মিশিগানে পিঠা-পুলিতে একুশ

সাংস্কৃতিক পরিবেশনা
সাংস্কৃতিক পরিবেশনা

মিশিগানে প্রবাসী বাংলাদেশিদের আয়োজনে হয়ে গেল ব্যতিক্রমী এক অনুষ্ঠান, ‘পিঠা পুলিতে একুশে উদযাপন’। মিশিগান বেঙ্গলসের উদ্যোগে ভাষাশহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয় যথাযোগ্য মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্যে। প্রবাস জীবনেও দেশীয় সংস্কৃতির ছোঁয়া এনে দিতে মিশিগানে উইক্সম শহরের কমিউনিটি সেন্টারে ভাষা দিবসের পাশাপাশি আয়োজন করা হয় বাংলাদেশি পিঠা উৎসব।

২৩ ফেব্রুয়ারি শনিবার বিকেল চারটায় প্রবাসী বাংলাদেশি-আমেরিকানদের অংশগ্রহণে পালিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও পিঠা উৎসব। স্থানীয় শিল্পীদের উপস্থাপনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘ভাষা দিবস’।

সাংস্কৃতিক পরিবেশনা
সাংস্কৃতিক পরিবেশনা

বিকেল চারটার পর থেকেই কমিউনিটি সেন্টারের মিলনায়তনে দেশীয় পোশাক সাদা-কালো রঙের শাড়ি-পাঞ্জাবি পরে হাজির হতে থাকেন প্রবাসীরা। চারপাশে তুষার আর বরফের স্তূপ ঠেলে উৎসবস্থলে পৌঁছাতেই চোখে পড়ে থরে থরে সাজানো পিঠা। বাংলা ঋতু শীত আর বসন্তের খবর পরবাসীরা খুব কমই রাখেন বলে মনে হয়। তবে চারপাশে তুষারে ঢাকা শ্বেত শুভ্রতা আর কনকনে শীতে নতুন ধানের চালের গুঁড়ায় তৈরি পিঠার অতুলনীয় স্বাদ নিতে ভোলেননি নোভাই-নর্থভিল, কেন্টন, আন আরবার, ট্রয় উইক্সম ও ফারমিংটন হিলস শহরের আশপাশের বাংলাদেশিরা।

মঞ্চসজ্জা করা হয়েছিল প্রমাণ সাইজের শহীদ মিনার দিয়ে। একুশে ফেব্রুয়ারি পালনের জন্য শনিবার অনুষ্ঠানের দিন নির্ধারণ ছিল আগে থেকেই। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতেই হল ভরে যায় আগত অতিথিতে। লোকসমাগম দেখে মনে হয় পরবাসে এ যেন ছোট্ট একটি বাংলাদেশ। কিঞ্চিৎ শান্তি দেওয়ার প্রয়াসে হাড়কাঁপানো শীতে মিশিগান বেঙ্গলস আয়োজন করেছিল পিঠা-পুলির উৎসব।

সাংস্কৃতিক পরিবেশনা
সাংস্কৃতিক পরিবেশনা

প্রতিটি পরিবার এক থালা করে পিঠা নিয়ে হাজির হয়েছে। উৎসবে ভাপা, পুলি, চিতই, পাটিসাপটা, চুঙ্গা, গোলাপ ফুল, লবঙ্গ লতিকা, রস ফুল, জামদানি, হাঁড়ি, ঝাল পোয়া, ঝুরি, ঝিনুক, সূর্যমুখী, নকশি, নারকেল, নারকেলের ভাজা পুলি, দুধচিতই পিঠাসহ বিচিত্র সব পিঠার সমারোহ ঘটে। ছিল ময়মনসিংহ, বরিশাল, বগুড়া, নোয়াখালী, রাজশাহী ও চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী নানা ধরনের পিঠাও। পিঠার সেই ম-ম গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে পুরো হলরুমে। পিঠার সমন্বয়ক ছিলেন রানী হাওলাদার, শান্তা খন্দকার, রওশন আরা শম্পাসহ অনেকে।

৫টা ৩০ মিনিটে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি দিয়ে সাংস্কৃতিক পর্বের শুরু হয়। সমবেত কণ্ঠে গান পরিবেশন করেন শান্তা খন্দকার, রওশন আরা শম্পা, নিপা ভূঁইয়া, ফারজানা শামসাদ মিমি, তন্বী, মাহবুবা আরা রিনা ও দিপা বড়ুয়া। ‘মাগো ভাবনা কেন’ সমবেত কণ্ঠে পরিবেশন করেন আবেদুর রসুল, ফরিদ চৌধুরী, ফাহিম, রতন হাওলাদার, মোহাম্মদ মামুন, ইউসুফ আলী ও চন্দ্রনাথ।

প্রবাসে বেড়ে ওঠা বাংলাদেশি কিশোরীদের অংশগ্রহণে পরিবেশিত হয় ‘ফুলে ফুলে’ রবীন্দ্রসংগীত। হলভর্তি অতিথিরা এতে গলা মেলান। গানটিতে অংশ নেয় জারা, শ্বেতা, শ্রেয়া, আরিশা, রিদিতা, রায়া সিরাজ, স্নেহা, শ্রুতি, শ্রদ্ধা, সোহা ও ফারিজা। দলীয় সংগীতের সমন্বয়ক ছিলেন শানা খন্দকার।

শ্রেয়া হাসান কি-বোর্ডে ‘পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়’-এর সুর তুলে মিলনায়তনের সবাইকে মুগ্ধ করেন। অনুষ্ঠানে শিশু-কিশোরদের মধ্যে লালনগীতি ‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি’ গান পরিবেশন করেন শ্বেতা। আর ‘ধন্য ধন্য’ জারা আনোয়ার।

জারা আনোয়ার ও তার বাবা ড. নাজমুল আনোয়ার পরিবেশন করেন ‘আয় খুকু আয়…’। তিন বোন শ্রদ্ধা, শ্রুতি ও স্নেহা পরিবেশন করে রবীন্দ্রসংগীত ‘ওরে ও গৃহবাসী’। রতন হাওলাদার পরিবেশন করে ভাষা দিবসের গান ‘সালাম সালাম’। ফাহিম পরিবেশন করে ‘আমি বাংলায় গান গাই’।

বাঁশির সুরের মূর্ছনায় পুরো অডিটোরিয়ামকে বিমোহিত করেন ড. চন্দ্রনাথ। তবলায় ছিলেন রতন হাওলাদার। মাহবুবুল আলম চৌধুরীর কবিতা ‘আমরা কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ আবৃত্তি করেন সৈয়দ সিহাব উল্লাহ ও সাবরিনা সাব্বির বন্যা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘না পাঠানো চিঠি’ আবৃত্তি করেন পপি দাস। রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহর ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’ আবৃত্তি করেন সাইফ সিদ্দিকী।

সাংস্কৃতিক পরিবেশনা
সাংস্কৃতিক পরিবেশনা

অনুষ্ঠানে ‘একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার’ গানের সঙ্গে দলীয় নাচ পরিবেশন করে শিশুশিল্পী আতিফ, তাজরী, আলিসবা, আলিশা, শায়রিন ও মঞ্জুরি। ‘রক্ত লাল রক্ত লাল’ গানের সঙ্গে দলীয় নৃত্য পরিবেশন করে সঞ্জিদা, শারমিন, শাম্মা ও এমি। দুটি নাচেরই কোরিওগ্রাফি করেন এমি ইসলাম। এ ছাড়া ফাগুনেরও মোহনায় গানের সঙ্গে নাচে পুরো মিলনায়তন নাচিয়ে তোলে আমিতা মৃধা ও পৌলমী দে।

অনুষ্ঠানটির উপস্থাপনায় ছিল বেশ চমক। ছোট ছোট শিশু-কিশোরেরা ছিল উপস্থাপনায়। অনেকে তাদের বাবা বা মায়ের গানের আগে উপস্থাপনা করে। উপস্থাপনায় ছিল নাশিতা, উসাইদ, মাহির, রাইয়ান, শারার, শ্বেতা, রায়ান, আরিয়ান, ফাইয়াজ, আরিশা ও শ্রেয়া। পরিচালনায় ছিলেন সাইফ সিদ্দিকী।

এই আয়োজনের মূল কারিগর ভাবি-বৌদিদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান আয়োজকেরা। একসঙ্গে এত পিঠার সমারোহ দেখে সবাই বিস্ময় প্রকাশ করেন। আয়োজকেরা আগত অতিথিদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ, উচ্ছ্বাস-উদ্দীপনা ও শৃঙ্খলাবোধের জন্য ধন্যবাদ ব্যক্ত করেন। আগত অতিথিরা এই আয়োজনকে সাধুবাদ জানান ও ভবিষ্যতেও এই ধরনের অনুষ্ঠানের ধারাবাহিকতা প্রত্যাশা করেন।

অনুষ্ঠানে লটারির মাধ্যমে পিঠা-পুলি নিয়ে আসা ১০ জন ভাগ্যবতী ভাবি-বৌদির হাতে শুভেচ্ছা পুরস্কার তুলে দেন দেবাশিস মৃধা ও চিনু মৃধা।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের শেষাংশে ছিল স্থানীয় বাংলাদেশি ব্যান্ডদল ‘রিদম অব বাংলাদেশ’-এর পরিবেশনায় মা মুনিয়া, পাগলা হাওয়া, সেই তুমি ও এখন তো সময়সহ বেশ কটি জনপ্রিয় বাংলা গান। ব্যান্ডের সদস্যরা ছিলেন আবির, শাওন, সাফি, শিপু, রেইভেন ও ড. রুশো।

অনুষ্ঠানের সাউন্ডের দায়িত্বে ছিলেন আবির ও নাজমুল আনোয়ার। মঞ্চসজ্জায় ছিলেন রসি মীর। সহযোগিতায় সাইফ সিদ্দিকী। অনুষ্ঠানের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন শরিফ হাসান, রসি মীর, সাইফ সিদ্দিকী, কৌশিক আহমেদ, আবেদুর রাসুল, ফরিদ চৌধুরী ও সাইদ ফয়সাল।