অন্তঃক্ষরণ

মায়ের সঙ্গে লেখক
মায়ের সঙ্গে লেখক

মাকে নিয়ে অনেকবার লেখার চেষ্টা করেছি। লেখা হয় না! অন্যের থমকে যাওয়া গল্প গদ্য–কথায় ফুটিয়ে তোলা যায়। নিজেরটা যায় না। অনেক বেশি মানসিক শক্তি লাগে। সবার এত মানসিক শক্তি থাকে না। লিখতে বসলে মস্তিষ্ক অসাড় হয়ে আসে। শব্দগুলো ঠিক পাশাপাশি সাজানো যায় না। বাক্যগুলো এলোমেলো হয়ে যায়। তিনটি মাস গত হতে চলল। সারাক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকতে ইচ্ছা করে। চোখ বন্ধ করলেই মাকে দেখতে পাই। মাকে ঘিরে কত–কী জীবনের গল্প! মা আমাকে খাইয়ে দিচ্ছেন। মা আমাকে আদর করে মাথায় গালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। স্কুল পালিয়েছি বলে লাঠি হাতে খুঁজতে বেরিয়েছেন। বুকপকেটে বলপয়েন্ট কলমের কালি লেপ্টে থাকা সেই ছোট্ট নীলাভ সাদা স্কুলড্রেসটা পরিয়ে দিচ্ছেন। স্কুলড্রেসটা নীল দিয়ে ধুয়ে রোদে মেলে দিচ্ছেন। খটখটে মাড় দেওয়া ছোপ ছোপ নীলের দাগ জামার এখানে–ওখানে ছড়িয়ে রয়েছে। প্রচণ্ড শীতে কাঁপছি বলে আমার ছোট্ট ঠান্ডা শরীরকে কোলের মধ্যে জড়িয়ে নিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছেন। ভাত ভাজা খেতে চেয়েছি বলে মা তাঁর ক্লান্ত শরীর নিয়েই ভাত ভাজতে বসে গিয়েছেন।

মাকে ছাড়া আমার জীবন একেবারেই চলেনি। এক মুহূর্তের জন্যও চলেনি। বিশেষ করে পরিবারে আমি কনিষ্ঠ সদস্য হওয়ার জন্য আমার আবদার ছিল অনেকখানি বেশি। মা ছাড়াও পৃথিবীতে আমার একটা জীবন থাকতে পারে, কখনো অনুভব করে দেখিনি। এখন কত কিছুই না ভাবতে হয়। কত সব নিষ্ঠুর বাস্তবতা মেনে নিতে হয়। মায়ের স্নেহের ছায়ায় বেড়ে উঠেছি। মায়ের হাতে মাখানো ভাত খেয়েছি। মাঝেমধ্যে মা খুব বিরক্ত হয়ে যেতেন। আমার জ্বালাতনে বিরক্ত হয়ে বড় বড় ভাতের দলা পাকিয়ে মুখের ভেতরে জোর করে ঠেসে দিতেন। ধাক্কায় উল্টিয়ে পেছনে শুয়ে পড়তাম। অবশ্য পেছনে বালিশ পাতাই থাকত। মা অবজ্ঞা করে ঠেলে শুইয়ে দিয়েছেন। তাতে কী? মায়ের কাছে কোনো অসম্মান নেই। কোনো অপমানবোধ নেই। বরং মজা পেতাম। চিত হয়ে শুয়ে পড়তাম। মা আবারও বাহু ধরে টেনে বসিয়ে আরেক দলা মাখানো ভাত মুখে ঠেসে দিতেন। আবারও চিতপটাং।

বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানের সম্পর্কটা বড়ই অদ্ভুত। মস্ত পৃথিবীতে শুধু মা ও বাবা এই দুজন মানুষই আছেন, যাঁরা খোঁটা দিয়ে কথা বললেও অন্তঃক্ষরণ হয় না। হাজারো অপমান করলে সে অপমান আর অপমান মনে হয় না। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালেও মায়ের হাতে মাখানো ভাত খেয়েছি। কিন্তু একটা সময় পরে আর মায়ের হাতে খাওয়া হয়ে ওঠেনি। মায়ের বয়স হয়ে গিয়েছিল তো! নিজেরও শুচিবাই অনেকটা বেড়ে গেল। বয়স্ক মানুষটার হাতটাকে অপরিচ্ছন্ন মনে হতে লাগল। তাই তাঁর হাতে খেতে একটু অস্বস্তিই লাগত।

দিনভর বাবা-মায়ের খুনসুটি আর ঝগড়া দেখে মনে হতো তাঁদের পুরোনো সংসারের ভালোবাসাটা বোধ করি অতটা দৃঢ় নয়। অথবা ওই যুগে ভালোবাসা জিনিসটার থেকে পরিবারের দায়বদ্ধতা একটু বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অথচ আমার সব ভাবনাচিন্তা উড়িয়ে দিয়ে দুই জগতের দুই ভালোবাসার মানুষ মুহূর্তেই এক হয়ে গেলেন। আব্বা ও মায়ের চলে যাওয়ার পরে নিজেকে আর গুছিয়ে নিতে পারিনি। কারও সান্ত্বনাও নিতে ইচ্ছা করেনি। সবার সান্ত্বনা দেওয়ার পথটাও রুদ্ধ করে রেখেছি। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি। একরকম নিভৃত জীবন বেছে নিয়েছি। গতানুগতিক সান্ত্বনায় এই বুকফাটা কষ্টটা ঠিক পরিপূর্ণভাবে লাঘব হয় না। নিজেও কখনো কাউকে এমন দুঃসময়ে সান্ত্বনা দিতে পারিনি। সান্ত্বনা দেওয়ার বদলে পালিয়ে বেড়াই। ঘাপটি মেরে পড়ে থাকি।

এ হয়তো শুধু আমারই ব্যর্থতা! কারও বিচ্ছেদে সান্ত্বনা দিতে পারি না। এমন বিচ্ছেদে ঠিক কী বলে সান্ত্বনা দেয় মানুষ? নাকি শুধু কথার কথা! বাস্তবতা আসলে চরম ভয়ংকর। জগৎসংসার কিছুই ভালো লাগে না। চোখ মেলে কিছু করতেও ইচ্ছা হয় না। চোখ মেললেই আব্বা-মা সামনে থেকে হারিয়ে যান! আব্বা-মাকে হারাতে ইচ্ছা করে না। নিরিবিলি চোখ বন্ধ করে ঘরের এক কোণে জড় পদার্থের মতো পড়ে থাকতে ইচ্ছা করে। কুষ্টিয়াতে আমাদের বাসার কাছেই সরকারি অনাথ আশ্রম। ছোট ছোট বাচ্চা রাস্তাঘাটে দেখতাম। ওদের এক নজর দেখে খুব সহজেই অন্য সবার থেকে আলাদা করা যেত। প্রিন্টের সুতির থান কাপড় কেটে বানানো একই রকম সবার পোশাক। তাদের মলিন মুখ দেখে মায়া লাগত বটে তবে কখনো তাদের অন্তরে যে শূন্যতা আছে, সেই গভীরতা পরিমাপ করতে পারিনি। পৃথিবীতে আগমন যাদের অবদানে, তারাই আজ অস্তিত্বের পরিধির মধ্যে নেই। কী অসীম মানসিক শক্তি!

বয়স যত বাড়ছে, ততই প্রিয় মানুষগুলোর লাশের মিছিল লম্বা হচ্ছে। মাত্র কিছুদিন হলো আমার দাদিশাশুড়ি চলে গেলেন। আমাদের দুই কুলে পূর্বপুরুষের তালিকায় তিনি ছিলেন সর্বশেষ সদস্য। আমার কুলে পূর্বপুরুষের কেউ বেঁচে নেই। আমার স্ত্রীর কুলে তিনিই ছিলেন শেষ সম্বল। দুই বছরের বিবাহজীবনে তাঁকে দেখেছি দুই-তিনবার। আর কখনো তার মুখখানা দেখতে পাব না। জার্মানিতে আসার পরে চেনাজানা অনেকের মুখ দীর্ঘদিন দেখার সৌভাগ্য হয়নি। দেশে থাকতে যখন দিনরাত তাদের চোখের সামনে পেতাম, তখন আলাদা কোনো মায়া তৈরি করতে পারিনি। এখন খুব মায়া হয়। ঠিক পরিবারের সদস্যদের মতো। তারা পৃথিবী থেকে চলে গেলে আট হাজার কিলোমিটার দূর থেকেই একধরনের শূন্যতার ঝাপটা মনের ভেতরটায় ধাক্কা দিয়ে যায়।

এক এক করে সবাই চলে যাচ্ছেন। বড় দুলাভাই চলে গেলেন আমি জার্মানিতে আসার ঠিক দুই মাস পরে। জার্মানি আসার আগে তার সঙ্গে দেখা করে এসেছিলাম। তখন মনে হয়নি এটাই শেষ দেখা, আর দেখা হবে না। খুব আদর করতেন আমাকে। এর ছয় মাসের ব্যবধানে আমার খালু চলে গেলেন। জার্মানিতে আসার আগে তার সঙ্গেও দেখা করে এসেছিলাম। এবারে দেশ থেকে ঘুরে আসার সময় দেখা করেছি সেজো বোনের শ্বশুরের সঙ্গে। তাকে খুব ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছি। তিনিও চলে গিয়েছেন। এখনো চেহারাটা চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে। আব্বার সঙ্গে ছিল তাঁর বন্ধুসুলভ সম্পর্ক। দুজন একসঙ্গে বসলে গল্পের ফুলঝুড়ি বয়ে যেত। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! দুজন আজ কাছাকাছিই শুয়ে আছেন। জানি না তারা সেই গল্পের আসর বসিয়েছেন কি না।

মাকে যখন শেষবারের মতো দেখলাম। মা তখন চা পান করছিলেন। মশারির মধ্যে কাত হয়ে শুয়ে চা পান করছেন। ভারী শরীর নিয়ে তার ওঠার ক্ষমতা ছিল না। বালিশ থেকে হালকা মাথাটা উঁচিয়ে স্বচ্ছ চায়ের কাপটা বাঁকা করে তিনি মুখে নিয়েই পুনরায় শুয়ে পড়ছিলেন। মায়ের কথাগুলো জড়িয়ে যাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে না কী বলতে চাইছেন। মাকে যখন শেষবার দেশে গিয়ে দেখে এলাম, তখনো ভাবিনি এই ছিল তাঁকে শেষ স্পর্শ। তাঁর দুই গালে সেটাই ছিল শেষ চুম্বন। আর কখনো তাঁকে স্পর্শ করতে পারব না। মা বলে ডাকতে পারব না। শূন্যে তাকিয়ে মা বলে ডাকতে পারব হয়তো। কিন্তু সেই ডাকে কোনো প্রতিধ্বনি থাকবে না।

আমি জার্মানিতে গবেষণার কাজ করি। দিনের প্রভাত, মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ ল্যাবরেটরিতেই কাটাতে হয়। ব্যস্ততায় মায়ের সঙ্গে কথা বলার সময় হতো না। কয়েক দিন আগে একবার কথা হয়েছে। আঁচ করতে পারিনি মায়ের সঙ্গে বিচ্ছেদের সময় ঘনিয়ে আসছে। জানতে পারলে হয়তো তাঁকে চোখের আড়াল হতে দিতাম না। ডায়বেটিসের রোগী মা আমার পানসে চায়ে কী যে মজা পেতেন, বুঝতে পারতাম না। ছোটবেলা থেকেই দেখেছি। গ্রামের মেয়ে হলেও মায়ের ছিল খুব চায়ের নেশা। আমার মায়ের প্রেসক্রিপশনের কোথাও সাদা জায়গা বলতে ছিল না। পুরোটা জুড়েই ওষুধের লম্বা ফর্দ। এত পরিমাণ ওষুধ তাঁকে প্রতি বেলাতেই খেতে হতো যে মনে হতো ওষুধেই তাঁর খিদে অনেকটা মিটে যায়। প্রতি বেলাতে কমপক্ষে সাত-আট রকমের ওষুধ! একটা মানুষের এত বৈচিত্র্যময় অসুখ থাকতে পারে! মাকে না দেখলে হয়তো জানাই হতো না। প্রতিদিন তিনবেলা ইনসুলিনের সুচে তাঁকে ক্ষতবিক্ষত হতে হতো। তার ওপরে সপ্তাহান্তে একবার ডায়াবেটিস টেস্টের জন্য সুচের খোঁচা। তার এই দুর্বল নুইয়ে পড়া মুখের দিকে তাকানো যেত না। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে এই মানুষটি আমাদের মতো অবাধ্য সব সন্তান তাঁর বুকে সারাটি জীবন আগলে রেখেছিলেন।

মা ছিলেন আমাদের জোড়া দেওয়া সংসারের সর্বশেষ বাঁধন। সব সংসারেই আসলে বাবা-মা থাকে পুঁতির মালার দুই পল্লো সুতার মতো। সন্তানেরা সেই সুতায় গেঁথে থাকা পুঁতি। একটি সুতা ছিঁড়ে গেলেও কোনো রকমে মালাটি দোদুল্যমান অবস্থায় থাকে। শেষ সুতা ছিঁড়ে গেলে পুঁতিগুলো ধুলোয় ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গড়াগড়ি খায়। আমাদের অবস্থা হয়তো এর ব্যতিক্রম নয়। শুনেছি, আল্লাহ তাআলা যাকে পছন্দ করেন, তার ছোট–বড় গুনাহ মাফ করতে অনেক অসুখ–বিসুখ দেন। সেদিক দিয়ে আমার মা হয়তো পুণ্যের পূর্ণতা নিয়ে ভালোই আছেন।

মাহবুব মানিক: গবেষক, মার্সেবুর্গ ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লাইড সায়েন্স, হালে, জার্মানি।

ই–মেইল: <[email protected]>