ধূসর জীবন

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

শুনেছি, তুমি লেখক। আমার জীবনে একটা ঘটনা আছে। তুমি কি লিখবে?

জীবনে ঘটে যাওয়া সবকিছুই প্রতিনিধিত্বকারী ঘটনা নয়। তাই লেখকদের হিসাব অন্য রকম। আগে শুনি। তারপর সিদ্ধান্ত নেব।

চলো কোথাও বসি।

কেথি আর জোসেফ একই হোটেলে কাজ করে। দুজনই ওভারসিজ স্টুডেন্ট। একই সঙ্গে মাস্টার্স কমপ্লিট করে সবে পারমানেন্ট রেসিডেন্সির অ্যাপ্লাই করেছে। দুজনের সাবজেক্ট ভিন্ন। তাই ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে কালেভদ্রে দেখা হতো। একদিন কাজ শেষে ওরা একসঙ্গে বের হয়। ওভারসিজ প্যাসেঞ্জার টার্মিনালের সামনে বাঁধানো বটতলায় দুজন পাশাপাশি বসে। সামনেই রেলস্টেশন। হারবারের ওপারে দেখা যায় সিডনি অপেরা হাউস।

জোসেফ বলে, তুমি তো এ পর্যন্ত আমার সঙ্গে ভালো করে কথাই বলোনি।

: হ্যাঁ, বলিনি। মানসিক বিপর্যয়ে মনের অবস্থা ভালো ছিল না।

: মানসিক বিপর্যয়! তুমি কি এখানে একা?

: হ্যাঁ, একা। আমি ফিলিপিনো। অস্ট্রেলিয়ায় আমার কেউ নেই। তোমার?

: আমি তাইওয়ানের। আমারও কেউ নেই এখানে।

: কোনো এক ছুটির দিনে তোমার বাসায় যেতে চাই। কী বলো?

: আমার বাসায়! আমি তো একা থাকি।

কোমল হাসিতে কেথির চোখেমুখে দেখা দেয় আনন্দের ঝিলিক।

: তবে তো ভালোই হলো। কেউ ডিস্টার্ব করবে না।

: ঠিক আছে। এই রোববার আমার ছুটি। তোমার?

: হ্যাঁ, আমারও।

তারপর দুজনে ফেসবুকে যুক্ত হয়। ফোন নম্বর বিনিময় শেষে দুজন বিদায় নেয়।

কেথি সেদিন সকালেই চলে আসে। জোসেফ স্যান্ডউইচ তৈরি করে রেখেছিল।

ব্রেকফাস্ট শেষে কেথি জোসেফের ছোট্ট কক্ষের চারদিকে চোখ বুলিয়ে বলে, তোমার বইয়ের সংগ্রহ বেশ ভালো।

: হ্যাঁ, কোনো বন্ধুবান্ধবী নেই। বলতে পারো বই-ই আমার সব।

: আমিও তোমার মতোই ছিলাম। এই পরবাসের কঠিন বাস্তবতায় আমার শিল্পী মনটা হারিয়ে গেছে।

: হতে পারে তুমি যা ভাবছ তা সত্য। তবে...

: তবে কী?

: বই আর কতটা সঙ্গ দেয়। এই যে তুমি এসেছ, খুব ভালো লাগছে। এ এক অন্য রকম ভালো লাগা। প্রতিটি মুহূর্তই তৈরি করছে জীবন্ত গল্প।

কেথি কেমন গম্ভীর হয়ে যায়। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, এ দেশে আজ তিন বছর। মা-বাবা দুজনই বলেছিলেন টিউশন ফি পাঠাবেন। ব্যাড লাক। আমি আসার পরপরই তাঁদের সেপারেশন হয়। ইতিমধ্যে দুজনই নতুনভাবে স্থায়ী হয়েছেন। আমরা জানি মানুষ বদলে যায়। কিন্তু মা-বাবা যে এমন করে বদলে যেতে পারে জানতাম না।

: হ্যাঁ, জীবনের বাস্তবতা মাঝেমধ্যে কঠিন হয়ে যায়। তার মানে নিজ খরচেই মাস্টার্স কমপ্লিট করেছ?

: হ্যাঁ।

: বিরাট লোন হয়ে গেছে নিশ্চয়ই।

: না, হয়নি। তবে বুকের ভেতরটা দেউলিয়া হয়ে গেছে। জীবনে বড় রকমের বিসর্জন ছাড়া কোনো অর্জনই সফল হয় কি?

জোসেফ কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না।

কিছুক্ষণ থেমে একটা হালকা নিশ্বাস ছেড়ে কেথি বলে, বুড়ো মানুষটা তিন মাস আগে হঠাৎ করেই মারা গেছে। তারপরই হোটেলে চাকরি নিই।

জোসেফ চোখ দুটো বড় করে বলে, বুড়ো মানুষ!

: বিরানব্বই বছর বয়স তার। নাম স্টিফেন। দিব্যি হাঁটাচলা করতে পারত। বার্ধক্য ছাড়া কোনো রোগ তার ছিল না। সপ্তাহে তিন দিন বিকেল পাঁচটায় তার বাসায় যেতাম। ফিরতাম পরদিন সকাল আটটায়। প্রতি রাতের জন্য সে আমায় চার শ ডলার দিত।

: স্টিফেন বুড়ো মানুষ। আর তুমি এমন ইয়াং সুন্দরী একটা মেয়ে...।

: জোসেফ, জগতের সমস্ত সাদা-কালো সম্পর্কের মধ্যে ধূসর কিছু এলাকা আছে। খুব সহজেই ওসব চোখে পড়ে না।

জোসেফ মুগ্ধ হয়ে শুনতে থাকে।

: বিছানায় শুয়ে প্রথমে আমাকে সম্পূর্ণ উলঙ্গ করত। তারপর শক্ত করে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরত। একসময় আমার স্তন দুটোর মধ্যখানে মুখটা নিবিড়ভাবে গুঁজে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ত। আর ঘুমের ঘোরে মাঝেমধ্যে মাম্মি মাম্মি বলে ডাকত।

: মাম্মি? কী অদ্ভুত ব্যাপার! মায়ের কথাই যদি তার মনে থাকবে, তাহলে তোমাকে উলঙ্গ করত কেন?

: এ প্রশ্ন নিজেকে বহুবার করেছি। উত্তর পাইনি। স্টিফেন মরে গেলে তার কফিনে উপুড় হয়ে পড়ে দীর্ঘক্ষণ কেঁদেছি। পৃথিবীর আর কারও জন্য আমার এত মায়া হয় না, তার জন্য যতটা হয়। অথচ আমি তার ভাড়া করা একটা মেয়ে...।

: লোকটা কি তার অতীতের কোনো গল্প করত?

: না, সে বর্তমানকেই পছন্দ করত।

: বিরানব্বই বছর বয়সী স্টিফেনের মা অবশ্যই বেঁচে থাকার কথা নয়। তবে তার কি কোনো স্ত্রী বা এমন কেউ ছিল?

: জানি না, জানার চেষ্টাও করিনি।

: চেষ্টাও করোনি! মেয়েরা এমন হয় না সাধারণত।

ঝরঝরে কালো চুলগুলো দেয়ালে সাঁটানো আয়নায় বিন্যস্ত করতে করতে কেথি বলে, হ্যাঁ, দেহ চলে দেহের নিয়মে। নিজেকে একসময় পণ্য মনে হচ্ছিল। তাকে দেখামাত্র আমিও আমার অতীত ভুলে যেতাম। কোনো কিছুই আর মনে পড়ত না। নিবিড় এক শান্তিতে আমিও ঘুমিয়ে পড়তাম। ওই ভালো লাগার কোনো ব্যাখ্যা আমার জানা নেই।

: অনুভূতির কোথায় যেন হোঁচট খাচ্ছি।

কেথি জোসেফের খুব কাছে এসে বসে বলে, রক্সের এই হোটেলে যখন প্রথম হাউসকিপিং শুরু করি, তখন তুমি আমায় অনেক হেল্প করেছিলে। ওসব কাজের কোনো অভিজ্ঞতা আমার ছিল না। টাকার দরকার তো ছিলই। তারপরও তোমার সঙ্গে খানিকটা ভালো সময় কাটবে, তাই বেশ আগ্রহ নিয়েই কাজে আসতাম।

: হ্যাঁ, ট্রেনিং পিরিয়ডে এমন হেল্প তো সবাইকেই করি।

: মনে পড়ে, আমার ট্রেনিং শুরুর দিনের কথা। আমি একটা বাকেট উপুড় করি। তার ওপর উঠে শাওয়ারের কার্টিঞ্জ চেঞ্জ করার সময় ব্যালান্স রাখতে পারছিলাম না। তুমি আমায় জড়িয়ে ধরেছিলে, যাতে পড়ে না যাই।

: হ্যাঁ, মনে পড়ছে।

: আচ্ছা, তুমি এত উদাসীন কেন?

: মনের দিক থেকে একটুও না। মাইগ্রেশনের অ্যাপ্লিকেশন করে বসে আছি। তাই বলতে পারো ভয়ে বিপদ এড়িয়ে চলা। ওসব কথা এখন থাক। পরবাসের মরুতে এই যে তুমি আজ শুধু আমাকে স্মরণ করে এলে, এর চেয়ে পরম পাওয়া আর কী হতে পারে।

: তোমার বাসায় এসে আমারও খুব ভালো লাগছে। স্টিফেন কী করে মারা গেল শুনবে? ঘটনাটা আমার চোখের সামনেই ঘটেছে।

: হ্যাঁ, বলো।

: না, আজ নয়। ঘটনাটা খুব কষ্টের। আরেক দিন বলব। জোসেফ, আমার খুব ইচ্ছে করছে। শরীরটা কেমন যেন শিরশির করে উঠছে। আমাকে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে না তোমার?

: হ্যাঁ, তোমার গল্পটা লিখব কিনা ভাবছি। শেষাবধি না শুনে সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না।
...

ইসহাক হাফিজ: সিডনি, অস্ট্রেলিয়া। ই–মেইল: <[email protected]>, ফেসবুক: <Ishaque Hafiz>