মিসির আলীর সঙ্গে খুদে বার্তা বিনিময়

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

তোমার তো কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেছে। আর মাত্র সাত দিন। দেশের বাড়িতে গেছিলা? নাকি তোমার আব্বা-মা ঢাকায় আসবে?

ওপরের কথাগুলো আমার কাছে পাঠানো মিসির আলীর খুদে বার্তা। হ‌ুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস পড়তে পড়তে তাঁর সঙ্গে আমার বেশ অন্তরঙ্গতা হয়েছে। তিনি আমাকে বেশ পছন্দ করেন। প্রায়ই তাঁর সঙ্গে আমার খুদে বার্তা বিনিময় ও ফেসবুকে চ্যাটিং হয়। আমি অস্ট্রেলিয়ায় আসার সাত দিন আগে তাঁকে খুদে বার্তা পাঠিয়েছিলাম। তার উত্তরে তিনি ওই খুদে বার্তা পাঠিয়েছেন।

জানালাম, আমরা কুষ্টিয়া যেতে পারিনি। আব্বা-মার আসার কথা আছে। তোমার তো কোনো খবর নাই। তুমি তো আবার ডুমুরের ফুল হয়ে গেলা? আমি ভালোই দৌড়ের ওপর আছি।

মিসির আলী বললেন, একবার তোমাকে খুদে বার্তায় জানিয়েছিলাম আমার পরিচিত একজন লিউকোমিয়া রোগীর কথা। তার ১৮ বছর বয়স। তার সঙ্গে আমার কথা বলতে ইচ্ছা করে। আবার ওর দিকে তাকালে কান্নাও পায়। ওর হাতে হয়তো আর তিন মাস সময় আছে।

: তোমার খুদে বার্তাটা পাওয়ার পর আমার চোখের পানির বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল। কিছু মানুষের সামান্য কথাতেই সবকিছু বলা হয়ে যায়। এমন অর্থপূর্ণ রূপকধর্মী কথা আমি এর আগে কখনোই শুনিনি! আমিও মাঝেমধ্যে পরম করুণাময়ের ওপর রেগে যাই। কেন উনি কিছু কিছু মানুষের জীবনকে এমনভাবে সাজান? তবে উনিই যেহেতু সবকিছু জানেন, তাই নিশ্চয় এর মধ্যেও হয়তো মানবজাতির জন্য কল্যাণ নিহিত আছে। আমি এর আগে এক শিশুকে রক্ত দিয়েছিলাম। তাকে নিয়মিত রক্ত দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল। রক্ত দেওয়ার পর আমি ওই শিশুর সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেই বাবুটার চোখের দিকে তাকিয়ে আর কিছুই বলা হয়ে ওঠেনি। সেই চোখের চাহনি আজও আমাকে তাড়া করে ফেরে।

মিসির আলী ফিরতি খুদে বার্তায় জানালেন, অনেক দিন পর আজ নামাজ পড়লাম। এখন একটু ভালো লাগছে।

আমি লিখলাম, তোমাকে খুদে বার্তা দেওয়ার পর থেকেই আমার মধ্যে দুশ্চিন্তা কাজ করতে থাকে। না জানি আবার কোন নতুন ভেজালে তোমাকে ফেলে দিলাম। উত্তর পেলে হাঁপ ছেড়ে বাঁচি। আমার এখন অখণ্ড অবসর। তুমি চাইলে খুদে বার্তা দিতে পারো। তবে অবশ্যই নিজের কাজকর্ম ঠিক রেখে। তোমার আর আমার খুদে বার্তায় কথা বলাটা খুব মিস করব বিদেশে গিয়ে।

: তোমার খুদে বার্তা আর মোবাইল নম্বরটা মুছে ফেলেছিলাম। কী অবস্থা, গোছানো শেষ?

: এটা ঠিক করোনি। তোমার সঙ্গে আমার আড়ি। আমার গোছানো চলছে। ওখানে জীবন অনেক কঠিন হবে। একটু আগে এক বড় ভাই ফোন দিয়ে সেটাই বললেন। অনেক খাটুনির জন্য মানসিকভাবে তৈরি হতে বললেন। এখন তোমাকে সত্যি কথাটা বলেই ফেলি। আমি মনে মনে আসলেই ভয় পাচ্ছি। একটু দোয়া করো আমার জন্য।

: জীবন সব জায়গায়ই কঠিন, আমি তো সারা দিন দৌড়াই। আমার কোনো শুক্রবার নেই। ও ঢাকায় যাওয়ার পর থেকে আরও বেশি ব্যস্ত, আগে ও সাহায্য করত, তুমিও পারবা, বাঙালি সব পারে।

: তোমার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক। আসলেই বাঙালি সব পারে। আসলে পরিস্থিতিই সবকিছু শিখিয়ে দেয়। তবে আমার চারপাশে সাহায্য করার জন্য সব সময়ই কিছু মানুষ তৈরি ছিল। বিদেশে তারা থাকবে না হয়তো-বা। এটাই আমার ভয়ের কারণ। আর পরিবেশটাও পুরোপুরি অপরিচিত। আগে আমার আত্মবিশ্বাস ছিল যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করার। কিন্তু ইদানীং অলস হয়ে গেছি। তবে আমার কাছে সব কাজই কাজ। তাই আশা করি সমস্যা হবে না। বাচ্চাদের জন্য ওটা একেবারে স্বর্গরাজ্য। তাই ওদের দিকে চেয়ে হলেও আমরণ যুদ্ধ চালিয়ে যাব। এক আত্মীয়ের বাসায় বিদায়ী দাওয়াত খেতে এসেছি। এটা ভালোই উপভোগ করছি। নামাজও পড়লাম। তাই মনটা ভালো।

দুই.

এরপর তিন দিন আমাদের যোগাযোগ নেই। মিসির আলীকে কয়েকবার খুদে বার্তা পাঠিয়েছি। কোনোটারই ফিরতি বার্তা পাইনি। রাতে মিসির আলীকে অনলাইনে দেখে ফেসবুকে লিখলাম, তোমার কী খবর?

: ঘুমাও নাই? রাত জেগে ফেসবুকিং, পাগলের ডাক্তার দেখানো দরকার।

: তিন দিন তোমার খুদে বার্তা না পেয়ে ফেসবুকে যোগাযোগ করলাম।

: দুঃখিত। ঘুম পাচ্ছিল এই জন্য আর খুদে বার্তা দেই নাই। ক্লান্তও ছিলাম। তোমার কী খবর? বাচ্চার কিছু ওষুধ বাড়তি নিয়ে নিয়ো।

: ঘুম পাচ্ছে, ঘুমাতে যাব। এটুকু অন্তত লিখতে পারতা? আমার খবর ভালোই, সময় খুব দ্রুতই ফুরিয়ে যাচ্ছে। বাবুতো ওখানে সবকিছুই বিনা মূল্যে পাবে। তুমি কেমন আছ?

: হুঁ জানি, কিন্তু আমি এমনই। মাঝে মাঝে আমি ডুব মারি, তখন কথা বলতে ভালো লাগে না, তুমি আর মাত্র চার দিন আছ, তাই এত খুদে বার্তা দেওয়ার কী আছে? ওখানে তো অর্ধেক চলেই গেছ।

: এটা ভালো অভ্যাস। ছাত্রজীবনে আমিও মাঝে মাঝে এভাবে ডুব মারতাম। এতে চারপাশের কোলাহল থেকে নিজেকে আলাদা করে একটু স্বস্তিতে দম ফেলা যায়। একটা কথা আছে না, শেষ হইয়াও হইল না শেষ। তেমনি এত খুদে বার্তা দেওয়ার পরেও মনে হচ্ছে যদি আর একটু কথা বলতে পারতাম। আসলে কেউই চায় না সুন্দর স্বপ্নটা দ্রুত ভেঙে যাক। মনে হয় আরও একটু দীর্ঘায়িত হলে ভালো হতো। ওখান থেকে যদি মাঝে মাঝে খুদে বার্তা দিই, তুমি কি রাগ করবা? আসলে কেউই চায় না একজন নিঃস্বার্থ ভালো বন্ধুকে হারাতে। আমি চলে গেলে তোমাকে আর কেউ বিরক্ত করবে না, আর ডুবও দেওয়া লাগবে না? আর তো মাত্র তিনটা দিন!

: আমাকে ডুব দিয়েই থাকতে দাও, এত এত দুর্নীতি আর ভালো লাগে না, কী অসহায় আমাদের রোগীগুলো! ডুব দেওয়াটা সমাধান না, কিছু করতেই হবে।

: চারদিকে এত এত দুর্নীতির মাঝেও তোমার আমার মতো মানুষও আছে। উটপাখির মতো ঝড় এলে মাটির মধ্যে মাথা গুঁজে শান্তি খোঁজাটা যেমন বোকামি, তেমনি ঝড় দেখে পালিয়ে শান্তি খোঁজাটাও কাপুরুষতা। যেমন আমি। তোমার এই যুদ্ধ করার স্পৃহাটা অটুট থাকুক সারাটা জীবন। দূর থেকে তোমার জন্য এই দোয়া করি এবং আমি জানি, তুমি এটা পারবা। শুধু মনে সাহস রেখো। আল্লাহ তোমার সহায় হোন, আমিন। আমি একটু একটু করে সব গোছাচ্ছি।

যা হোক, এই চার দেয়াল আমার দেশ? আমার একলা থাকার অভ্যাস।

: এ কথার মানে বুঝলাম না, বুঝতে পারছি বিদেশ যাওয়ার আনন্দে তোমার মাথা আউলাইয়া গেছে।

: সুখে থাকতে ভূতে কিলায়। ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী হয়ে থাকলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। তখন বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য ফেসবুক আর মোবাইলের জানালা খুলে বসি। তুমি আমার সেই জানালা যেটা দিয়ে প্রশান্তির বাতাস আসে। তাই সময়ে অসময়ে তোমাকে বিরক্ত করি। কিছুই ভালো লাগছিল না, তাই তোমাকে ওই খুদে বার্তাটা দিয়েছিলাম। আর আমি মোটেও খুশিতে টগবগ হয়ে বিদেশ যাচ্ছি না, ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য যাচ্ছি, হুঁ। তোমার মন মেজাজ কি এখন একটু ভালো?

: তিন দিন পর রঙিন দুনিয়া। এমনিতেই মন ভালো হয়ে যাবে। বিদেশ যাচ্ছ ভালোভাবে বাঁচার জন্য। তার মানে এখানে মৃতপ্রায় ছিলে? আজব! আমি বললেই শুধু দোষ, আজব দুনিয়া!

: ঠিক আছে আমি এখন ঘুমাব। আমি সুখী মানুষ। শেষ ঘুমের রেকর্ড ছিল ১১ সেকেন্ড। খুদে বার্তা দিতে দিতেও ঘুমিয়ে যেতে পারি তাই খোদা হাফেজ, শুভ রাত্রি।
...

মো. ইয়াকুব আলী, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া। ই-মেইল: <[email protected]>