টুয়েলভ অ্যাপোলস

টুয়েলভ অ্যাপোলস
টুয়েলভ অ্যাপোলস

মেলবোর্নে আমি আর রাফেদ দুজনেই একা ও দোকা বেশ কয়েকবার গিয়েছি। আজব ব্যাপার হলো, একবারও এক মুহূর্ত এক্সট্রা সময় থাকিনি। দরকারি কাজ শেষে সঙ্গে সঙ্গেই ফিরতি প্লেনে চেপে বসেছি। city of tram, city of joy, the most liveable শহরের কিছুই দেখিনি! সাধারণ রাস্তাঘাটও দেখা হয়নি ঠিকমতো, দর্শনীয় কিছু তো বহু দূরের কথা!

যা হোক, দুঃখ ঘোচাতে এবার মেলবোর্নে গেলাম শুধু ঘুরতে। দুজনে অফিসে বসে ‘চলো মেলবোর্ন যাই’ কথাটা বলা আর রওনা হওয়ার মাঝে সময় ছিল চার ঘণ্টা। এর মধ্যে দু্‌ই ঘণ্টা ছিল ছোট একটা ঘুম। এবার আর প্লেনে না। নিজেদের গাড়ি নিয়ে রওনা হলাম সিডনি থেকে। বাঙালি কোথাও গেলে পোঁটলা-পাটলার ব্যাপারে বিখ্যাত। আর নিজেদের গাড়ি করে কোথাও গেলে এ ব্যাপারটা আরও বিচিত্র হয়। ছোট ছোট পলিথিনে আমাদের গাড়ির ছাদ আর নিজেদের বসার জায়গাটুকু ছাড়া সব ভরে গেল! জাতিগত ঐতিহ্য বজায় রাখতে আমরা ভেবেও দেখলাম না যে, আমরা যাচ্ছি মাত্র দেড় দিনের জন্য! রাফেদ ভিক্টোরিয়ার সীমান্ত থেকে শুরু করে প্রতি পরতে পরতে যা আছে তাসহ, চাচাতো শ্যালিকার বান্ধবীর খালাতো ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করার লিস্ট করে ফেলল। আমি কর্মী মানুষ। উদ্ধারকর্মী হিসেবে প্রায় সময়ই কাজ করতে হয়। এবারও করলাম। লিস্ট ফেলে দিলাম।

দুই-চারটা জায়গা ফাইনাল হলো। Twelve Apostles তার মধ্যে অবশ্যই থাকবে। আমার সেই বহু বছর আগে প্রথম যেদিন এটার ব্যাপারে জানলাম, সেদিন থেকেই ইচ্ছা এখানে যাব। সমুদ্রের মাঝে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিশালাকার শিলাখণ্ড— Apostles. এখন আর বারোটা নেই। কয়েকটা বিলীন হয়ে গিয়েছে বা যাচ্ছে। সম্পূর্ণ ৮-৯টার মতো আছে। বছরের পর বছর ক্ষয়ে ক্ষয়ে বিলীন হয়েছে। কিন্তু আমি যত দিন না দেখতে যাচ্ছি মনে হতো, এইরে আজকেই সকালে উঠে নিউজ দেখব, আরেকটা Apostle ভেঙে পড়ে গেছে! তাই Twelve Apostles আমার প্রথম টার্গেট।

টুয়েলভ অ্যাপোলস
টুয়েলভ অ্যাপোলস

যেকোনো দর্শনীয় কিছু Google আন্টি যত সুন্দর করে আমাদের দেখায়, আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা বলে ভিন্ন কিছু। কোথাও গেলে প্রথমেই পার্কিং সমস্যা। চিলের মতো নজর রাখতে হয় কে বের হচ্ছে। ওপাশ থেকে কেউ এসে পড়ার আগেই ছোঁ মেরে পার্কিং স্পটটা নিয়ে নিতে হবে। এরপর যাবেন সেই দর্শনীয় জিনিস দেখতে। কী সুন্দর সুন্দর ছবি দেখে আসছেন বাসা থেকে। বাস্তবে মানুষের মাথার পর মাথা পার হয়ে ওই বস্তু খুঁজে বের করতে বড়ই কষ্ট হবে! এরপর আপনি প্রাথমিক আহা-উহু শেষ করে যাবেন ছবি তুলতে। কিন্তু যদি আগে থেকেই কোনো চায়নিজ চাচ্চু ও তাঁর পরিবারবর্গ ছবি তোলা শুরু করেন তো ওখানেই সন্ধ্যা হয়ে যাবে, তাঁরা নড়বেন না। এই মেলবোর্ন ট্যুরেই Great Ocean Road-এ এক ইউরোপিয়ান গ্রুপ আমাদের ছবি তুলে দিচ্ছিল, আমরা তাদের। মাঝে এসে পড়লেন চাচ্চু গ্রুপ। সেই ইউরোপিয়ান নারী বলেই ফেললেন, আমাদের সব মিলিয়ে আর দুই মিনিট লাগবে, তোমরা প্লিজ দুই মিনিট পরে শুরু করবা (তোমাদের বিখ্যাত সেশন)! Twelve Apostles-এ কোনো পার্কিং ঝামেলায় পড়তে হয়নি। আমরা পৌঁছালাম বেলা সাড়ে ৩টায়। লাঞ্চ সেরে গেলাম Look out-এ, যেখান থেকে দেখা যায়।

আমি জানতাম সুন্দর, কিন্তু জানতাম না এত সুন্দর! দেখে আমি মুগ্ধ, বিস্মিত, নির্বাক! নীল জলরাশির মাঝে কী বিশাল শিলাখণ্ডগুলো দাঁড়িয়ে আছে গ্রীবা উঁচু করে! বড় বড় সাদা ফেনিল ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে তাদের পায়ে! Limestone rocks-এর দেয়ালকে বাতাস, বৃষ্টি আর সমুদ্রের শক্তিশালী ঢেউ দীর্ঘ সময় (প্রায় ২০ মিলিয়ন বছর) ধরে আলাদা আলাদা খণ্ডে রূপান্তর করেছে। এই খণ্ডগুলোকেই বলে Apostles. এখনো এগুলো ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। এখন আর নেই এ রকম একটা Apostle-এর ধ্বংসাবশেষ এখনো দেখা যায় ঢেউয়ের ফাঁকে ফাঁকে। একসময় সেটাও ছিল বাকিগুলোর মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। ঢেউ, বাতাস আর বৃষ্টির পানিতে ক্ষয়ে ক্ষয়ে শক্তিশালী শীলা আজ বিলীন। কিছু মনে করিয়ে দেয় কি!

টুয়েলভ অ্যাপোলসে স্বামীর সঙ্গে লেখিকা
টুয়েলভ অ্যাপোলসে স্বামীর সঙ্গে লেখিকা

ট্যুরিস্ট সিজন পড়তির দিকে বলে অত ভিড় ছিল না। আর Look outটাও এত বড় যে, কোনো সমস্যাই হলো না জায়গা পেতে। আমরা নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকলাম। খুব বেশি ছবি তোলার কথা মাথায় এল না। অথচ আমি গাড়ি ভরে ড্রেস নিয়ে গিয়েছি চেঞ্জ করে নানান গেট আপে ছবি তুলে সবার হোমপেজ ভরিয়ে ফেলব বলে! বেশ খানিক হেঁটে সিঁড়ি বেয়ে নিচে সমুদ্রের পাড়ে গেলাম। ওখান থেকে দুটা Apostles খুব কাছ থেকে দেখা যায়। সন্ধ্যা হয়ে আসছিল। খুব কাছ থেকে দেখলাম উঁচু Apostles দাঁড়িয়ে। তার নিচে বড় বড় ঢেউ গর্জন করতে করতে এসে আছড়ে পড়ছে! ওই সময়ের অনুভূতি বলে বোঝাতে পারব না!

ফিরতে ফিরতে রাত। Victoria রাজ্যের মাইলের পর মাইল বিরানভূমির মধ্য দিয়ে আসার সময় একদিকে ডুবন্ত সূর্য আর একই সঙ্গে আরেকদিকে বিশাল থালার মতো উঠন্ত চাঁদ আমাদের সঙ্গ দিল। সে আরেক অনুভূতি, আরেক গল্প!