সাও পাওলোয় দ্বিতীয়বারের মতো ভাষাশহীদ দিবস

অস্থায়ী শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি
অস্থায়ী শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি

পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম রাষ্ট্র ব্রাজিলের নানা শহরে বাংলাদেশি নাগরিকেরা ছড়িয়ে থাকলেও দেশটির বৃহত্তম নগরী ও প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র সাও পাওলো শহরেই সর্বোচ্চসংখ্যক বাংলাদেশির বসবাস। ২০১৮ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ দূতাবাস রাজধানী ব্রাসিলিয়ার বাইরে সাও পাওলোতে প্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিকদের নিয়ে মহান ভাষা ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করে। এর ধারাবাহিকতায় এ বছরও বাংলাদেশ দূতাবাস যথাযোগ্য ভাবগাম্ভীর্য ও মর্যাদায় সাও পাওলোয় দ্বিতীয়বারের মতো মহান ভাষাশহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করেছে। দূতাবাসের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে প্রায় তিন শ প্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিক বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে এ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। আর এবারই প্রথম বাংলাদেশ সময় অনুসারে একুশের প্রথম প্রহরে (ব্রাজিল সময় ২০ ফেব্রুয়ারি বুধবার বিকেল ৫টা) ভাষা দিবসের অনুষ্ঠানের সূচনা করা হয়।

সাও পাওলোর বাংলাদেশি–অধ্যুষিত ব্রাস শহরের কার্লোস দো কাম্পোস খেলার মাঠে স্থাপিত অস্থায়ী শহীদ মিনারে দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. জুলফিকার রহমানের শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। এরপর বাংলাদেশ কমিউনিটির বিভিন্ন সংগঠন ও প্রবাসী বাঙালিরা শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। মূল অনুষ্ঠানের শুরুতে ভাষাশহীদদের সম্মানে নীরবতা পালন এবং তাঁদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে বিশেষ প্রার্থনা করা হয়। এরপর দিবসটি উপলক্ষে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী প্রদত্ত বাণী পাঠ করা হয়।

অস্থায়ী শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি
অস্থায়ী শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি

অনুষ্ঠানের পরবর্তী অংশে ছিল উন্মুক্ত আলোচনা। প্রবাসী বাংলাদেশের নাগরিকেরা এ সময় তাঁদের নানান সমস্যা তুলে ধরেন এবং দূতাবাসের কাছে তাঁদের কী প্রত্যাশা, তা ব্যক্ত করেন। উন্মুক্ত আলোচনাপর্বে বক্তারা সাও পাওলোতে প্রবাসীদের সঙ্গে মহান ভাষাশহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের উদ্যোগকে স্বাগত এবং ভবিষ্যতে সব জাতীয় দিবস তাঁদের সঙ্গে উদ্‌যাপনের জন্য রাষ্ট্রদূতের কাছে অনুরোধ করেন। বক্তারা ব্রাজিলপ্রবাসী বাংলাদেশের নাগরিকদের কনস্যুলার পরিষেবা প্রদান সহজতর করার লক্ষ্যে উদ্যোগ গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রদূতের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এ সময় প্রবাসীরা সাও পাওলোতে একটি কনস্যুলেট স্থাপনের দাবি এবং নানা কারণে ব্রাজিলে মৃত্যুবরণ করা বাংলাদেশি নাগরিকদের মৃতদেহ ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে সরকারের আর্থিক সহায়তা প্রদানের অনুরোধ করেন। সাও পাওলোতে বাংলাদেশের কোনো কনস্যুলেট না থাকায় বিভিন্ন কনস্যুলার সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রবাসীরা নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হন।

উল্লেখ্য, সাও পাওলোতে বসবাসরত অধিকাংশ প্রবাসী ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী অথবা রেস্তোরাঁকর্মী। কনস্যুলার পরিষেবা গ্রহণের জন্য দুই হাজারেরও বেশি ব্রাজিলিয়ান মুদ্রা খরচ করে বিমানযোগে ব্রাসিলিয়াতে আসা তাঁদের সাধ্যের বাইরে। অন্যদিকে বাসযোগে ১৬ ঘণ্টারও বেশি সময় ভ্রমণ করে আসাটাও অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। বাসে ব্রাসিলিয়া আসা-যাওয়া করে কনস্যুলার পরিষেবা গ্রহণ করতে তাঁদের তিন দিনেরও বেশি সময় ব্যয় হয়। যার ফলে অনেক সময় তাঁরা চাকরিচ্যুত হন। সাও পাওলোপ্রবাসীরা সেখানে একটি কনস্যুলেট স্থাপনের মাধ্যমে এসব সমস্যার স্থায়ী সমাধানের দাবি জানান।

রাষ্ট্রদূত মো. জুলফিকার রহমান তাঁর শুভেচ্ছা বক্তব্যে বাংলাদেশ দূতাবাসের এ আয়োজনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণের জন্য প্রবাসীদের ধন্যবাদ ও তাঁদের ঐক্যবদ্ধভাবে একে অন্যকে বিপদে সহায়তার অনুরোধ জানান। তিনি উল্লেখ করেন, ভবিষ্যতেও দূতাবাস এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণের চেষ্টা করবে। তবে মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসসহ অন্য দিবস রাজধানী ব্রাসিলিয়াতে আয়োজনের গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি জানান, সব জাতীয় দিবস সাও পাওলোতে উদ্‌যাপন সম্ভব নয়। ব্রাজিলের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধি ও প্রবাসীদের কনস্যুলার পরিষেবা সহজতর করার লক্ষ্যে ইতিমধ্যে সাও পাওলোতে কনস্যুলেট স্থাপনের একটি প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন বলে তিনি জানান। এ তথ্য উপস্থিত সবার মধ্যে বিপুল প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে।

অস্থায়ী শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি
অস্থায়ী শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি

রাষ্ট্রদূত ঘোষণা দেন সাও পাওলো ও অন্যান্য দূরবর্তী শহরে বসবাসরত বাংলাদেশের নাগরিকদের কনস্যুলার পরিষেবা প্রদানের জন্য দূতাবাস থেকে মোবাইল টিম পাঠানো অব্যাহত রাখা হবে। মৃত্যুবরণ করা বাংলাদেশের নাগরিকদের মৃতদেহ ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে সহায়তার বিষয়ে আরও উদ্যোগ গ্রহণ করবেন বলে তিনি জানান। তবে মৃত্যুবরণ করা বাংলাদেশের নাগরিকদের মৃতদেহ দেশে ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে সরকারের নীতিমালা উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত জানান, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের নাগরিকেরা অনিয়মিত পথে ব্রাজিল আগমন করেন বিধায় সরকারি নীতিমালায় উল্লেখিত শর্তগুলো পূরণ করে মৃতদেহ স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা করা দুরূহ হতে পারে।

১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতেই বাঙালি জাতির স্বাধীনতাযুদ্ধের বীজ রোপিত হয়েছিল উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত আরও বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত মাতৃ ভাষা বাংলা রক্ষার আন্দোলনই পরবর্তী সময়ে বাঙালি জাতিকে স্বাধিকার আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করে। যার ফলে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। ১৯৯৯ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের ভাষাশহীদ দিবস পায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি। ২০১৭ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় সেখানে একটি শহীদ মিনার স্থাপনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তিনি সাও পাওলোতে একটি শহীদ মিনার নির্মাণের পরিকল্পনার কথা জানান। এ বিষয়ে তিনি প্রবাসীদের সহযোগিতা কামনা করেন।

রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যের পর ব্রাজিল-বাংলা ব্যান্ডের পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।

উল্লেখ্য, আজ ২৭ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় রাজধানী ব্রাসিলিয়ায় ব্রাজিলের জাতীয় গ্রন্থাগারের অডিটরিয়ামে ১৩টি ভিন্ন ভাষাভাষী শিল্পীদের পরিবেশনায় একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ব্রাসিলিয়াতে মহান ভাষাশহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদ্‌যাপন করা হবে। বিজ্ঞপ্তি