চলুন ভেতর থেকে বদলাই

সারা রাত না ঘুমিয়ে কান্নাকাটি করলে যা হয় আরকি! পরদিন নাক চোখ মুখ লাল করে অফিসে গেলাম আর ম্যানেজারকে বললাম, আমি বাংলাদেশে যাব না, আমার ছুটি মঞ্জুর করার দরকার নেই। ম্যানেজার তাঁর চশমার ফাঁক গলিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কেন কী হয়েছে? আমি বললাম, আমার পাসপোর্টের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। আমার এবার দেশে যাওয়া হবে না। তিনি বললেন, তোমার তো এ ব্যাপারটা খেয়াল করার দরকার ছিল। আমি খুব বিষণ্ন হয়ে বললাম, পাসপোর্ট আমার স্বামীর কাছে রেখেছিলাম, তিনি ব্যাপারটা খেয়াল করেননি। গতকাল টিকিট বুকিং দিতে গিয়ে টের পেয়েছি যে আমার পাসপোর্টের মেয়াদ নেই। এবার তাঁর চশমার ভেতরের চোখগুলো যেন বিস্ফারিত হয়ে বের হয়ে এল! তিনি বললেন, ফারজানা! তুমি কি তোমার লিপস্টিক, পাউডার অথবা যাবতীয় কস্টিউম তোমার স্বামীর কাছে রাখো? আমি না সূচক মাথা নাড়লাম। তাহলে পাসপোর্টের মতো এত গুরুত্বপূর্ণ একটা জিনিস কেন তোমার স্বামীর কাছে রাখবে? আমি আমতা-আমতা করে বললাম, না মানে আমাদের দেশের কালচারে আমরা স্ত্রীরা আমাদের স্বামীর ওপর নির্ভর করতে ভালোবাসি।

এবার ওনার চোখে আমার জন্য তাচ্ছিল্য ছিল। তিনি গলার ভেতর থেকে চাপা আওয়াজে বললেন, ‘I am sorry to say farzana; you asian women always think that you ladies only love husband but I would rather say you ladies don't wanna take responsibility. From my experience, I see Asian women gonna try to push their husband for taking all major decission and you (wife) keep yourselves in safe side!

আমার মাথায় responsibility ও safe side শব্দ দুইটা তিরের মতো বেঁধে রইল। আসলেই তো আমরা বাঙালি নারীরা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বগুলো স্বেচ্ছায় স্বামীর ওপর ছেড়ে দিই। সে ক্ষেত্রে কর্তৃত্ব বা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত তাঁরা নেবেন, সেইটাই স্বাভাবিক। তাহলে সম–অধিকার বলে গলা ফাটানোর যৌক্তিকতা কতটুকু?

টরন্টোতে আমার পরিচিত একজন উচ্চশিক্ষিত (ইংল্যান্ড থেকে MBA ডিগ্রিধারী) প্রতিবেশী আছেন, যাঁর স্বামী সকালবেলা বাসা থেকে অফিসের উদ্দেশে বের হন আর বিকেলে অফিস শেষে উবারে রাত দশটার পর বাসায় ফেরেন। অতিরিক্ত কাজের চাপে তাঁর স্বামীকে প্রায় ব্যাকপেইনজনিত কারণে হসপিটালে ইমার্জেন্সিতে ভর্তি হতে হয়। আমি একদিন কথায় কথায় বললাম, ভাবি, আপনার এডুকেশনাল ব্যাকগ্রাউন্ড এত ভালো, আপনি তো চাইলেই চাকরি করতে পারেন। তিনি বললেন, তাঁর ছেলেকে ডে–কেয়ারে রেখে মানুষ করতে চান না। আর সারা দিন অফিস করে আবার ঘরের কাজ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব না। বিয়ে করেছেন যেহেতু, সেহেতু তাঁর সুখ–স্বাচ্ছন্দ্য দেখার দায়িত্ব তাঁর স্বামীর!

অথচ যখনই তাঁর বাসায় গিয়েছি, ওনার ছয় বছরের বাচ্চাটাকে ট্যাব নিয়েই ব্যস্ত থাকতে দেখেছি। বাচ্চার জন্য বাসায় tutoring-এর ব্যবস্থা করেছেন। অতিথি এলে তিনি ক্যাটারিং থেকে খাবার নিয়ে অতিথি আপ্যায়ন করেন। চাকরির ব্যাপারে তাঁর স্বামীর তরফ থেকেও কোনো আপত্তি নেই। তবে তিনি ছেলে অন্যের হাতে মানুষ করবেন না, এই লজিক দিয়ে দিব্যি হাসিখুশি দিনযাপন করছেন!

একজন উচ্চশিক্ষিত নারী যখন নিজেকে এইভাবে উপস্থাপন করতে ভালোবাসেন, সেখানে আসলে বর্তমান যুগে নারীদের অগ্রগামীতে পুরুষেরা কতটা বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তা আমার কাছে বোধগম্য নয়!

দেশে থাকতে আমার বাসায় অল্পবয়স্কা একজন গৃহপরিচারিকা ছিল। মেয়েটি যখন সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা, তখন সে টের পায়, তার স্বামী খারাপ পাড়ায় যাতায়াত করে। অনেক বোঝানোর পরেও যখন স্বামীকে সঠিক রাস্তায় আনতে পারেনি, তখন থেকে সে তার স্বামীর সঙ্গে একঘরে থাকা বন্ধ করে দেয়। আমি বললাম, চার বছর ধরে তুমি তোমার স্বামীর সঙ্গে থাকছ না, বাচ্চার জন্য কোনো আর্থিক সুবিধাও নিচ্ছ না, তাহলে ডিভোর্স না দিয়ে এভাবে আছ কেন? মেয়েটি বলল, ‘আফা, বাচ্চার বাপের অন্য মেয়ে মানুষের শরীর পাইলে চলে, তাই আমার শরীর আমি তারে দিই না। যুদ্ধটা আমার সঙ্গে তাঁর। বাচ্চাডারে কেন বাপের আদর থাইক্যা সরাইয়া রাখুম?’ আমার বিস্ময় আকাশ ছোঁয়। আমি অবাক হয়ে আমার চেয়ে অর্ধবয়সী অশিক্ষিত কোনো এক অজপাড়াগাঁর নারীর ব্যক্তিত্বের কাছে নিজেকে খুব তুচ্ছ ভাবতে থাকি!

মাঝেমধ্যে অনেক উচ্চশিক্ষিত নারীর ভাবনা যেমন আমাকে হতবিহ্বল করে, ঠিক তেমনি অক্ষরজ্ঞানহীন নারীর আত্মমর্যাদাবোধও আমাকে বিস্মিত করে!

লেখিকা
লেখিকা

নারীর আত্মসম্মান বোধ, নারীর ব্যক্তিত্ব, নারীর স্বাধীনতা—এগুলোর প্রস্ফুরণের জন্য উচ্চশিক্ষা বা পুরুষের সহযোগিতা কি আসলেই মুখ্য? এবার দেশে গিয়ে ব্যক্তিগত কাজে ঢাকার বেশ কয়েকটা বড় বড় ব্যাংক ও করপোরেট অফিসে যেতে হয়েছিল। রাস্তাঘাটে জিনস-টপ পরা মেয়েদের আধিক্য যতটা চোখে পড়েছে, সেই অর্থে অফিস আদালতে কর্মজীবী মেয়েদের সংখ্যা ততটা বাড়েনি বললেই চলে। আমরা নিজেদের পাশ্চাত্য পোশাকে আবৃত করতে যতটা অগ্রগামী, ঠিক ততটা যদি নিজের মন-মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে পারতাম, তবে দেশ থেকে হাজার মাইল দূরে অন্য কোনো নারীর কাছ থেকে এশিয়ান নারীদের দায়িত্ব নেবার বেলায় গড়িমসি করে এই অপবাদ মাথা পেতে নিতে হতো না।

যুগ বদলেছে। আজকাল একজন গরিব বাবা-মাও চান, তাঁদের মেয়ে সন্তানটি লেখাপড়া শিখুক, নিজে স্বাবলম্বী হোক। ব্যাপারটা এমন নয় যে প্রত্যেক নারীকে ঘরের বাইরে গিয়ে কেবল উপার্জন করতে হবে। আপনি চাইলে ঘরে বসে অনলাইনে ব্যবসা করতে পারেন। ক্যাটারিং শুরু করতে পারেন। হাতের কাজ বা সেলাইয়ের অর্ডার নিতে পারেন। প্রয়োজনে বেবি সিটিংও করতে পারেন। এতে আরেকজন কর্মজীবী মায়ের যেমন সাহায্য হবে, তেমনি আপনিও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবেন। সন্তান লালন–পালনের পাশাপাশি সংসারের আর্থিক বিষয় দেখভাল করাও আপনার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এই অনুধাবন যখন করতে শিখবেন, তখন ভেতর থেকেই উপলব্ধি করবেন আপনিও পারেন—পাশের উপার্জনক্ষম পুরুষটির মতো! আপনিও পারেন সঠিক সিদ্ধান্তকারীর মতো! আপনিও পারেন একজন সচেতন মানুষের মতো!

উন্নত বিশ্বের নারীদের মতো নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে চাইলে কেবল ঢালাওভাবে সমাজকে দায়ী না করে চলুন পরিবর্তনটা প্রথমে নিজের মধ্যে আনি। ভেতর থেকে বদলাই, তাহলে উন্নয়ন হবে আমার-আপনার-আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নারীসহ পুরো দেশের।

সবাইকে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের শুভেচ্ছা।