এলোমেলো কথন

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

আরও অনেকের মতো আমার বর্ণময় শৈশব ও দুরন্ত কৈশোর কাটানো অজপাড়াগাঁয়ে যখন ইলেকট্রিসিটি, টেলিভিশন, ইন্টারনেট ও স্মার্টফোন ছিল না। তখন মার্কোনির রেডিও ছিল আমাদের বিনোদন ও গণযোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। প্রযুক্তির উৎকর্ষের কাছে মার খাওয়া প্রিয় রেডিও এখন শুধু মাঝেমধ্যে গাড়ি চালানোর সময় কিছুটা শোনা হয়। CBLA-FM নাইনটি নাইন পয়েন্ট ওয়ান; টরন্টো লোকাল ব্রডকাস্টিং স্টেশন, আঙুলের একটা চাপেই স্টার্ট। রেডিও চলছে গাড়িও চলছে। নিউজ টকিং হচ্ছিল, বিষয় হোমলেস পিপল। কানাডায় মানুষ গৃহহীন হওয়ার চারটি অপরিহার্য কারণ; ঊর্ধ্বমুখী দরিদ্রাবস্থা, সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসন ঘাটতি, মানসিক স্বাস্থ্যসেবার অনিশ্চয়তা এবং ভায়োলেন্স, অ্যাবিউস, সামাজিক সংযোগ বিচ্ছিন্নতার অনুরূপ সমাজের উপাদানসমূহ...।

একটু প্রশস্ত ইন্টারসেকশনে অ্যাম্বার বা হলুদ বাতিতে খানেক স্পিড আপ করে পার হওয়ার অপচেষ্টা না করেই সরাসরি ব্রেক দাবালাম। কারণ, সাবধানের তো মাইর নাই। আশপাশে আড়ালেই ওত পেতে থাকে পুলিশ, কখন মক্কেল ধরে একটা টিকিট হাতে গুঁজে দেবে। টরন্টো পুলিশের এটা একটা মুখ্য কাজও বটে। গ্রিন সিগন্যালের জন্য অপেক্ষারত। এমতাবস্থায় রাস্তার ডিভাইডারের ওপর দাঁড়ানো এক শক্তসামর্থ্য যুবক বেশভূষাও মন্দ নয়, মাথার হ্যাট হাতে নিয়ে হাত এগিয়ে আই কন্টাক্ট করে স্মার্টলি বলল, ‘মে আই হ্যাভ স্পেয়ার চেঞ্জ টুডে।’ এই যুবক হোমলেস নয়, ‘পেনহেন্ডলার’—ভয়ভীতি বা বলপ্রয়োগ না করে অর্থাৎ ক্রিমিনাল কোডের সীমা লঙ্ঘন না করে রাস্তায় পয়সা খোঁজার লোক। এই শহরের পাবলিক প্লেসে এমন সিনারিও নতুন কিছু নয়। যদিও দেশের প্রচলিত আইনে এ কর্ম নিষিদ্ধ, তবে যতক্ষণ না অ্যাগ্রেসিভ প্রথায় লিমিট ভঙ্গ করে পাবলিক সেফটি নষ্ট না করে ততক্ষণ অজানা কারণে আইন এখানে কিছুটা চোখ বন্ধ করে থাকে। ঘাড় ঘুরিয়ে নিতেই, বুঝে গেছে রিফিউজড। ভবঘুরেদের পুনর্বাসন সংস্থায় কর্মরত এক বন্ধুর মুখে শুনেছিলাম এদের দান-খয়রাত করা মানে তাদের বদ অভ্যাসে ফুয়েলিং করা।

ক্ষণিকের সিগন্যাল বিরতিতে দীর্ঘ অন্তত পঁচিশ বছর পরে প্রসঙ্গত অনুরূপ একটি দৃশ্যকল্প মনের আয়নায় ভেসে এল। বাংলাদেশের যত্রতত্র হররোজের এ জাতীয় স্বাভাবিক চিত্রপটের মধ্যে এটা একটু আলাদা বিধায় হয়তো বা এখনো মনে গেঁথে আছে। স্মৃতিতে এখনো সক্রিয় ঢাকা–সিলেট রেলপথে চলন্ত ট্রেনে ইংরেজি বলে যাত্রীদের কাছে হাত পাতা সেই সুদর্শন ব্যক্তি। কুলাউড়া থেকে শায়েস্তাগঞ্জের মধ্যবর্তী ঢাকা সিলেট আপডাউন চলার পথে তাকে অনেকবার দেখেছি। একই রকম তার সাজানো গল্প। গল্পের সানেনজুলটা এ রকম—গত রাতে ডাকাতের কবলে পড়ে সর্বস্ব খোয়া গেছে, এখন সাহায্য দরকার বাড়ি ফিরতে হবে। জনগণের দয়া বা ভিক্ষাপ্রার্থী। বাংলাদেশে কিন্তু গড়গড় করে ইংরেজি বলার একটা সে রকম ভাবসাব ছিল একসময়। এখন জানি না কেমন হালহকিকত। সহজসরল মানুষেরা কেউ কেউ অবাক হয়ে কিংবা বিশ্বাস করে ওর পানে সাহায্যের হাতও বাড়াত।

এরা সুচতুর ভিক্ষুক, একটু অ্যাডভান্সড লেবেলের বা আপগ্রেডেড। কিন্তু প্রকৃত ভিক্ষুক বা ভিখারি সাধারণত হাম্বল মেনারড, হতদরিদ্র, রুগ্‌ণ, দীনহীন যার অন্নের সংস্থান নাই, পরনের বস্ত্র নাই, মাথা গোঁজার ঠাঁই নাই অথবা শারীরিক–মানসিক সীমাবদ্ধতাসম্পন্ন একজন যন্ত্রণাকাতর মানুষ। জীবনের করুণ পরিস্থিতি মোকাবিলায় এহেন নিরুপায় ভুক্তভোগী আত্মসম্মান, সমাজের ঘৃণার দৃষ্টি ইত্যাদির তোয়াক্কা না করেই এই পথ মাড়াতে বাধ্য হয়। ছোটবেলায় মুরব্বিদের মুখে শুনেছিলাম, লেংটির নিচে পরিধেয় নাই আর ভিক্ষাবৃত্তির নিচে পেশা নাই। এই দুই মারাত্মক শোচনীয় অবস্থার মুখোমুখি বা শিকার হয় মানুষ তখনই যখন তার দৈন্য আর অসহায়ত্বের সীমা-পরিসীমা চরমভাবে লঙ্ঘিত হয়। যদিও এটা পুঁজি, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও লাইসেন্স-পারমিট ছাড়াই অনিশ্চয়তা বা ঝুঁকিবিহীন আয়কর মুক্ত উপার্জনের সহজ একটি পন্থা। তবু পারতপক্ষে কোনো বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন ভদ্র সমাজের বাসিন্দা এ কাজে সম্পৃক্ত হয় না। যা আমরা সাদাচোখে দেখি এবং সহজ বোধে বুঝি। যদি বা ব্যতিক্রম দেখি কেবল জগন্ময় মিত্রকে, তিনি ভিখারি হয়েছিলেন ভালোবাসার অভাবে মাত্র একটা ফেলে দেওয়া মালা কুড়ানোর তাগিদে এবং সেটা কেবলই তাঁর গানে।

বাস্তবে ব্যতিক্রম কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্রচুর রয়েছে। উল্লেখিত ওসব খাছিলতের ভিখারি যাদের দৌরাত্ম্য আর উৎপীড়নে এই নিরীহ পেশাটি সন্দেহের আবর্তে ব্যাপক বিতর্কিত হয়ে আছে। ড্রাগ অ্যাডিক্ট, ডেলুডেড মিউজিশিয়ান, ফেইকার ও সিন্ডিকেট ভিখারিরা সমাজের সর্বত্র সাধারণ মানুষের বিশ্বাস, সহানুভূতি আর মানবিক ঔদার্যকে রীতিমতো ব্ল্যাকমেল করে চলেছে। স্থানকালভেদে এদের পরিচয় ও রূপটা শুধু ভিন্ন। সত্যিকারের বিপদগ্রস্ত লোক সমব্যথী মানুষের সাহায্য সহযোগিতা আশা করতেই পারে। কিন্তু সেই আশাটাকে ভিত্তি করে যদি অলস ও শ্রমবিমুখ লোক বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন তৈরি করে ফেলে তবে সে ক্ষেত্রে অবশ্যই তা সর্বদাই ঘোরতর নিন্দনীয়।

নিন্দাত্মক, প্রশ্নবিদ্ধ বা হতবাক করার মতো ভিক্ষুকের আজকাল ছড়াছড়ি যত্রতত্র নানা বেশে নানা দেশে। পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ মাল্টিকালচারাল সিটি নিউইয়র্কে এসব বর্ণচোরা ভিক্ষুকদের আস্ফালনও চোখে পড়ার মতো। পাতালরেল, ফুটপাত, টার্মিনাল, পার্ক, চত্বর সর্বত্র এদের অবাধ বিচরণ। কেউ কেউ এদের সাইড ওয়াক আর্টিস্ট বা বাস্কার বলে চালিয়ে দেয়। কিন্তু আমার বিবেচনায় এরা স্রেফ ভিক্ষুক। এটা কিনা তাদের জীবিকা নির্বাহের সহজ অবলম্বন। এদের অধিকাংশই কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান। নিউইয়র্কাররাও চলার পথে কিছু চেঞ্জ বা খুচরা ডলার বরাদ্দ রাখে ওদের জন্য।

এই সিটির ম্যানহাটনের টাইমস স্কয়ার শহরের প্রাণকেন্দ্র। যাকে বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত পথচারী সংযোগস্থল ও বিনোদন চত্বর বলা হয়। বিশেষ উল্লেখযোগ্য এক পর্যটক সমাগমকেন্দ্র। গত গ্রীষ্মের এক সন্ধ্যায় দেখেছি সেখানে সারি সারি গগনচুম্বী অট্টালিকার আড়ম্বর। ব্রডওয়ে থিয়েটারগামী দর্শকের ভিড়। বিশালাকার ডিজিটাল বিলবোর্ডের চোখ ধাঁধানো রঙিন আলোর ঝিলমিল তরঙ্গ। ফুটপাত আর চত্বরজুড়ে উৎসুক হাজারো পর্যটক। ভ্রাম্যমাণ খাবারের দোকান, নাচ, গান, শারীরিক কসরত, ম্যাজিক শো, ক্লাউন আরও কত–কী। এত উদ্দীপনার মধ্যে মৃদু পায়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়েছে হয়তো ঝালমুড়ি, ফুচকা, সাপের নাচ, বানরের খেলা ইত্যাদিও চোখে পড়বে। কিন্তু না একসময় তপন চৌধুরীর গানের মতো ‘হঠাৎ দেখে চমকে নির্বাক হয়ে গেছি থমকে’। সম্পূর্ণ নগ্ন দেহপল্লবজুড়ে বহু তারকাখচিত লাল-নীল আমেরিকান পতাকার নকশায় অস্থায়ী উলকি এঁকে কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গ দুই তরুণী ত্রিভঙ্গ অঙ্গবিক্ষেপে দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমে ভেবেছিলাম স্ট্যাচু হবে হয়তো। পথের দূরত্ব কমে আসতেই বিস্মিত! এই স্ট্যাচুরা কিনা কথা বলছে, ‘Take a picture with me; it only takes five bucks (ডলার)।’

বুঝে উঠতে পারলাম না এরা কোন ক্যাটাগরির মতলববাজ পেনহেন্ডলার নাকি বাস্কার? মোক্ষম সময়ে আচমকা বৃষ্টির অঝোর বর্ষণ মুহূর্তেই লন্ডভন্ড করে দিল শশব্যস্ত নির্ঘুম শহরের নানামুখী বিনোদনের পাঁচমিশালি আয়োজন। হারিয়ে গেল অগ্রগামী সমাজের ভ্রষ্ট রুচির অগ্রসর তারুণ্যের আংশিক প্রতিচ্ছবি।
...

সিদ্ধার্থ রায়: টরন্টো, কানাডা। ই–মেইল: <[email protected]>