চকবাজারের কথা

এইচএসসি পরীক্ষার পরপর আমার আপু আমাকে নিয়ে এলেন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেলের হোস্টেলে, সেখানে থেকে শুভেচ্ছা কোচিং সেন্টারে মেডিকেলের কোচিং করব বলে। প্রচণ্ড ফাঁকিবাজ ছিলাম বলে ঢাকায় অন্য কোথাও থাকার অপশন ছিল না। নানুর বাসা ছিল মগবাজারে। এটা ১৯৯১ সালের কথা।

জীবনে প্রথম হোস্টেলে থাকা শুরু হয়ে গেল। বোনটা বেশি টাকা দিয়ে বিদেশিদের সঙ্গে আমার খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। তাঁর আত্মত্যাগের অনেক গল্প আছে, যা কোনো সিনেমার গল্পকেও হার মানাবে। কোনো এক ভাইবোন দিবসে হয়তো তা বলা যাবে। অল্প কিছু বছরের বড় হয়ে এত তাঁর ভালোবাসা আর সারা জীবন শুধু দিয়ে যাওয়া স্বভাবের কথা বলতে গিয়ে প্রায়ই ভাষা হারিয়ে ফেলি, এটা নতুন কিছু না।

এখন আকাশভাঙা কান্না নিয়ে বসে আছি কত দিন ধরে। আপু কোনো দিন একা যেতে দিতেন না। মেডিকেল থেকে বকশিবাজার শুভেচ্ছা কোচিং সেন্টারে যেতে অনেক সময় লাগত। রিকশাওয়ালাদের অসীম ধৈর্য আর সময়মতো নামিয়ে দেওয়ার যে কর্তব্যপরায়ণতা, খুব শ্রদ্ধা ভরে লক্ষ করছি। তারা কেউ কেউ ওদিকেই থাকতেন। সবাই কি পুড়ে গেছেন? মানবতা বাঁচিয়ে রাখবেন কারা?

লেখিকা
লেখিকা

ভালো রেজাল্ট করলে আপু আনন্দ বেকারিতে নিয়ে যেতেন। আনন্দের ফ্রুট কেক খুব মজা ছিল। অন্য খাবার তো ছিলই। এখনো কানে বাজছে ‘ছোট আপা আবার পরীক্ষায় ভালো করছে, না?’

আপুর এক রুমমেটের আত্মীয় থাকতেন কাছে। একদিন ওই আপু নিয়ে গেলেন তাঁদের বাসায়। মনে আছে, টেবিলের এ মাথা থেকে ও মাথা শুধু খাবার ছিল। সেদিন বিকেলটা তাঁদের ছাদে ছিলাম। কত কাছাকাছি ছিল বাড়িগুলো। খুব অবাক লেগেছিল। আসার সময় এতগুলো খাবার বেঁধে দিয়েছিলেন সঙ্গে আর বলেছিলেন, ‘মামণি, যখন মা-বাবার কথা মনে পড়বে চলে এসো।’ চোখ শুধু ঝাপসা হয়ে আসছে। কথাগুলো বারবার শুধু মনে পড়ছে।

সব মিলিয়ে দেড়-দুই মাস ছিলাম আপুর হোস্টেলে। ও ইন্টার্নশিপ নিয়ে ব্যস্ত ছিল। কত মানুষ খাবার এনে দিত। সেই বুয়ারা, কত কত লোকাল আপুরা কত যত্ন করেছিলেন। সব সময় সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন ওঁদের কনসার্টে। সব পুড়ে যাওয়া ছবি দেখছি, দোয়া করছি সবার জন্য। এত ভালো মানুষগুলো, এত কষ্ট কেন তাঁদের?

আবাসিক এলাকা থেকে কারখানা সরিয়ে ফেলতেই হবে, যেভাবেই হোক। এতগুলো নিরীহ মানুষের জীবন এভাবে চলে যাবে, এটা মেনে নেওয়া যায় না।