অস্ট্রেলিয়ানের বাংলা শেখা

লেখিকার সঙ্গে কেইট ও ক্যাথরিন
লেখিকার সঙ্গে কেইট ও ক্যাথরিন

প্রস্তাবটা আসে গত বছরের নভেম্বরের প্রথম দিকে। ফেসবুকের একটা পোস্টে চোখ আটকে গেল। এক অস্ট্রেলিয়ান নারী বাংলা ভাষা শিখতে ও বাঙালি সংস্কৃতি জানতে চান। মাইক শেন, তাঁর স্ত্রী ক্যাথরিন ও তাঁদের ছেলে সায়মন কয়েক মাস পরে বাংলাদেশে যাবেন। মাইক একটি এনজিওতে কাজ করেন, যার একটি প্রকল্প পরিচালিত হবে বাংলাদেশে। সেই সুবাদেই প্রাথমিকভাবে চার বছরের জন্য তাদের বাংলাদেশে যাওয়া। প্রকল্পের সফলতার ওপর নির্ভর করে সেটা ১০ বছর পর্যন্ত বর্ধিত হতে পারে। তাই মাইক মোটামুটি ১০ বছরের জন্য বাংলাদেশে থাকার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সেই প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ক্যাথরিন বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতিটা শিখে নিতে চাচ্ছেন, যাতে বাংলার মানুষের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারেন।

প্রস্তাবটি প্রথম দেখাতেই ভালো লাগে ও অনেকটা আবেগ কাজ করল। এই দূর পরবাসে বসে কোনো বিদেশিকে বাংলা শেখাতে পারব, আমার সংস্কৃতি নিয়ে কথা বলতে পারব, সেটাই বা কম কিসে। যেখানে ওদের ভাষা শিখতে শিখতে আমাদের আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়। তা ছাড়া আমার স্বামী তার পিএইচডির কাজে দিনের অধিকাংশ সময় ল্যাবে থাকায় আমার একাই বাসায় সময় কাটে। তাই সবকিছু ভেবে মাইকের সঙ্গে যোগাযোগ করে আমার আগ্রহের কথা জানলাম। মাইকও আমার আগ্রহে সাড়া দিয়ে প্রাথমিক আলাপচারিতা আর পরিচিতি পর্ব সেরে নেওয়ার জন্য আমাদের দুজনকে তাঁদের বাসায় আমন্ত্রণ জানালেন। ক্রিসমাসের ছুটির এক সন্ধ্যায় উপস্থিত হলাম মাইকের বাসায়। আমরা খুবই উৎসাহিত ছিলাম। কারণ ওটাই ছিল কোনো অজি (অস্ট্রেলিয়ান) পরিবারের বাসায় প্রথম আমন্ত্রণ। মাইক অবশ্য আগে থেকেই হালাল ও বাঙালি খাবার পরিবেশনের আশ্বাস দিয়ে রেখেছিলেন। তাই আমরাও খাবারের ব্যাপারে বেশ নির্ভার ছিলাম। পরিচিত হলাম মাইকের স্কুলশিক্ষক মা-বাবার সঙ্গে। তাদের বাসায় আরও পরিচিত হলাম মাইকের বন্ধু কেইটের সঙ্গে। কেইটও যাবেন বাংলাদেশে একই প্রকল্পে। কেইট জানালেন, যদি আমার কোনো আপত্তি না থাকে তবে তিনিও ক্যাথরিনের সঙ্গে বাংলা শিখতে চান। আমার সম্মতিতে তিনি আনন্দে লাফাতে শুরু করলেন।

যা হোক, সবাই একসঙ্গে খাবার টেবিলে বসলাম। বিদেশিদের পারিবারিক বন্ধন কম, আমাদের সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো সবার প্রাণবন্ত আলোচনায়। এটাও বুঝলাম, মাইকের বাংলাদেশ যাওয়া নিয়ে তাঁর বৃদ্ধ মা-বাবার চিন্তার শেষ নাই। তাঁরা আমাদের কাছে জানতে চাইলেন বাংলাদেশের খুঁটিনাটি অনেক বিষয় ও বিদেশিদের জন্য কতটা নিরাপদ ইত্যাদি। আমরাও চেষ্টা করেছি তাঁদের যতটা সম্ভব আশ্বস্ত করার। আমাদের আপ্যায়নে ছিল যথেষ্ট আন্তরিকতা। মাইকের বাঙালি স্টাইলে রান্না করা তন্দুরি চিকেনের সঙ্গে অল্পবিস্তর সেদ্ধ বরবটি সবজি বেশ উপাদেয়ই ছিল। মূল আকর্ষণ ছিল ডেজার্টে। ক্রিসমাস কেক, ফলের জুস, বিভিন্ন ধরনের ফল, তাসমানিয়ার বিশুদ্ধ মধু ও শ্রীলঙ্কান কেক! কী ছিল না? অবশেষে চূড়ান্ত হলো, জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকেই শুরু হবে ক্যাথরিন আর কেটের বাংলা স্কুল।

আমার বাসায় শুরু হওয়া বাংলা স্কুলের প্রথম দিনে যোগ দিলেন রেবেকা। তিনি বিদেশি ভাষা কীভাবে সহজে রপ্ত করা যায়, সে ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ। তো তিনিই মূলত আমাকে কয়েক দিন শিখিয়ে দেবেন কীভাবে আমি তাঁদের বাংলা শেখাব। যদিও তিনি নিজেও বাংলা জানেন না। কিন্তু জানেন কীভাবে একটি নতুন ভাষা আয়ত্ত করা যায়। প্রথমে শুরু হলো দৈনন্দিন ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসের সঙ্গে বাংলায় পরিচিত হওয়া। এ জন্য তারাই কিছু জিনিস নিয়ে এসেছেন, যেমন বিভিন্ন ফল, সবজি, মসলা ইত্যাদি। আমার কাজ হচ্ছে প্রথমে এগুলোর নাম বলা। তাদের কাজ হচ্ছে শুধু শুনে মনে রাখা আমি ঠিক কী নামে এগুলোকে ডাকছি। তারপর আমি শুধু একটি একটি করে জিনিসগুলোর নাম বলব আর তাদের কাজ হচ্ছে একটা একটা করে সেগুলোকে খুঁজে বের করা।

এভাবেই কেটে গেল বাংলা স্কুলের প্রথম দিন। আর ফাঁকে ফাঁকে জানালাম বাংলাদেশের সংস্কৃতির টুকিটাকি। আস্তে আস্তে শুরু হলো শুধু বাংলা ক্রিয়াগুলোর সঙ্গে পরিচিত হওয়া, যেমন যাওয়া-খাওয়া ইত্যাদি। এরপর প্রথমে যে বস্তুগুলোর নাম জেনেছেন সেগুলোর সঙ্গে ক্রিয়া যুক্ত করে ছোট ছোট আদেশ বাক্য বলতে শুরু করলাম। যেমন পানি খাও, গাজর সরিয়ে রাখো কিংবা কলা খাও। আর তারা আমার আদেশ শুনে প্রথমে বোঝার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যেতেন। তারপর সে মতো কাজগুলো সম্পন্ন করতেন। এভাবেই আস্তে আস্তে অন্য পদগুলো শিখিয়ে বড় বড় বাক্য বলতে শুরু করলাম আর তাদের বিপদও আস্তে আস্তে বাড়তে থাকল। কখনো বড় বাক্য শুনে বুঝতে বুঝতে এক দুই মিনিট লেগে যেত আবার কখনো কখনো জটিল বাক্য শুনে মেঝেতে গড়াগড়ি খেত। সত্যি সে দৃশ্য ভোলার মতো না।

এভাবেই আস্তে আস্তে শ্রবণ অধ্যায় সফলভাবে সম্পন্ন করে কথ্য অধ্যায় শুরু হলো আমাদের বাংলা স্কুলে। মানে তারা এবার বাংলা বলতে শিখবেন। শুরু হলো তাদের দাঁত ভাঙার দিন। শুরু করলাম সহজ সহজ শব্দ ও ত, দ অক্ষর বিশিষ্ট শব্দ দিয়ে যেগুলোর সঙ্গে তাঁরা পরিচিত না। প্রথমেই শেখালাম ‘ব্যাংলাডেশ’ না, ‘বাংলাদেশ’। তবে এ কথা আমাকে স্বীকার করতেই হবে, তাঁদের বাংলা শেখাটা ছিল সাবলীল, আন্তরিক আর সে জন্যই খুব সহজেই সবকিছু সুন্দরভাবে শিখতে পেরেছিলেন। আর অনেক আনন্দ আর শ্রদ্ধায় ভরপুর ছিল তাঁদের বাংলা শেখার মুহূর্তগুলো।

আবার মাঝে মাঝে যখন বাংলা বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে পড়তেন, তখন অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে বিভিন্ন প্রাণীর ভূমিকায় অভিনয় করতেন আর আমি সেগুলোর বাংলা নাম বলতাম। নামগুলো চরিত্রের সঙ্গে মিলে গেলেও আনন্দ আর না মিললে তো বেশি আনন্দ হতো। তারা সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন যখন কোনো কিছুর বাংলা ও ইংরেজি একই, যেমন গ্লাস, টেবিল এবং ধীরে ধীরে বুঝতে পারলেন ইংরেজি শব্দ বাংলা ভাষায় নেহাত কম নয়। তারপরে অল্পবিস্তর বাংলা লেখার ও পড়ার চেষ্টাও করলেন। বাংলা যুক্তবর্ণ আর একই অক্ষরের বিভিন্ন উচ্চারণ তাদের বেশ অবাক করে এবং তারা স্বীকার করেন যে বাংলা বর্ণমালা অনেক বেশি সমৃদ্ধ। এভাবেই আস্তে আস্তে শেষ হলো হাসি, গল্প, আড্ডা আর সংস্কৃতি বিনিময়ের মজার বাংলা স্কুল।

মধুরেণ সমাপয়েৎ করার জন্য আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো একটি টার্কিশ রেস্টুরেন্টে হালাল ও বিদেশি খাবার খাওয়ানোর জন্য। যদিও মধুরেণ সমাপয়েৎ শব্দটির উচ্চারণের ব্যর্থ চেষ্টায় তারা ঠিক কতগুলো দাঁত হারিয়েছেন, সেটা গোনা হয়নি। আমিও বাংলা স্কুলের শেষ দিনে বাংলা বিরিয়ানি দিয়ে আপ্যায়ন করতে ভুল করিনি। আর শেষের দিন তো ক্যাথরিন আমাকে সারপ্রাইজ দিতে সালোয়ার কামিজ পরে পুরোদস্তুর বাঙালি হয়ে গিয়েছিলেন। আর হ্যাঁ, শেষ দিনে শাড়ি পরাটাও রপ্ত করে নিতে ভুল করেননি আমার কাছ থেকে। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে বাংলা ক্লাসের পাঠ চুকিয়ে, দ্বিতীয় সপ্তাহে কেইট পাড়ি জমান বাংলাদেশের উদ্দেশে। গিয়েই ছবিসহ বাংলাদেশে পৌঁছানোর খবরটি দিতে ভুল করেননি। সবচেয়ে ভালো লাগল মাথায় ফুলের ব্যান্ড পরে পয়লা ফাল্গুন উদযাপনের ছবি দেখে। আর সময় পেলেই মেসেঞ্জারে বাংলা ফন্টে বার্তা পাঠান। যেমন ‘বাংলাদেশ ভালো লাগে’। কয়েক দিন আগে জানতে পারলাম ক্যাথরিনও তার পরিবারসহ নিরাপদে বাংলাদেশ পৌঁছেছে।

জানি না তাঁদের স্বল্পবিস্তর অর্জিত বাংলা দিয়ে কতটুকু খাপ খাওয়াতে পারবেন। যদিও বাঙালিদের আন্তরিকতায় বাকিটা শিখে নিতে হয়তো তাদের বেগ পেতে হবে না। তবে ভাষার মাসে দুই অস্ট্রেলিয়ানকে বাংলা শেখানো আমার কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এই দূর পরবাসে অনেক স্মৃতির মাঝে বাংলা ভাষাকে ছড়িয়ে দেওয়ার এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টার আনন্দময় স্মৃতিটা বোধ হয় একটু বেশিই দীপ্তিময় হয়ে থাকবে।