ডিজিটাল যুগে বেড়ে ওঠা স্ক্রিন এজারস

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

পৃথিবীতে ছয় বিলিয়ন মানুষের হাতে মোবাইল ফোন আছে। অথচ ব্যবহার উপযোগী বাথরুমসুবিধা পায় মাত্র ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন মানুষ। এটা পিবিএস নিউজের রিপোর্ট থেকে পাওয়া তথ্য। আসলেই তো ডিভাইস ছাড়া কি এখন আমরা চলতে পারি? এখন কোথাও কয়েকটি পরিবার একসঙ্গে হলে বাচ্চাদের খেলনা নিয়ে কাড়াকাড়ি কিংবা ঝগড়াঝাঁটি একদমই চোখে পড়ে না। বরং সবাই কোনো না–কোনো ডিভাইস নিয়ে ব্যস্ত। পরিচিত হওয়ার বা কথা বলার ঝামেলায় কে যায়! বড়রাও কী কম, এক জায়গায় বসেই কতজনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হচ্ছে! আবার স্কুল–কলেজের পড়ালেখা থেকে শুরু নানা কাজেই এর অপরিহার্যতা এখন অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু এই স্ক্রিন টাইম বা পর্দায় সারাক্ষণ চোখ রাখা আমাদের ওপর কী প্রভাব ফেলছে, আমরা কি সে বিষয়ে সচেতন?

এ বিষয় নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেছেন একজন চিকিৎসক ও মেডিকেল স্কুলের শিক্ষক ডেলেনি রাসটন (Delaney Ruston)। তাঁর প্রামাণ্যচিত্র পুরস্কারও অর্জন করেছে। প্রামাণ্য ছবিটির নাম—‘স্ক্রিন এজারস’ (Screen Agers)। ডেলেনি রাসটনের এই ছবি দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল বাচ্চাদের স্কুলের সৌজন্যে। স্কুল কর্তৃপক্ষ সব বাচ্চাকে দেখিয়েছে আবার যেসব অভিভাবক দেখতে আগ্রহী তাঁদের জন্যও দেখার ব্যবস্থা করেছে।

এখানে বিভিন্ন গবেষণার রিপোর্ট তুলে ধরে দেখানো হয়েছে কীভাবে স্ক্রিন টাইম আমাদের শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি করছে। কীভাবে আমরা এ বিষয়ে সচেতন হতে পারি, কীভাবে ক্ষতির পরিমাণ কমাতে পারি। বিশেষ করে শিশুদের বাঁচাতে পারি এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে। কেননা, শিশুরাই বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। যদিও পুরোটাই আমেরিকার বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তৈরি। কিন্তু ডিভাইস ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনো দেশই এখন এর থেকে খুব বেশি ব্যতিক্রম নয়।

ছোট বড় সব মানুষের কম্পিউটার, ট্যাবলেট ও মোবাইল ফোন ইত্যাদি নানা পর্দায় চোখ আটকে থাকার পরিমাণ দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। পড়ালেখা, নানা তথ্য খুঁজে বের করা, ভিডিও দেখা, সোশ্যাল মিডিয়া, ভিডিও গেম, সারাক্ষণ চ্যাট করা এই সবকিছুতে দিনে গড়ে সাড়ে ছয় ঘণ্টারও বেশি সময় ব্যয় করছে টিন এজাররা। আমেরিকায় প্রতি দশজনের মধ্যে ছয়জন অভিভাবক মনে করেন, তাঁদের বাচ্চারা অতিরিক্ত সময় দিচ্ছে স্ক্রিনে। অন্যদিকে প্রতি দশজন বাচ্চার মধ্যে সাতজন বাচ্চা মনে করে তাদের বাবা মা তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন স্ক্রিনে চোখ রাখার কারণে। তাহলে কী দেখা যাচ্ছে, বড়দের রোলমডেল হতে হলে তাদের নিজেদেরও সচেতন হতে হবে।

গবেষণায় দেখা গেছে যারা অতিরিক্ত ভিডিও গেম খেলে, দিনে প্রায় তিন ঘণ্টা, তাদের মস্তিষ্কের এমআরআই-এর রিপোর্ট ও মাদকাসক্ত ব্যক্তির রিপোর্টে একই প্যাটার্ন পাওয়া যাচ্ছে। অতিরিক্ত স্ক্রিন বেইসড অ্যাক্টিভিটি মারাত্মক ক্ষতি করছে মানব মস্তিষ্কের। এই সময়ে ডোপামিন নামক কেমিক্যাল নিঃসরণ হতে থাকে মস্তিষ্কে। একই বিষয় মদ্যপানেও ঘটে। এই ডোপামিন নেশাগ্রস্ত করে তোলে মানুষকে। সে স্ক্রিন থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারে না।

ছোট শিশুদের ব্রেনের ক্ষেত্রে এর প্রভাব আরও বেশি। কেননা, মানব মস্তিষ্কের সামনের অংশ যা কিনা পরিকল্পনা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও আবেগ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে তা সুগঠিত হয় ধীরে ধীরে টিনএজ থেকে প্রায় ২০ বছর বয়স পর্যন্ত। এ গঠনপ্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করে এই স্ক্রিন টাইম। ইঁদুর ও ছোট ছোট শিশুদের ওপর করা দুটি গবেষণায় পর্দার এই ক্ষতিকর প্রভাবের প্রমাণ পাওয়া গেছে। শিশু ইঁদুরের ওপর গবেষণায় দেখা গেছে তাদের স্নায়ুর অংশ সুগঠিত হয়নি যা শিখতে ও মনে রাখতে সাহায্য করে। একই গবেষণায় প্রাপ্ত বয়স্ক ইঁদুরদের ওপর সেই ফলাফল আসেনি। তবে দেখা গেছে, স্ক্রিনের প্রভাব সরিয়ে নিলে ধীরে ধীরে তা আবার কাজ করতে শুরু করে। চার-পাঁচ বছরের দুই গ্রুপ শিশুদের মধ্যে, এক গ্রুপকে খুব দ্রুত গতির ছবি দেখানো হয়েছিল, অন্য গ্রুপকে শিক্ষামূলক ভিডিও বা ছবি আঁকতে দেওয়া হয়েছিল। এরপর দুই গ্রুপেরই একই রকম জ্ঞানের পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল। দেখা গেছে দ্বিতীয় গ্রুপের তুলনায় প্রথম গ্রুপ খুবই খারাপ করেছে সব পরীক্ষায়।

প্রামাণ্য ছবি স্ক্রিন এজারস–এর প্রচারপত্র। সংগৃহীত
প্রামাণ্য ছবি স্ক্রিন এজারস–এর প্রচারপত্র। সংগৃহীত

এত সব দেখে ভয় পেয়ে গেলে তো চলবে না! প্রযুক্তি ছাড়া সভ্য সমাজে টিকব কীভাবে? ভিডিও গেমের পক্ষেও আছে যুক্তি। কিছু কিছু গেম নাকি দৃষ্টিশক্তির ত্রুটি ঠিক করতে সাহায্য করে, সামাজিকতা শেখায়। যদিও বেশির ভাগই শেখায় ধ্বংসাত্মক বিষয়। অনলাইনকে ব্যবহার করে হচ্ছে নানা অপরাধ। মেয়েরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ভীষণভাবে। আবার পড়ালেখায় অনেক কাজে লাগছে এই অনলাইন মাধ্যম। যোগাযোগেও বিশাল ভূমিকা আছে এই স্ক্রিনের। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে খারাপটাই বেশি। মানুষ এখন সরাসরি কথা বলার চেয়ে টেক্সটে যোগাযোগ করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। অথচ গবেষণা বলে সামনাসামনি কথা বলার অভ্যাস মানুষের আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। তাহলে কি জীবন থেকে স্ক্রিন একেবারে বাদ দিয়ে দেব?

তাই এখানেও বিজ্ঞান সহায়ক। প্রমাণিত যে মানুষের আছে নিজেকে নিয়ন্ত্রণের চমৎকার ক্ষমতা। ছোট শিশুরা দারুণভাবে এই ক্ষমতাকে বাড়াতে পারে বড়দের সহায়তায়। জীবনকে করতে পারে সুনিয়ন্ত্রিত। বিজ্ঞান বলে যেকোনো বিষয় যদি বাচ্চাদের আলোচনার মাধ্যমে বুঝিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে তারা সেখান থেকে গ্রহণ করে বেশি। আবার শাস্তি দেওয়ার চেয়ে যদি ভালো কাজের জন্য পুরস্কৃত করা হয় তবে সেটাও আরও ভালো কাজের জন্য উদ্বুদ্ধ করে। যেমন শিশুরা যদি স্ক্রিন বন্ধ রেখে হোমওয়ার্কে মনোযোগ দেয় তার জন্য পুরস্কার দিলে সে শিশু বারবার তাই করবে। বড় ছোট সবাই অভ্যাস গড়ে তুলতে পারে নির্দিষ্ট সময় স্ক্রিন থেকে ছুটি নেওয়ার।

যেমন খাবারের সময় কোনো ডিভাইস না রেখে নিজেরা মুখোমুখি হলে টুকটাক কথাবার্তায় সুন্দর সময় পার করা যায়। রাতে বিছানার কাছে কোনো স্ক্রিন খোলা না রাখার অভ্যাস করলে ভালো ঘুম হয় সবারই। গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোনে মনোযোগ না দেওয়ার অভ্যাস করলে দুর্ঘটনার পরিমাণ কমে, মাথাও ভালো কাজ করে। ছোট ছোট উদ্যোগ নিয়েই জীবনে বড় পরিবর্তন আনা সম্ভব। নিয়ম করে অল্প সময় আলোচনার মাধ্যমে আমরা নিজেরা সচেতনতার চর্চা চালিয়ে যেতে পারি। এ সংক্ষিপ্ত আলোচনাতে বাচ্চাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে তাদের মধ্যেও ভালো বিষয় চর্চার অভ্যাস গড়তে পারি।

ভালোবাসা আর যত্ন দিয়ে যদি কোনো নিয়ম অভ্যাস করতে বলা হয়, বাচ্চারা সেই নিয়ম মেনে চলে। সবচেয়ে বেশি কাজ করে যদি তাদের আগ্রহের খেলাধুলা, ছবি আঁকা বা গান শেখা এমন কিছুতে নিয়মিত সময় ব্যয় করা যায়। যার যেটা পছন্দ তাকে সেটাতে সময় দিতে দিলে সে অবশ্যই ভালো করবে ও স্ক্রিন থেকেও দূরে রাখবে তার এই ব্যস্ততা। যেমন কেউ যদি ব্যাডমিন্টন খেলতে পছন্দ করে বা পিয়ানো বাজাতে, তাকে সেটা অনুশীলনের সময় বাড়াতে বললে সে আগ্রহ নিয়েই তা করবে, দিনকে দিন ভালোও করবে। তাই এ জাতীয় কর্মকাণ্ড হচ্ছে স্ক্রিন থেকে দূরে থাকার সবচেয়ে সহজ এবং ভালো পন্থা।

এ পর্যন্ত যা যা লিখলাম সবই ওই ডকুমেন্টারির মাধ্যমে জানা। এ মুভির একটি ওয়েবসাইট আছে, যে কেউ তা থেকে জানতে পারেন আরও অনেক তথ্য। ওয়েবের ঠিকানা: . আবারও সেই স্ক্রিন টাইম! তবে আশার কথা হচ্ছে আমরা সেই সময়কে নিয়ন্ত্রণ করে নিজেদের ক্ষতির পরিমাণ কমাতে পারি। সবশেষে এই কামনা, মানুষ সচেতনতার সঙ্গে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করুক, প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাকে মানুষ যেন জয় করতে পারে।