজলগাছের ছায়ায় বসে, টেলিফোনের তারের ওপর বসা দোয়েলের শিস শুনে আর কোকিলের কুহু তানে। বাজারের উত্তর দিকে পোস্ট অফিস। ওই এলাকার একমাত্র টেলিফোনটি ছিল এর অধীন। আমাদের কাছে প্রধান আকর্ষণ ছিল পোস্টমাস্টার বাবু। তিনি আমাদের অসুর সেজে সং দেখাতেন। মাস্টার বাবুর কাছ থেকে আনন্দের খোরাক নিয়ে চলে আসতাম পোস্ট অফিসের পেছনে। অফিসের সঙ্গেই লাগোয়া কমরেড নিশি রঞ্জন ঘোষ মহাশয়ের বাড়ির আঙিনায়, কৃষ্ণচূড়াগাছের তলে।

শীতের শেষে রুক্ষ-রুষ্ট-কৃষ্ণচূড়ার ডালগুলো বৈরাগ্য দূর করে ভরে উঠত হাজার হাজার কচি পাতায়। এর মর্মরিত বাতাস গায়ে লাগিয়ে কাটিয়েছি কৈশোরের কত বেলা পড়তি অবেলা। ফাগুন এলেই ঘন হওয়া পাতার ফাঁকে ফাঁকে, থোকায় থোকায় কৃষ্ণচূড়ার ডালে ডালে আগুন লাগত। বনের ফাগুন তখনো মনে আগুন ধরায়নি, তবে তার আগমনে প্রাণে সুর জাগাত। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’।

তখনো কবি আসাদ চৌধুরীকে পড়া হয়নি—‘ফাগুন এলেই একটি পাখি ডাকে, থেকে থেকেই ডাকে। তাকে তোমরা কোকিল বলবে? বলো আমি যে তার নাম রেখেছি আশা নাম দিয়েছি ভাষা, কত নামেই তাকে ডাকি মেটে না পিপাসা।’

কী অপার মুগ্ধতায় একুশে ফেব্রুয়ারির আগের রাতে পোস্টার লেখন, কর্ণফুলী কাগজের ওপর আলতার রং চেতনায় ভাগ বসাত—‘মোদের গরব, মোদের আশা আ মরি বাংলা ভাষা’। তারপর দেয়ালে দেয়ালে সেঁটে দেওয়া ভাষার জয়গান। স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত প্রাণ। পরদিন ভোরে শিশিরভেজা পায়ে পায়ে এগিয়ে যাওয়া আর মুখে প্রভাতফেরির গান।

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

আমার ভাবনার বাগানের কৃষ্ণচূড়া ইতিহাসের পথ ধরে নিয়ে যায় আমাকে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে। ঊর্ধ্বমুখী কৃষ্ণচূড়ার তলায়, মায়ের ভাষাকে মাতৃদুগ্ধ ভেবে, মাকে ভালোবেসে প্রাণ দিয়েছিলেন ওরা কয়েকজন কিংবা তারও অনেক বেশি।

এই আত্মত্যাগ যা ছিল হাজার বছরের ঐতিহ্য লালন করা সংস্কৃতির মর্যাদার জন্য, কবিতা আর অবিনাশী গানের জন্য, কমলার দিঘি আর মহুয়ার পালার জন্য, কোমল পলিমাটি ভালোবেসে।

‘সেই মাটি থেকে তোমাদের রক্তাক্ত চিহ্ন মুছে দিতে পারবে না সভ্যতার কোনো পদক্ষেপ’।

মাতৃভাষার জন্য একমাত্র বাঙালিই প্রাণ দিতে পারে, এর সত্যতা ভাষার জন্য আত্মত্যাগের দ্বিতীয় অধ্যায় আসামের শিলচর। অহমিয়া ভাষাকে আসামের অফিশিয়ালি ভাষা মেনে বিল উত্থাপনের প্রতিবাদে আন্দোলন দানা বাঁধে। ১৯৬১ সালের ১৯ মে ১১ জন শহীদের রক্তে ভেজা বিল, যা পরবর্তী সময়ে স্থগিত করে বাংলা ভাষাকে যথোপযুক্ত মর্যাদা দিতে বাধ্য হয় আসাম সরকার।

আমাদের মনে রাখতে হবে, দেশের ও দেশের সীমানা পেরিয়ে, মায়ের ভাষার মর্যাদার জন্য প্রতিটি শহীদের প্রচারের দায়িত্ব আমাদের। তা মনে করিয়ে দেয় ফাগুন অথবা ফেব্রুয়ারি।

কৃষ্ণচূড়ার অসংখ্য ঝরা পাপড়ির মতো তাজা প্রাণ। যে ভাষায় অভ্যস্ত মায়ের সঙ্গে কথা বলায়, তার মর্যাদা রক্ষায় রক্ত দিয়ে স্বাধীনতার বীজ বুনেছিল ১৯৫২ সালে। দাবিয়ে রাখতে না পারার এর পরের ইতিহাস আমরা সবাই জানি।

‘ভাইয়ের মায়ের এত স্নেহ, কোথায় গেলে পাবে কেহ,
ও মা তোমার চরণ দুটি বুকে আমার ধরি,
আমার এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতে মরি’।

লেখক
লেখক

এই স্বপ্ন বুকে চেপে যাঁরা প্রাণ দিয়েছিলেন সেদিন, তাঁদের লক্ষ দিনের আশা অগ্নিশিখা হয়ে জ্বলে তাঁদের মধ্যে, যাঁদের আমরা ফোর-জি প্রজন্ম বলি। যারা এই পাশ্চাত্যে জন্ম নেওয়া, কাঁধে স্কুলব্যাগ, হাতে হ্যারি পটার কিংবা লর্ড অব দ্য রিংস আর মুখে চোস্ত অ্যাকসেন্টে ইংরেজিতে কথা বলে সহপাঠীদের সঙ্গে।

আবার চাইলে শিরিন আপার ছেলেটির মতো রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে ‘মম চিত্তে নিতি নিত্যে’ চিত্ত জয় করে নেয় নিমেষেই। টেগোর নয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওপর কথা বলতে শিখেছে মেরুনা-আহমেদ তনয়া আমাদের অহমা, কনক-টোরির মেয়ে রিংকেল, যার মুদ্রার ছোঁয়ায়, ‘শুনল শুনল বালিকা’ হয়ে ওঠে দৃশ্যকাব্য। পশ্চিমের জলবায়ুতে বেড়ে ওঠা আমাদের রাদিয়া ফিরোজ মিষ্টি, পূর্বের সংস্কার থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত না হয়ে, নির্ভুল রবীন্দ্র কবিতা আবৃত্তি করে। দর্শক আসনে আপন নানু কবি আসাদ চৌধুরীকে আপ্লুত করে। বাঙালি প্রজন্ম যত দূর প্রাণের বর্ণমালা তত দূর। কিংবা দ্বীপশিখা ও বিপ্লব কর্মকারের মেয়েটি লাজুক লাজুক ভঙ্গিমার আবৃত্তি করে ফেলে ‘ভয় পেয়ো না ভয় পেয়ো না তোমায় আমি মারব না’।

এই সম্ভাবনাময় প্রজন্ম এরাই ফুফুর আরশি, তাদের চোখে দেখি আমাদের মুখ, আমাদের আত্মপরিচয়।

আমার ভাবনার বাগানের কৃষ্ণচূড়ার উঁচু ডালে বসা কালো কোকিলটি বলে যায়, ভয় নেই বাংলা-বাঙালিয়ানা কখনোই হারাবে না। রক্তঝরানো শহীদদের ঔজ্জ্বল্য মুছে যাবে না।
...

হিমাদ্রী রয় সঞ্জীব: টরন্টো, কানাডা। ই–মেইল: <[email protected]>