দুই শিশু ও এক সন্ধ্যাবেলা

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

দুটি বাসনকোসন একসঙ্গে রাখলেই তারা ছোট ছোট থালাবাটি বাচ্চা দিচ্ছে। খরগোশের বংশবিস্তার কোন ছাড়! বেসিনে টাল দেওয়া ঘটিবাটির দিকে অসহায় তাকিয়ে আছি। এমন সময় চমকে দিয়ে কানের একেবারে পাশ ঘেঁষে শিস কেটে বেরিয়ে গেল গুলিটা। তারপর আবারও নির্বিকার খুন্তির ডগায় চুলার বেগুনগুলো উল্টে দিতে থাকলাম। কিন্তু অতীন্দ্রিয় জানিয়ে দিল, ঝানু স্নাইপার কাছেপিঠেই আছে। তার প্রমাণ দিতেই বোধ হয় সে আড়াল থেকে বুকে হেঁটে প্রায় নিঃশব্দে এসে অব্যর্থ ঘ্যাকাৎ কামড় বসিয়ে দিল পায়ে। ‘আল্লাহ রে...’ মাতম তুলে বেগুনের কড়াই কোনোমতে ঢাকনি চাপা মেরে গোড়ালি ডলে দেখি সেখানে তিন-চারটা দাঁতের গভীর দাগ। কালপ্রিট ততক্ষণে তেমনি নিঃশব্দে দ্রুত পালিয়ে গেছে। আবার গেরিলা অ্যাটাক হতে পারে, এই আশঙ্কায় শাসাতে গেলাম তাদের।

তাদের মানে টু-ম্যান আর্মি। ধরা যাক, তাদের নাম নুরু মিয়া আর তুরু মিয়া। তুরু মিয়া আমার ছানা। বয়স সাড়ে তিন। আর নুরু মিয়া দুইয়ের কিছু বেশি হবে। তাকে ঘণ্টাখানেকের জন্য জমা দিয়ে বাবা-মা একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছেন। কিন্তু যার জিম্মায় রেখে রেখে যাওয়া, সে মা হিসেবে খুব নির্বিকার, নির্লিপ্ত। ছেলে পাথর গিলে না ফেললে কী, আরেক ছেলের মাথা ফাটিয়ে না দিলে, নিরাপদ দূরত্বে বসে ঝিমাতে থাকে। আজকেও আমি ঝিমাতাম। কিন্তু ছানা দুটোকে রাতের খাবার খাওয়াতে হবে। তাই অফিস ফেরত পোশাক নিয়েই খিচুড়ি চাপানো, বেগুন ভাজির আয়োজন আর চিংড়ি-টমেটোর ঝালহীন শিশুতোষ মিষ্টি তরকারির জোগান দেওয়ার তাড়া।

দুই যোদ্ধা কৌরব বনাম পাণ্ডব সেজে বাক্সবন্দী যত খেলনা আছে সেগুলো দিয়ে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা চলছিল। যথারীতি ঘরটাকে লন্ডভন্ড কুরুক্ষেত্র বানিয়ে তোলার পর ঠুশ করে তারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলল। সম্মুখ যুদ্ধ আর ভালো লাগছে না। উত্তেজনা কম। তাই মিনিট দুই দম নেবার পর তাদের বুদ্ধি গিজগিজ মাথা থেকে বের হলো আরেক নতুন ফন্দি। এবার হবে কমান্ডো-কমান্ডো খেলা। একজন প্লাস্টিকের একটা হাতুড়ি হাতে নিয়েছে। রান্নাঘরের আড়াল থেকে হাতুড়িটা উল্টে ধরে এ কে ফরটি সেভেনের মতো বাগিয়ে আমার দিকে তাক করে গুলি ছুড়ছে—ফিউ ফিউ, ঢিশকাও ঢিশকাও...’। আমিও ম্যাট্রিকস সিনেমার কিয়ান্যু রিভসের মতো স্লো মোশনে বেঁকে গিয়ে কিংবা জাদুমন্ত্রের বলে হাত দিয়ে বুলেট থামিয়ে তাদের বিনোদন যুগিয়ে যাচ্ছি রান্নার ফাঁক ফোকরে। কিন্তু ঘ্যাকাৎ কামড় খাবার পর মনে হলো বাঁদরের দল লাই পেয়ে হুপহাপ ডাক ছেড়ে একেবারে মাথায় উঠে যাচ্ছে। নামিয়ে আনা দরকার। কিন্তু বিরক্তিটা দুই ভুরুর মাঝখানে আটকে একটা জোড়া ভুরু বানিয়ে তাদের খোঁজে বৈঠকখানায় গিয়ে দেখি নুরু মিয়া আর তুরু মিয়া মুখে নির্মল হাসি ফুটিয়ে চোখে রাজ্যের মায়া নিয়ে নিষ্পাপ তাকিয়ে আছে। নুরু মিয়ার আবার ফোকলা দাঁত গলে স্বচ্ছ লালার স্রোত গড়িয়ে পড়ছে কার্পেটের মেঝেতে। তাদের রণকৌশলের দুর্ভেদ্য ডিফেন্স মেকানিজমের কাছে হেরে গিয়ে আমার রাগ উবে গেল। শাসানোর বদলে নরম স্বরে অনুনয় জানালাম, যেন আমার রান্নার সময়টুকুতে একটা যুদ্ধ বিরতি দেওয়া হয়। শান্তি প্রস্তাব কতটুকু পাত্তা পেল বোঝা গেল না। কারণ তারা নিজেদের ভেতর রহস্যময় চাহনি ছোড়ায় ব্যস্ত। নীরবতা সম্মতির লক্ষণ ধরে নিয়ে চল্টা ওঠা বহু ব্যবহৃত ডিসকো পাতিলের কিনারায় ফিরে এলাম। টমেটোর ভেলায় ভাসমান চিংড়িগুলো কমলা বুদ্‌বুদ ফুটিয়ে জানান দিল যে তারা ভাতের সঙ্গে ঝোল হওয়ার জন্য তৈরি।

থালা সাজিয়ে ডাকতে গেলাম নবাবপুত্রদের। ভাতের নাম শুনেই তাদের বেগড়বাই উঠে গেল। ধরতে গেলেই সর্ষে মাখা সিঁধেল চোরের মতো পিছলে যাচ্ছে একেকজন। কোমরে হাত দিয়ে প্রমাদ গুনলাম খানিকক্ষণ। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মিছিলের ডাইরেক্ট অ্যাকশন শুনতে শুনতে বড় হওয়া আমি আর ধৈর্যের ধার না ধেরে তেমনি এক ডাইরেক্ট অ্যাকশনে নেমে পড়লাম। একজনকে কাঁধে ফেলে, আরেকটাকে বগলে চেপে সোজা বসিয়ে দিলাম খাবার টেবিলে।

মুশকিল হলো, দুই মিয়া ভাইয়ের আবার পিএইচডি ডিগ্রি আছে। তাদের থিসিসের বিষয়, ‘মা-খালা জ্বালানো’। খেতে বসে তারা তাদের অর্জিত বিদ্যা ফলানো শুরু করল। ইচিং-বিচিং ছড়া আর ছবির বই এসবে তারা নরম হচ্ছে না। তাদের কার্টুন দিতে হবে। নইলে এত ঘাম ঝরিয়ে রাঁধা বেগুন আর চিংড়ি মাখানো খিচুড়ি খাবে না তারা। দুজন বাইন মাছের মতো মোচড় মারা শুরু করেছে। কিন্তু ঘোড়েল আমিও কম নই। সিদ্ধান্তে অনড়, অটল। এর পেছনে অবশ্য একটা পাতিহাঁস আকারের ছোট ইতিহাস আছে। কার্টুন দেখিয়ে খাওয়াতে গিয়ে তুরু মিয়ার একবার এমন আসক্তি ধরে গেল যে, মাঝরাতে উঠে বসে হুংকার ছাড়ত, ‘আমি বেবি শার্ক দেখব’, বেবি শার্ক কই’...ইত্যাদি। বহু কষ্টে সেবার তার কার্টুনাসক্তি নিরাময় করা গিয়েছিল। কিন্তু তখন থেকে আমি মহা খাপ্পা। ঠিক করে রেখেছি, বেবি শার্ক নামের এই মহাজাগতিক গানের সুরস্রষ্টাকে পেলে তাকে তিমি মাছের মতো গিলে হজম করে ফেলব। সে তো আর ইউনুস নবী না যে তাকে ফেরত দেওয়ার মামলা আছে!

মিনিট পাঁচেক খাবার জন্য বিস্তর পীড়াপীড়ি করে ব্যর্থ হয়ে আত্মসম্মান চুলায় দিয়ে নিজেই মাথা দুলিয়ে গান ধরে কার্টুন বনে গেলাম। ডক্টর নুরু আর ডক্টর তুরু তাতে কিছুটা প্রসন্ন হলো মনে হয়। ফিক হাসিটা তো তাই বলে। তারপর বেতাল গানে আর উড়াধুড়া নাচে ঘর মাতিয়ে খেয়ে নিলাম তিনজনে মিলেজুলে। দুজনকে তো দুই হাতে সমান্তরালে খাওয়ালাম। কিন্তু নিজের গ্রাসের জন্য আরেকটা হাত কোত্থেকে জোগাড় হয়েছিল ঠিক জানি না। ঈশ্বর বোধ হয় মায়েদের অবস্থা বুঝে তৃতীয় হাত, তৃতীয় নয়ন কী ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের ব্যবস্থা করে দেন। নইলে অসম্ভবকে সম্ভব করা তো অনন্ত জলিল নামের এক বিখ্যাত ঢাকাই নায়কের একচেটিয়া ব্যবসা বলেই জানি।

খাদ্য পর্ব সেরে মুখ মুছিয়ে দুজনকে ফল খাওয়াচ্ছি। খানাপিনার পর মিষ্টি খাওয়া সুন্নত। এই সওয়াব থেকে তাদের বঞ্চিত করি কীভাবে। নিজেও টপাটপ গালে পুরছি কমলালেবুর টুকরোগুলো। তুরু মিয়া তিনটা কমলার কোয়া একবারে মুখে দিয়ে হাপিশ করে দিল। দেখাদেখি নুরু মিয়াও একটা কোয়া তুলে না চিবিয়ে কোৎ করে গিলে ফেলতে চাইল। কিন্তু ফল হলো ভয়ংকর! এক কোয়া কমলা দশ কামড়ে খেতে অভ্যস্ত নুরু মিয়ার পাকস্থলী বিশ্বাসঘাতকতা করে বসল। গিলে ফেলা আধা চিবানো কমলা সে ভক করে উগড়ে দিল। তার জামা আর টেবিলের একাংশ ভিজে পুরাই ছেঁড়াবেড়া। দৃশ্যটা দেখে আরেকজন আবেগে উদ্বাহু হাততালি দেওয়া শুরু করল। দেখেশুনে অধিক শোকে আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে এল ইদানীংয়ের বহুল প্রচলিত বাংলা সংলাপের অপভ্রংশ, ‘কেউ আমারে মাইরালা...!’

যা হোক, দ্রুত হাতে সব সামাল দিয়ে তুরু-নুরু মিয়াকে মুছে-টুছে আবার ঝাঁ চকচকে বানিয়ে খেলতে পাঠিয়ে দিলাম। তারা তাদের ফেলে আসা কুরুক্ষেত্রে ফেরত গেল। কিন্তু নিজেদের ছড়ানো-ছিটানো খেলনাগুলো এখন তাদের জন্য ল্যান্ড মাইনের কাজ করছে। দৌড়াতে গিয়ে ধড়াম করছে পড়ছে একেকজন। কী না কীসে লেগে আবার মাথা ফেটে সত্যিকারের যুদ্ধক্ষেত্রের মতো আহত হওয়ার অঘটন ঘটে, সেই ভয়ে চোখা আর কোণাওয়ালা খেলনাগুলো সরিয়ে ফেললাম। মুখে পুরে ফেলা যায় যেগুলো, সেগুলোও লুকালাম। নইলে এরা সোনা পাচারকারীর মতো টপ করে গিলে বসে থাকবে। চোখ তো আর ইলেকট্রিক স্ক্যানার নয়। জানতেও পারব না যে কটা খেলনা গাড়ির চাকার চালান পরেছে পেটে। আর এই অভিযান চালাতে গিয়ে পায়ের তলে পড়ল প্লাস্টিকের ছোট্ট জলদস্যু। খালি পায়ের নিচে তাই লাগল করাতের ফলার মতো। আর হাতিকে বেকায়দায় দেখলে ইঁদুরও হাসে। জলদস্যুর আঘাতে ধরাশায়ী হয়ে গেছি দেখে দুই ভাই তাদের ভরপেট দুলিয়ে হাসতে লাগল। শিশুদের সামনে প্যাঁচামুখো হয়ে থাকতে নেই। তাই জলদস্যুটাকে উড়িয়ে একদিকে ছুড়ে ফেলে বাঁকাচোরা হাসি টেনে যোগ দিলাম তাদের সঙ্গে।

হাসির মাঝপথে ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দে সদর দরজা খুলে খুব পরিচিত কিন্তু ক্লান্ত ভঙ্গিতে তীব্র ফরসা এক যুবক ঢুকল। তার ফরসা রং ত্বক ছাড়িয়ে লালচে-বাদামি চুলেও হানা দিয়েছে। হতচকিত হয়ে গেলাম এক মুহূর্তের জন্য। কিন্তু এই লোক ঘরে ঢুকেছে কেন? বাবা-আ-আ...বলে চিৎকার তুলে তুরু মিয়া তার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ধুর, ছেলে বাপকেই চিন্তা পারছি না। কী সর্বনেশে কথা! মাঝে মাঝে যে এ রকম হয়, এ কথা ভুলেও কাউকে বলা যাবে না।

একটু পরেই নুরু মিয়ার বাবা-মা চলে এল। তাদের পেয়েছে রাজ্যের খিদে। ভাত লাগালাম তড়িঘড়ি করে। ধোঁয়া ওঠা খাবার আর সঙ্গে কাঁচামরিচ-লেবুর সতেজ সুঘ্রাণে চারিদিক ম ম করছে। ক্ষুধার্ত মানুষগুলো গল্প করতে করতে তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছে। ক্লান্তিকর দিন শেষের বাড়তি শ্রমটুকু তাহলে সার্থক। বাবা-মাকে পেয়ে ছানাগুলো হইহই করে বিরাট হল্লা হাটি জুড়ে দিয়েছে। মধ্যবিত্ত বৈঠকখানায় টিমিটিমে হলুদ বাতির হাত ধরে নেমে আসা সাদামাটা এই সন্ধ্যাটা দুই রাজপুত্রের খিলখিল হাসির বন্যায় আস্তে আস্তে হয়ে উঠল আলোকিত এক নীহারিকা।
...

ড. রিম সাবরিনা জাহান সরকার: গবেষক, ইনস্টিটিউট অব প্যাথোলজি, স্কুল অব মেডিসিন, টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি মিউনিখ, জার্মানি।