মৃত্যুপুরী পুরান ঢাকা

চকবাজারের একটি ভবনে গত বুধবার রাতে ভয়াবহ আগুন লাগে। এই আগুন আশপাশের ভবনেও ছড়িয়ে পড়ে। আগুন নেভাতে রাতভর চেষ্টা চালায় ফায়ার সার্ভিস। চকবাজার, ঢাকা, ২০ ফেব্রুয়ারি। ছবি: ফোকাস বাংলা
চকবাজারের একটি ভবনে গত বুধবার রাতে ভয়াবহ আগুন লাগে। এই আগুন আশপাশের ভবনেও ছড়িয়ে পড়ে। আগুন নেভাতে রাতভর চেষ্টা চালায় ফায়ার সার্ভিস। চকবাজার, ঢাকা, ২০ ফেব্রুয়ারি। ছবি: ফোকাস বাংলা

অবস্থানগত কারণে এবং আবহাওয়া ও জলবায়ুগত দিক বিবেচনা করে পৃথিবীর অন্য দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করে বাংলাদেশকে বলা হয় প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ। কিন্তু প্রকৃতিকে পদাঘাত করে যখন একের পর এক মানবসৃষ্ট দুর্যোগ আমাদের শত মৃত্যুর কারণ হয়, তখন এই দুর্যোগকে কিসের সঙ্গে তুলনা করা চলে, তা আমাদের জানা নেই। আমাদের আরও জানা নেই, আর কতবার রানা প্লাজা, নিমতলী, চকবাজারের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলে আমরা হুঁশিয়ার হব, আমরা ভাবব এক পরিকল্পিত নগরায়ণের কথা।

পুরান ঢাকায় যারা একবার ঢুকেছে তারাই বলতে পারবে কী সরু ও জরাজীর্ণ রাস্তাঘাট। অতি বড় বিপদে কেউ ইচ্ছা করলেও বিপদগ্রস্তকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে ভয় পাবেন, পাছে নিজের জীবন যায় এই ভেবে। আমরা সবাই জানি, জান বাঁচানো ফরজ। তাই বিপদ যখন অবশ্যম্ভাবী, তখন আগে পিছে না তাকিয়ে নিজের জানটাকেই বাঁচাব, অন্যেরটা নয়। খুব কমসংখ্যক মানুষ আছেন যাঁরা অন্যকে নিয়ে ভাবেন। আর পুরান ঢাকার প্রশ্নে, যেখানে নিজের জান নিয়ে টানাটানি, সেখানে অন্যের জানমালের হিসাব কে রাখে। আমরা জাতি হিসেবে আধুনিক, চিন্তা-চেতনায়, মননে-মানসিকতায় আধুনিক। তবে কি আধুনিক ঢাকার পাশে পুরান ঢাকাকে পুরোনো কীর্তি হিসেবে রাখার তাগিদেই পুরান ঢাকাকে আজও পুরোনো করে রেখেছি? আর তাই স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরও পুরান ঢাকা শুধু পুরানই না, বেহালও? অথচ মৃত্যুপুরী হিসেবে বাংলাদেশের কোনো স্থানকে চিহ্নিত করতে বলা হলে নগর পরিকল্পনাবিদদের প্রথমেই মাথায় আসার কথা ‘মৃত্যুপুরী পুরান ঢাকার কথা’। আর কত মৃত্যুর মধ্য দিয়ে নগর পরিকল্পনাকারীদের নগরায়ণের নকশা বদলাবে, জাতি হিসেবে এ প্রশ্ন আজ সবার মনে। নয়তো পুরান ঢাকার বাতাস আরও আরও লাশে ভারী হবে, সেদিন বেশি দূরে নয়।

পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টার গলিগুলো এমনই সরু। এতে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রবেশে ঘটেছে বিপত্তি। প্রথম আলো
পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টার গলিগুলো এমনই সরু। এতে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রবেশে ঘটেছে বিপত্তি। প্রথম আলো

একেকটা দুর্ঘটনা ঘটে আর আমাদের গণমাধ্যম চ্যানেলগুলোতে দেখা যায় টকশোর টেবিলে তুখোড় সব আলোচনা-সমালোচনার ঝড়। যে ঝড়ে সাপও মরে না, লাঠিও ভাঙে না। গল্পগুলোই সার। একইভাবে, মাইক্রোফোন হাতে নামীদামি নেতাদের বলতে শোনা যায় আশ্বাসের বাণী, কখনো-বা দুর্ঘটনাকে আড়াল করার ফন্দিফিকির। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে গেলে বলতে হয় অতি আবেগে আমরা সাধারণ আমজনতা বলতে থাকি, ‘আহারে! চোখের পানি ধরে রাখতে পারছি না, এমন হৃদয়বিদারক মৃত্যু সহ্য করা যায় না।’ তারপর একদিন, দুই দিন, তিন দিন—মেজাজ ফুরফুরে, সব ভুলে পুরোনো চিন্তা, পুরোনো কর্মে মনোনিবেশ করি। তার চেয়ে বড় আশার কথা হলো, আমাদের দেশে ঘটনার ঘনঘটা এতটাই পর্যায়ক্রমিক যে, বিরামহীনভাবে একটার পর একটা লেগেই আছে। তাই একটা বিষয় নিয়ে লেগে থাকার মতো যথেষ্ট সময়ও আমরা হাতে পাই না।

এই ভেবে দেখুন না, এক মাস আগের কথা। ২৫ জানুয়ারি সিলেট শাহজালাল প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের তাইফুর রহমান প্রতীক আত্মহত্যা করলেন। এই ঘটনার রেশ না কাটতেই ঠিক সাত দিনের মাথায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক মুস্তাফা মুরশেদ আকাশ আত্মহত্যা করলেন। পুরো বাংলাদেশ যখন আকাশ-মিতুর কাবিননামা নিয়ে টানাহেঁচড়া করছে, তখন আমাদের সামনে এল অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তার সাবেক স্ত্রীর অভিযোগ। এই অভিযোগটা বিষদ আকারে বলতে চাই না। কিন্তু যেটা বলতে চাই সেটা হলো, একেকটা ঘটনা ঘটে তারপর কিছুদিন টান টান উত্তেজনা, জোরালো আবেদন বিচার চাই, শাস্তি চাই হ্যানত্যান ইত্যাদি ইত্যাদি।

অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও এটাই সত্যি, প্রতিটি নতুন ঘটনা পুরোনো ঘটনাগুলোকে ধামাচাপা দিয়ে দেয় এবং পরবর্তী সময় সেসব ঘটনার আদৌ কোনো আশু সমাধান হয় কি না, আমাদের কারোরই সেটা আর জানা হয় না। আমরা হয়তো এমনই শুরু দেখি, শেষ দেখি না। কারণ, আমরা বারবার শুধু নতুন ঘটনা দেখার অপেক্ষায় থাকি। দেখা যাক, দুই-তিন দিনের মধ্যে কী ঘটে!
...

লাভলী ইয়াসমীন: সেন্ট্রাল কোস্ট (গজফোর্ড), নিউ সাউথ ওয়েলস, অস্ট্রেলিয়া।