এক আইসক্রিম মানবতা মাত্র

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

বিকেলে মুন এল হলে। মাসের ৫ তারিখ। পকেট গরম। মা দুই দিন আগেই পুরো মাসের খরচের টাকা পাঠিয়ে দিয়েছেন। প্রমার বাসা থেকেও টাকা পাঠিয়েছে। দুই বান্ধবী থাকি এক হলে। একটা জম্পেশ খাওয়াদাওয়ার আয়োজন করতেই হয়। আর মুন থাকে ইডেনের হলে। ওকে ফোন দিতেই সে হাজির। গত চার বছরে এতবার মুন এই হলে এসেছে যে দাদুরা তাকে এই হলের একজন বলেই মনে করে।

অনেকক্ষণ গল্পের পর মুনকে নিয়ে হলের স্টোরে গেলাম কিছু স্ন্যাকস কিনতে। আমাদের আগে আরও দুজন মেয়ে লাইনে আছে আর হলের ডাইনিংয়ের নতুন ছোট ছেলেটা। আমি বাইরে রাখা ডিপ ফ্রিজের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, নতুন আইসক্রিম আনা হয়েছে, অনেকগুলো ফ্লেভারের।

মুনকে বললাম, মুন, আইসক্রিম খাওয়াবি একটা?

মুন খুব হিসাবি মেয়ে, সংসারী। কিন্তু আমি আর প্রমা তাকে সারাক্ষণ কিপটে বলে ওকে খেপাই। আমি আর প্রমা ঠিক যতটা বেহিসাবি মুন ততটাই হিসাবি। কিছু ক্ষেত্রে একটু বেশিই হিসাবি। তাই স্টোরে ওকে খুব চাপাচাপি শুরু করে দিলাম। আমি চিপস, চকলেট, চানাচুর, নুডলস ও ডিম—এগুলো কিনব। আর মুন কিনে দেবে আইসক্রিম। মুন কিনে দেবে না। আমিও নাছোড়বান্দা। স্টোরের সবাই দেখছে আমাদের দুষ্টুমি। এসব খুনসুটি হয়েই থাকে হলের ভেতর।

: দোস্ত, দে না একটা আইসক্রিম। আচ্ছা, কী এমন চাইলাম। একটা আইসক্রিমই তো। আমাকে দে, প্রমাকে দেওয়া লাগবে না। আমরা ভাগাভাগি করে খাব। তা–ও কিনে দে।

আমি তো আমার মতো বলেই যাচ্ছি। মুন তার ব্যাগ থেকে একটা টাকাও বের করবে না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের এসব হাত ধরে টানাটানি, দুষ্টুমি খুব আনন্দ নিয়ে দেখছিল ডাইনিংয়ের নতুন ছেলেটা। মুন অবশেষে রাজি। স্টোরের দাদু আমাদের জিনিস প্যাক করছেন। ডাইনিংয়ের নতুন ছেলেটা খুব আস্তে আস্তে দাদুকে জিজ্ঞেস করল, ‘আইসক্রিম দেন আমারে একটা।’ দাদু বললেন, ‘ফ্রিজে আছে, কোনটা খাবি বাইর কর।’

আমি বুঝলাম, আমার তামাশা দেখে তারও খাওয়ার শখ হয়েছে। আমরা চুপচাপ শুনছি আর অপেক্ষা করছি আমাদের প্যাকেটের জন্য। আমি যে আইসক্রিমটা হাতে নিয়েছি, সেটা বের করে ছেলেটা বলল, ‘এইটা কত দাম?’ দাদু বললেন, ‘পঞ্চাশ টাকা।’ ছেলেটি আইসক্রিমটা রেখে দিল জায়গামতো। আরও অনেকগুলো আইসক্রিম পাশাপাশি। সে বুঝতে পারল না কোনটা নেবে। বুকপকেট থেকে পাঁচ টাকার নোট বের করে হাতে নিয়ে দাদুকে জিজ্ঞেস করল, ‘পাঁচ টাকায় আইসক্রিম পাওয়া যাইব?’

আমি ওকে দেখছিলাম। মানুষকে বিশ্লেষণ করা আমার একটা সহজাত স্বভাব। ও যতটা আগ্রহ নিয়ে একটা আইসক্রিম খেতে চেয়েছিল, দাম শুনে ততটাই দমে গেল। ‘পাঁচ টাকায় একটা আইসক্রিম পাওয়া যাইব’ কথাটা আমার বুকে বিঁধল। আমি আইসক্রিম আর খাবারের প্যাকেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। মুন বিল দিচ্ছে। দু–তিন দিন ধরে ছেলেটা আমাদের হলের ডাইনিংয়ে নতুন কাজ করছে। ডাইনিংয়ে খেতে গিয়ে দেখেছি। গ্রামে এখনো পাঁচ টাকায় আইসক্রিম পাওয়া যায় হয়তো। দাদু বললেন, ‘পাঁচ টাকার আইসক্রিম এই দোকানে নাই রে ব্যাটা। জিনিসপত্র লইয়া অহন যা।’

ছেলেটা টাকাটা পকেটে রেখে দিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার নাম কী?’ ‘আমি বিল্লাল।’

আমি হাসিমুখে ওকে বললাম, ‘বিল্লাল, তুমি একটা আইসক্রিম নাও এখান থেকে। আমি তোমাকে একটা কিনে দিচ্ছি।’

বিল্লাল খুব লজ্জা পেয়ে বারবার না করতে লাগল। আমি ওকে একপ্রকার জোর করেই কিনে দিতে চাইলাম এবার। স্টোরের দাদুও ওর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপা খুশিমনে দিতে চাইছে, নিয়া নে।’ বিল্লাল একটা আইসক্রিম বের করল ফ্রিজ থেকে। আমি আমার হাতে থাকা আইসক্রিমটা দেখিয়ে বললাম, ‘তুমি না প্রথম এটা খেতে চেয়েছিলে। তাহলে অন্যটা নিলে কেন!’

বিল্লাল লজ্জায় তাকাতে পারছে না। মুখটা অন্যদিকে নামিয়ে বলল, ‘আপা, ওইটার অনেক দাম, পঞ্চাশ টাকা। একটা হইলেই হইল। আমি তখন বুঝতে পারি নাই। অত দামি আইসক্রিম খাওয়া লাগব না।’ আমি বললাম, ‘খাবেই যখন, একটা ভালো কিছুই খাও। সব সময় তো এমন সুযোগ হয় না। দিচ্ছি আদর করে, নিয়ে নাও।’ সে একটু ইতস্তত হয়ে, লজ্জায় আর অনেকটা সংকোচে পঞ্চাশ টাকার সেই চকলেট ফ্লেভারের ‘কোন আইসক্রিমটা’ বের করে নিল।

আমি আইসক্রিমের দাম মেটালাম। আইসক্রিমটা নিয়ে ওর চোখে জল চলে এল। আমি দেখলাম, ওর গভীর আনুগত্যময় মুখটা। একটা আইসক্রিমের দামে আমি পেলাম বিল্লালের হাসিমুখ আর অন্তহীন ভালোবাসা। খুব সময় নিয়ে অল্প অল্প করে খাচ্ছে। দেখে মনে হলো, যদি পারত তাহলে অন্তত দুই দিন জমিয়ে রেখে একটু একটু করে খেত।

রাতের বেলা আমি আর প্রমা খেতে বসেছি, বিল্লাল আমাদের দেখেই রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল। সে স্বভাবসুলভ নম্রতা আর লজ্জামাখা মুখে এসে আমাদের খাবার দিয়ে গেল। এরপর থেকে ওর সঙ্গে আমার খুব ভাব হয়ে গেল। তার মুখটা মায়ায় ভরা। একটা লাজুক চাহনি আর স্বভাবসুলভ নম্রতা তার আচরণে।

একদিন খেতে খেতে বলি, ‘বিল্লাল, তুমি তো ভারী সুন্দর দেখতে। বড় হলে তোমাকে তো নায়কের মতো সুন্দর দেখাবে!’ সে ডাইনিং টেবিলটা মুছতে মুছতে বলে, ‘কী যে কন আপা! আমি নাকি সুন্দর নায়কের লাহান!’ সে লজ্জা পায় আবার মনে মনে খুব খুশি হয়। আচ্ছা, স্বপ্ন দেখারও কি প্রচ্ছন্ন শ্রেণিবিভাজন আছে? গরিব–বড়লোকের আলাদা আলাদা স্বপ্ন? নায়ক হওয়ার স্বপ্ন কি ও দেখতে পারে না? তা হলেও ছেলেটাকে আমি মাঝেমধ্যেই এটা ওটা বলে বোঝাতে চেষ্টা করি। এই বয়সে খারাপ সঙ্গে না মিশুক। সে সাধারণের মতো স্বপ্ন দেখতে শিখুক। আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজেকে নায়ক মনে করে আনন্দ উদ্বেল হয়ে উঠুক। কঠিন জীবনটা তাকে গ্রাস করে নেওয়ার আগে নিজেকে নিয়ে যেমন খুশি ভাবুক।

বিল্লাল আমার হলজীবনের একটা ছোটগল্প। সে জানে, আমি কী খাই না খাই। কখন হলে ফিরি না ফিরি। কোনো কোনো দিন সাড়ে নয়টার পর হলে ফিরে আমি ধরেই নিতাম, ডাইনিংয়ে আর খাবার পাব না। কিন্তু বিল্লাল সবজি রান্না হয়ে গেলেই, আমার জন্য আলাদা করে একটা বাটিতে তুলে লুকিয়ে রেখে দিত। আমি এ জন্য ওকে বকেছি কত দিন। সে অভিভাবকের মতো বলত, ‘আপু, আপনি তো নিরামিষ সবজি ছাড়া আর কিছু খান না, অন্যদের তো অন্তত কিছু না কিছু থাকেই খাওনের। তাই আপনার জন্য আলাদা তুইলা রাখি। শুধু সবজি খাইয়া বাঁচন যায়?’ বকা দেওয়ার পর থেকে সে আমাকে বলত না যে খাবার তুলে রেখেছে। তখন ভাবটা এমন যে সবজি অল্প ছিলই কড়াইতে, যেন আমার জন্যই।

যা হোক, আমি ব্যাগে টাকা থাকলে কোনো কোনো দিন আমার সঙ্গে সঙ্গে ওর জন্যও ‘কোন আইসক্রিম’ নিয়ে যেতাম। ও খুব পছন্দ করে যে! বোনেরা যেমন ভাইয়ের কোনো প্রিয় খাবার তাকে না দিয়ে খেতে পারে না, আমিও তেমনি এরপরে কখনো বিল্লালকে বাদ দিয়ে ওই আইসক্রিমটা খেতে পারতাম না। খাবার খেতে খেতে কত দিন বসে থেকে ওর গল্প শুনেছি। ও বলত, ওর বাবা-মায়ের কথা, ছোট বোনের কথা, বন্ধুদের কথা, বাড়ির কথা। বলতে বলতে চোখ ছলছল করে উঠত। আমিও হয়ে উঠতাম আবেগপ্রবণ। ওর কাছে শুনতাম তার জীবনের গল্প।

বিল্লালের বাবা কিছু কাজকাম করে না, মা বাড়ি বাড়ি কাজ করে একমাত্র ছোট বোনটার পড়ার খরচ চালায়। সে নিজে সিক্সে উঠে পড়া ছেড়ে দেয়। এরপর চলে আসে এই হলের ডাইনিংয়ে বাসন ধোয়ামোছার কাজ করতে। সে আমাকে বলে, ‘আপা, ভাবিতাসি, আর একটু বড় হইলে ড্রাইভিং শিখমু। এক একটা খেপ মারলে অনেক টাকা ইনকাম। অনেক টাকা হইলে পরে বিদেশ যামু গা, সৌদিতে, দেইখেন আপনি। তহন কিন্তু আপনেরে আমি আমার টাকায় আইসক্রিম খাওয়ামু’—এই সব কত কথা! বলতে বলতে তার চোখ চিকচিক করে ওঠে একটা চমৎকার দিনের আশায়, যেদিন সে অনেক টাকার মালিক থাকবে, আর কোনো অভাব থাকবে না।

একদিন বিল্লাল কোত্থেকে একটা ফোন নিয়ে আসে হলে। বলে, ‘আপা, মোবাইলটা চাচাতো ভাই দিসে। পুরান। আমারে আপনের নম্বরটা সেভ কইরা দেন।’

আমার হলে থাকার দিন ফুরিয়ে আসার দিনগুলোতে বারবার অনুরোধ করত, ‘আপা আর কয়ডা দিন থাইকা যান।’ দু–এক দিন ডাইনিংয়ে না দেখতে পেলে প্রমাকে এসে জিজ্ঞেস করত, ‘আপনের বান্ধবী কই? চইলা গেসে?’ হল ছাড়ার সময় ওকে একটা ব্যাগ আর দুই শ টাকা দিয়ে বললাম, ‘বাড়ি গিয়ে বোনকে দিয়ো ব্যাগটা। কিছু জামাকাপড় আছে হয়তো, ও পরতে পারবে।’ বিল্লাল আবেগে আপ্লুত হয়ে কেঁদে ফেলল আমার সামনেই। বলল, ‘আপা, আর কিছুদিন থাইকা যান হলে। আপনি চইলা গেলে হলে আমার এইহানে আপন কেউ থাকব না। নিজেরে এতিম মনে হইব আপা।’

এর কয়েক দিন পর ফোন করল বিল্লাল। ফোন ধরেই কেঁদে ফেলল, ‘আপা, এইডা কী করলেন আপনি। আপনার ভালা ভালা জামাগুলা সব দিয়া দিলেন! বইনে খুব খুশি। জানেন আপা, বইনে জামা পইরা ঘুইরা বেড়ায় আমার সামনে দিয়া আর আমার মনে হয় আমি যেন আপনেরেই দেখতাসি। বইনডা আপনার লাহান যদি হইতো! আপনের মতো আমার বইনও যদি এমন বড় ভার্সিটিতে পড়ত!’

আমি চুপ করে শুধু শুনি। ওর স্বপ্নগল্পের একমাত্র শ্রোতা আমি। একদিন সে বড় হবে। কাজ পাবে কোনো বাসে। ড্রাইভার বা হেলপার হয়ে বোনকে পড়াশোনা করাবে আর আমাকে নিজের উপার্জনের টাকায় একটা আইসক্রিম খাওয়াবে...এইটুকু স্বপ্নকে সঙ্গী করে সে বেঁচে থাকে প্রতিদিন। একটা মাত্র আইসক্রিমের মানবতায় যে ভালোবাসার শুরু, তা আজ স্বপ্নের পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে।
...

সপ্তদ্বীপা নীলাঞ্জনা: সুইডেন।