কানাডায় নারীর ভোটাধিকারের আন্দোলন

কানাডার বর্তমান লিবারেল সরকারের মন্ত্রিসভা
কানাডার বর্তমান লিবারেল সরকারের মন্ত্রিসভা

বৈশ্বিক ইতিহাসের পরিক্রমায় একটু গভীরভাবে আলোকপাত করলে এক বৈষম্যের শূন্যতা সহজেই প্রতীয়মান হয়। সর্বত্রই ভৌগোলিক সমস্যা, শাসক ও শাসিতের সম্পর্ক, উৎপাদন ব্যবস্থা ও স্থাপত্য কীর্তি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা লক্ষ করা যায়। বিশ্বে নারী আর পুরুষে উভয়ের অবদানেই সমাজ ও মানব সভ্যতার কাঠামোর সফল অগ্রগতিতে ভূমিকা রেখেছে। তবে দুঃখজনকভাবে সভ্যতার সর্বস্তরেই একজন নারীর প্রতিদিনের অপরিসীম আত্মত্যাগ, অবদান, অবস্থান, শোষণ ও নির্যাতন ইত্যাদি দিকগুলো অনুচ্চারিত বা স্বল্প উচ্চারিত থেকেছে। এর পশ্চাতে পুরুষতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের মনোভাব, নারীর অবমাননা মেনে নেওয়ার বিরাজমান নীরবতার সংস্কৃতি, অশিক্ষা, কুসংস্কারের মতো বিভিন্ন বিষয় ওতপ্রোতভাবে জড়িত। গতানুগতিক ও সংকীর্ণ মানসিকতার চাপে নারীর পূর্ণ মানবিক অধিকার বারবার বিসর্জিত হয়েছে। বর্তমানে আধুনিকতার নামে নারীর অবস্থান ও ভূমিকাকে হীনভাবে অথবা ভোগ্যপণ্য রূপে উপস্থাপন করা হয়। রাষ্ট্রযন্ত্র ও রাজনীতিসহ সমাজের সর্বত্রই নারীর অবস্থান নির্মমভাবে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে আগ্রাসী আধিপত্যবাদী পুরুষতান্ত্রিক স্বার্থ দ্বারা। শুধু স্বল্পোন্নত আর উন্নয়নশীল দেশেই নয় বরং উন্নত বিশ্বের রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রেক্ষাপটেও নারীর বিবিধ অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রটিতে বৈষম্য ও অসমতার প্রকাশ বিশেষভাবে প্রকট।

রাষ্ট্র পরিচালনার যেকোনো স্তরে একজন যোগ্য প্রার্থীকে জনপ্রতিনিধি রূপে নিজের পছন্দ অনুসারে ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত করার অধিকার হলো মানুষের অন্যতম মৌলিক নাগরিক অধিকার। কিন্তু সেই ভোটাধিকারের অধিকারে বা Suffrage Right থেকে প্রগতির দেশ কানাডার নারী সমাজ একটি দীর্ঘ সময়ব্যাপী বঞ্চিত ছিল।

ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত কানাডার স্থানীয় ও প্রাদেশিক রাজনীতি ও উচ্চপর্যায়ে পুরুষের প্রাধান্য লক্ষণীয় ছিল। পরে সমাজের শ্বেতাঙ্গ নারীরা বিরাজমান অনেক বৈষম্যের মতো ভোটাধিকারের বৈষম্য নিরসনে অগ্রসর হন। নারীর ভোটাধিকার আন্দোলন অনেকটা শান্তিপূর্ণভাবে পরিচালিত হলেও এই আন্দোলনে স্থানীয় অধিকার প্রতিষ্ঠা, নারীর সামাজিক সমস্যা, নারীর প্রতি নির্যাতন, মজুরি বৈষম্য, মাতৃস্বাস্থ্য উন্নয়নের বিভিন্ন দিক বৃহত্তর আন্দোলনের অন্তর্গত হয়। প্রাথমিকভাবে কয়েকজন ভূসম্পত্তির মালিক নারী ১৯০০ সালের বিভিন্ন পর্যায়ে ভোটদানের অধিকার পান। প্রাদেশিক পর্যায়ে মানিটোবায় নারীদের ভোটাধিকার অর্জিত হয় অনেক পরে। আর সেই সময়টি হলো ১৯১৬ সালে।

প্রাদেশিক পর্যায়ে ১৯১৭ সালের দিকে সীমিতসংখ্যক নারী ভোটাধিকার পান। তবে দুঃখজনকভাবে এর আওতায় এশিয়ান নারী-পুরুষেরা অন্তর্গত ছিলেন না। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর আদিবাসী নারীর যাঁরা কানাডার বিভিন্ন রিজার্ভে থাকতেন, দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া তাঁদের কেউই এই অধিকারের আওতায় পড়েননি। তবে ১৯৬০ সালের দিকে কানাডার মূলধারার নৃতাত্ত্বিক নারী ও এশিয়ান নারী-পুরুষের ভোটাধিকারের ক্ষেত্রে কিছুটা পরিবর্তন আসে। কানাডায় নারীদের ভোটাধিকারের ইতিহাসের প্রাথমিক পর্বে গুটিকয়েক নারী ভোটাধিকার প্রাপ্ত হন। মাত্র ২৭ জন নারী ক্যাঘনওগাহ অঞ্চল থেকে ভোটে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ১৮২৫ সালের নির্বাচনে ক্যাথলিক প্রোটেস্টান্ট আর জুয়িশ নারীরা শুধু প্রাধান্য পেয়েছিলেন। উচ্চবিত্ত অভিজাত শ্রেণির প্রভূত সম্পত্তির অধিকারী নারীরা কুইবেকের নির্বাচনে ভোটদানের অধিকার পেয়েছিলেন। বলা বাহুল্য, অর্থনৈতিক অবস্থানগত বৈষম্যই নারীর অধিকারের ক্ষেত্রটিকে সংকীর্ণ করেছিল।

নারীর মূল দায়িত্ব মাতৃত্ব ও গৃহ রক্ষণাবেক্ষণ। এই অজুহাতে নিউ বার্নাসউইকে ১৮৪৩ সালে ও ১৮৪৯ সালে কুইবেকের নির্বাচনে পুরুষের অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়। নারী ও পুরুষের রাজনৈতিক অঙ্গনে সমাজ নির্ধারিত চিরায়ত দায়িত্বের মানদণ্ডে সুনির্দিষ্ট পার্থক্যের সীমারেখা টানা হয়। কানাডার সমাজে নারীর ভোটাধিকার রক্ষার আন্দোলনকারীদের তখনকার সমাজে একটি হুমকি হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল। নারী আন্দোলনকারীদের বিরোধিতাকারী একটি শ্রেণির জন্ম হয়। যারা বিশ্বাস করত একমাত্র পুরুষেরাই রাজনৈতিক অঙ্গনে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের জন্য যথেষ্ট। ১৮৮৫ সালে হাউস অব কমন্স একটি আলোচনা ও বিতর্কে একটি বিভাজিত আইন অনুসারে নারী প্রার্থীদের ভোটাধিকার ও নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়টি অন্তর্গত না করা হলে নারীর ভোটাধিকার আন্দোলন সমগ্র কানাডায় দানা বেঁধে ওঠে। মূলত এই আইনের মাধ্যমে উচ্চবিত্ত শ্বেতাঙ্গ পুরুষের রাজনৈতিক অধিকার সুদৃঢ় করা হয়। নারীর ভোটাধিকার রক্ষার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন স্থানীয় অনেক নারী, সাংবাদিক, সমাজকর্মী, সরকারি ও বেসরকারি কর্মী। নারীর রাজনৈতিক অবস্থান সুসংহত করার জন্য তাঁরা এগিয়ে আসেন।

ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত কানাডার স্থানীয় ও প্রাদেশিক রাজনীতিতে উচ্চপর্যায়ে পুরুষের আধিপত্য লক্ষণীয় ছিল। পরে মধ্যবিত্ত সমাজের শ্বেতাঙ্গ নারীরা এই অধিকার প্রতিষ্ঠা আন্দোলনে এগিয়ে আসেন। নারীর ভোটাধিকারের প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন চিকিৎসক এমিলি হাওয়ার্ড স্টোউই। তাঁর নেতৃত্বে নারীর ভোটাধিকার আন্দোলন ১৮৭৮ সাল থেকে বেগবান হয়। তিনি একটি নারী সংগঠনের প্রেসিডেন্ট ছিলেন।

কানাডার প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় সরকার কাঠামোয় শ্বেতাঙ্গ পুরুষের দীর্ঘস্থায়ী একচ্ছত্র আধিপত্য ও ভোটদানের প্রতি বিরত রাখার মনোভাব, আক্রমণ প্রচেষ্টা নারী সংগঠনগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হতে সহায়তা করে। মূলত নারীর ভোটাধিকার বিষয়টি মুখ্য রেখে এই আন্দোলন অগ্রসর হলেও স্থানীয় অধিকার ও নারীর বিভিন্ন অধিকার প্রতিষ্ঠার নানা দিক পরে এতে যুক্ত হয়। ভূসম্পত্তির মালিক নারীরা ১৯০০ সালের কেন্দ্রীয় পর্যায়ে ভোটদানের অধিকার পেলেও প্রাদেশিক পর্যায়ে মানিটোবায় নারীদের ভোটাধিকার অর্জিত হয় ১৯১৬ সালে।

ওন্টারিও প্রদেশে টোরেন্ট উইমেন্স লাইব্রেরি ক্লাবের (TWLC) মাধ্যমে এই আন্দোলনের কর্মীরা ভোটাধিকারের সঙ্গে সঙ্গে নারীর উচ্চশিক্ষা লাভের প্রয়োজনীয়তা, ব্যক্তিগত উন্নয়ন, শারীরিক ও মানসিক যত্নে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেন। ডা. এমিলি হাওয়ার্ড স্টোউই ও তাঁর মেয়ে আগস্ট স্টোন গুলেন পরে ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে নারী ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের বিষয়টি নিয়ে নিরলস কাজ করেন। তাঁদের এই আন্দোলনের সঙ্গে সমাজকর্মী ও সাংবাদিক টমাস ফিলিপ একাত্মতা প্রকাশ করেন।

আন্দোলনকারীরা দীর্ঘ সময় নানা আক্রমণ, বিরোধিতা আর বৈষম্যের শিকার হন। ১৮৯০ সালে কানাডার বৃহত্তম নারী উন্নয়নমূলক গোষ্ঠী—Womens Christian termprance Union (WCTU) নারীর ভোটাধিকার আন্দোলনকারীদের পক্ষে সার্বিক সমর্থন দেয়। ১৯১৪ সালে ক্রমবর্ধমান শিল্পায়ন ও নগরায়ণে কানাডা সরকার নতুন আদিবাসীদের কীভাবে সম্পৃক্ত করবে, সে ব্যাপারে বিশেষ দৃষ্টি আরোপ করে। এ সময় আন্দোলনকারীদের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী নারী কর্মী যাঁরা মজুরি বিভাজন ও বৈষম্যের শিকার হন, তাঁরা নারীর ভোটাধিকারকে অধিকার প্রতিষ্ঠার একটি মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করেন। এ সময় ১৯১০ সালে কানাডিয়ান উইমেন্স কাউন্সিল নারীর ভোটাধিকারের বিষয়টিকে অনুমোদন করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে এই আন্দোলন অনেক ভাগে বিভক্ত হয়। আন্দোলনকারীদের অনেকেই কানাডিয়ান সেনাবাহিনীতে নাম লেখান। সমাজতান্ত্রিক আদর্শের অনুসারীরা যুদ্ধ বন্ধের বিষয়ে মনঃসংযোগ করেন।

নারীবাদ ও ভোটাধিকার আন্দোলন কেন্দ্রীয় পর্যায়ে নানা বাধার সম্মুখীন হলেও কানাডার পশ্চিম দিকের প্রদেশে আন্দোলনকারীরা একটু ভিন্ন মাত্রায় অগ্রসর হচ্ছিলেন। তাঁরা ভোটের মাধ্যমে নবাগত অভিবাসীদের আকৃষ্ট করতে চাইছিলেন। উইমেন ক্রিস্টিয়ান উইমেন্স টেম্পারেন্স কাউন্সিলের সদস্য ও সাধারণ আন্দোলনকারীরা এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। ১৮৭০ সালের শুরুর দিকে মানিটোবা আইস্ল্যান্ডিক অধিবাসীরা নারীর ভোটাধিকার আন্দোলনকে পূর্ণ সমর্থন দেন। কানাডার পশ্চিম অংশের অধিবাসীরা নারীর ভোটাধিকার আন্দোলনকারীদের অনেক সমর্থন দিয়েছিল। তবে এই অঞ্চলের আন্দোলনকারীরা দুঃখজনকভাবে নৃতাত্ত্বিক আদিবাসী কানাডার নারী সদস্যদের প্রতি খুব বেশি মনোযোগ দেননি। ১৯১৬ সালে কানাডার মানিটোবার একজন নারী ভোটাধিকার পান ও প্রাদেশিক পর্যায়ে নির্বাচিত হন। এই আদর্শে সাস্কাচেওয়ানে ১৪ মার্চ ও আলবার্টায় ১৯ এপ্রিল নারীর ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্রিটিশ ভোটাধিকার আন্দোলনের কর্মী বারবারা হোয়লি ১৯১২ সালে সাস্কাচেওয়ানে আসেন। তিনি আন্তর্জাতিক পর্যায়ের একটি যোগসূত্র স্থাপনের ধারাবাহিকতায় সফল অবদান রেখেছিলেন।

এই সময় বিভিন্ন নারীর প্রশ্নে সমতা ও অধিকার রক্ষার সংস্থা যেমন Womesn Grain Growers Assoaciation, farm Journalist ও সাস্কাতুনের নারীবাদী সংগঠন WGGA violent McNaughton একসঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে PROVINCIL Equal Franchise Board গঠন ও একযোগে কাজ করে। নারীর ভোটাধিকারের আন্দোলনের কর্মসূচি আলবার্টায় অনেকটাই শহরকেন্দ্রিক ছিল। ব্রিটিশ কলম্বিয়ার নারীর ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার সংস্থাগুলো আমেরিকা ও যুক্তরাজ্যের যোগাযোগ রক্ষা করত। ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় ফেডারেশন অব লেবার সাফরেজিস্ট ১৯১২ সালে নারীর ভোটাধিকার আন্দোলনকে অনুমোদন দেয়।

কানাডার অনেক স্থানেই স্থানে এশিয়ান নারীদের খুব বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়নি। বাস্তবে তাঁদের অবস্থান রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অনেকটা প্রান্তিক রয়ে যায়। তাঁরা মূল আন্দোলনের আদর্শে একাত্মতা প্রদর্শন করতে পারতেন না। একমাত্র ব্রিটিশ কলাম্বিয়াই নারীর ভোটাধিকারের সমর্থনের বিষয়টি নিয়ে পুরুষের মধ্যে গণভোটের আয়োজন করে। ১৯১৭ সালের ৫ এপ্রিল সেখানে নারীর ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এর কিছুদিন পর ২৮ এপ্রিল ওন্টারিও সরকারের পক্ষ থেকে নারীর ভোটাধিকারবিষয়ক বিল পাসের বিষয়টি রক্ষণশীল সরকারের পক্ষ থেকে কিছুটা প্রাধান্য মেলে। তবে তাঁদের এই প্রচারণা প্রাদেশিক স্তর থেকে বেশ প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। ওন্টারিও আন্দোলনের অনেক প্রতিভাধর নারী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাঁদের একজন হলেন ফ্লোরা ম্যাকডোনাল্ড ডেনিশন। তিনি পরবর্তীকালে ব্রিটিশ কর্মী এমিলি পানখুর্স্টের সঙ্গে কানাডিয়ান এই আন্দোলনের বার্তা যুক্তরাজ্যে প্রচার করেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে অবশ্য নারী ভোটাধিকার আন্দোলনকারীদের নানা ধরনের চাপের সম্মুখীন হতে হয়। এ সময় একটি বিতর্কিত ‘ওয়ার টাইম অ্যাক্ট’-এর মাধ্যমে ১৯১৭ যাঁরা কেবল নার্স হিসেবে কানাডিয়ান সেনাবাহিনীতে কাজ করেছেন, সেসব নারীর জন্য সুকৌশলে ভোটার হওয়ার ক্ষেত্র নির্ধারিত হয়। এই আইনের মাধ্যমে নির্বাচনের অংশগ্রহণ করার মৌলিক অধিকার রোহিত করা হয়। যাঁরা তাঁদের ধর্মীয়, নৈতিক বোধ ও বিশ্বাসের কারণে যুদ্ধে যেতে নারাজ ছিলেন, তাঁদেরও বিভক্ত করা হয়। ১৯১৮ সালের ২৪ মে ২১ বছর বা তার অধিক বয়সের নারীরা ফেডারেল বা কেন্দ্রীয় পর্যায়ে ভোট দেওয়ার অধিকার পান। ১৯১৯ সালের জুলাই মাসে হাউস অব কমন্সে তাঁরা ভূমিকা রাখার অধিকার পান। তবে সিনেটের উচ্চপর্যায়ে তাঁদের তেমন কোনো অধিকার ১৯২৯ সালের আগে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কানাডার ডোমিনিয়নে ১৯২০ সালের নির্বাচন অ্যাক্ট অনুসারে অবশ্য অনেক চায়নিজ, এশিয়ান, ইনুইট ও মাইটিস জাতিগোষ্ঠীকে ভোটদানের আওতামুক্ত রাখা হয়েছিল।

আটলান্টিক প্রদেশে ১৮৫১ সালে নারীদের ভোটাধিকার বর্জন করা হয়। এর প্রতিবাদে ১৮৯০ সাল থেকে নোভা স্কশিয়ান নারীরা এ ভোটাধিকার অধিকার সংরক্ষণে স্থানীয় কর্মী ও টেম্পরেন্স ইউনিয়ন দীর্ঘ প্রচারণা চালায়। সমাজসংস্কারক এলিজা রিচি ও আনা লিওননেস এ প্রচারণায় যুক্ত ছিলেন। ১৯১৮ সালের ২৬ এপ্রিল নোভা স্কশিয়ান নারীরা ভোটের অধিকারপ্রাপ্ত হন।

কুইবেকে নারীর ভোটাধিকার আন্দোলনকারীরা ছিলেন একাধারে ব্রিটিশ ও ফ্রেঞ্চ বংশোদ্ভূত। আন্দোলনকারীদের মধ্যে ড. অক্টিভিয়া গ্রেস রিচি ইংলিয়ান ও ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আইডল সেন্ট ইংল্যান্ড উল্লেখযোগ্য। তাঁদের নেতৃত্বে ও উন্মুক্ত আদর্শের সহায়তায় ১৯৪০ সালের ২৫ এপ্রিল এই অঞ্চলে নারীর ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণার মাধ্যমে কানাডার চায়নিজ ও দক্ষিণ এশিয়ায় নাগরিকের ভোটাধিকারের বিষয়টি সমুন্নত হয়। আন্দোলনকারীরা ইউরোপিয়ান হলেও অনেকেই আদিবাসী নারীর প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। তবে তাঁদের প্রতি অসহযোগিতামূলক মনোভাবের কারণে আদিবাসীদের কোনো বিচ্ছিন্ন মৃত গোত্র রূপে বিবেচনা করা। আদিবাসী নারীরা স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের গোত্র ও স্থানীয় উন্নয়নকল্পে বেশি আগ্রহ ছিলেন। ১৯৩৪ সালের ডোমিনিয়ন আইন বিধি অনুসারে রিজার্ভ অঞ্চলে অবস্থিত ইনুইট গোত্রকে সম্পূর্ণভাবে আলাদা রাখা হয়। ১৯৫০ সালের আগে ভোটার তালিকায় তাঁদের নাম সংযুক্ত করা হতো না। অনেক কমিউনিটিকে ব্যালট বাক্স প্রদান করা হতো না। ১৯৬০ সালে রাজধানী অটোয়া থেকে সব নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর জনগণের ভোট নিশ্চিত করা হয়।

কানাডার রাজনীতিতে নারীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগ্নেস ম্যাকফাইল ছিলেন প্রথম নারী, যিনি হাউস অব কমন্সের একটি আসনে জয়ী হন। কানাডার উত্তর পশ্চিম সীমান্তের টেরিটরি অঞ্চল থেকে ১৯৮৮ সালে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন আদিবাসী নারী প্রার্থী লিবারেল দলের ইথেল ব্লন্ডিল এন্ড্রস। ১৯১৭ সালে আলবার্তার লুই মাকনায় প্রাদেশিক আইনসভায় নির্বাচিত হন।

নারীর ভোটাধিকার আন্দোলনের পরম্পরায় ধীরে ধীরে কানাডার রাজনীতিতে আসেন আরও অনেক নারী। ১৯৪১ সালে পাঁচজন নারী এমএলএ (মেম্বারস অব লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি) নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালের আগপর্যন্ত এই ছিল আইনসভায় নারীর সবচেয়ে বৃহত্তম অবস্থান। ১৯৯৬ সালে ব্রিটিশ কলম্বিয়া আইন সভায় চায়নিজ কানাডিয়ান নারীকে নির্বাচিত করা হয়। ১৯৯১ সালে রিতা জনসন ব্রিটিশ কলম্বিয়ার প্রথম প্রিমিয়ার নির্বাচিত হয়েছিলেন। কানাডার বর্তমান লিবারেল সরকারের মন্ত্রিসভা বা কেবিনেট গঠিত হয়েছে ১৬ জন পুরুষ ও ১৬ জন নারী সদস্য নিয়ে সমতার ভিত্তিতে।

কানাডার রাজনৈতিক ও ভোটাধিকার আন্দোলনের ইতিহাসের এই প্রেক্ষাপট এ আলোচনা থেকে তো সহজেই অনুমেয় কত দীর্ঘপথের চড়াই-উতরাই পার হয়ে নারীর ভোটাধিকার রক্ষার আন্দোলনের পথটি গড়ে উঠেছিল। তবে ধর্ম, বর্ণ, গোত্রভিত্তিক আদর্শের বিভিন্নতার কারণে অনেক নারীই বিভাজিত হয়েছেন, যা সার্বিক আন্দোলনের সর্বজনীনতার দর্শনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তবে দীর্ঘ সময়ের সুসংহত এই প্রয়াস ঐক্যবদ্ধ নারীদের সব আন্দোলন সম আদর্শের প্রয়াসের অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। এই দীর্ঘ আন্দোলনের যাত্রাপথে নারীর অধিকারের বিষয়টির সঙ্গে সঙ্গে কানাডার নারী শিক্ষা, নারীর কর্মসংস্থান ও মজুরি বৈষম্য, দৈনন্দিন নির্যাতন ইত্যাদি দিকগুলো বিভিন্নভাবে আলোচিত হয়েছে। আন্দোলনকারীদের যৌথ প্রয়াসে কানাডায় মায়েদের ভাতা, অবসর তহবিলের বিষয়টি ত্বরান্বিত হয়েছিল। এখনো কানাডায় আরও অনেক ক্ষেত্রে নারীর প্রতি নানা নির্মম বিভাজন বর্তমান। শুদ্ধ মানবিক আদর্শে লালিত নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার মুক্তি আন্দোলনকে অতিক্রম করতে হবে সুদীর্ঘ বন্ধুর পথ। এই মানবিক আন্দোলনের সফলতার জন্য নারীর প্রতি সমাজের সবার ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাব গঠন একান্ত প্রয়োজন। সবার জন্য বিশ্ব নারী দিবসের শুভেচ্ছা।