ক্যালিফোর্নিয়ায় বুয়েটের প্রাক্তন ছাত্রীদের পুনর্মিলনী

পুনর্মিলনীতে বুয়েটের প্রাক্তন ছাত্রীরা
পুনর্মিলনীতে বুয়েটের প্রাক্তন ছাত্রীরা

একদিন হঠাৎ করেই ফেসবুকে একটা ছবি চোখে পড়ল। এক সিনিয়র আপার বাসায় বুয়েটের কয়েকজন প্রাক্তন ছাত্রী একসঙ্গে হয়েছেন। ছবিটা দেখে ভীষণ ভালো লাগল। দু-একটা পরিচিত মুখ খুঁজে খুঁজে বের করলাম। একেকজনকে খুঁজে বের করি আর স্মৃতির রাজ্যে চলে যাই। তখনই মনে হলো, এ রকম একটা আয়োজনের চেষ্টা করি না কেন? বছর দেড়েক আগে আমরা আয়োজন করেছিলাম আমাদের বুয়েট ৯০ ব্যাচের পুনর্মিলনী। পুরোনো বন্ধুদের পেয়ে কী যে ভালো লেগেছে, সেটা বলে বোঝান যাবে না। সব মিলিয়ে মনে হলো, অন্তত কিছু আপা, বান্ধবী আর ছোট বোনকে যদি একসঙ্গে করতে পারি। জানতে পারি কে কেমন আছেন, কোথায় আছেন, কী করছেন। কিছুক্ষণের জন্য ফিরে যেতে পারি বুয়েটজীবনে। আর এই বন্ধনটাকে, যোগাযোগটাকে রক্ষা করা যায় ভবিষ্যতেও, তাহলে অনেক ভালো হবে।

আমি সুযোগ পেলেই কর্মজীবী মেয়েদের বা ছাত্রীদের সেমিনার–সম্মেলনগুলোয় যোগ দিই। অন্য ধরনের একটা শক্তি পাই। নিজের অস্তিত্বের সঙ্গে, নিজের আত্মার সঙ্গে, জীবনের সঙ্গে অর্থবহ একটা যোগাযোগ খুঁজে পাই। আর সেটা যদি হয় একদম নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের সম্মেলন, তাহলে সেটা হবে আরও অর্থবহ, প্রাণের কাছাকাছি। এই ভাবনা থেকেই যোগাযোগ শুরু করি আশপাশের বুয়েটের প্রাক্তন ছাত্রীদের সঙ্গে। প্রথমবার, তাই ভাবলাম খুব বেশি বড় আয়োজন নয়, ছোট পরিসরেই শুরু করি। আমি থাকি ক্যালিফোর্নিয়ার ফলসমে, অর্থাৎ উত্তর অংশে। আমার কাছাকাছি আছে সিলিকন ভ্যালি আর সানফ্রান্সিসকো। এই উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ার বুয়েটিয়ান মেয়েদের সঙ্গেই যোগাযোগ করেছি। আমার উদ্যোগ দেখে এগিয়ে এলেন আরও কজন। ফেসবুকের মাধ্যমে একজন আরেকজনকে খবর জানিয়েছেন, সামনাসামনি দেখা হলে বা ফোন করেও খবর জানিয়েছেন। এভাবেই জানাজানি হয়ে গেল আমাদের স্বপ্নের কথা।

পুনর্মিলনীতে যোগ দেওয়া সবাইকে স্মারক উপহার হিসেবে দেওয়া হয় এই কাপ
পুনর্মিলনীতে যোগ দেওয়া সবাইকে স্মারক উপহার হিসেবে দেওয়া হয় এই কাপ

দেখতে দেখতে অনেক উত্তেজনা আর আয়োজনের মধ্যেই এসে গেল ২ মার্চ। সম্মেলনের স্থান নির্ধারিত হয়েছে স্যানহোজের এভারগ্রিন শহরে। আগে থেকেই আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা ছিল বৃষ্টি হবে। তবু মনে ক্ষীণ আশা ছিল, প্রকৃতি যদি একটু সদয় হয়। আমাদের আশাকে ভেঙে দিয়ে সকাল থেকেই আকাশ মুখ কালো করে বসে থাকল। আর সেই সঙ্গে তুমুল বর্ষণ। মনটাই খারাপ হয়ে গেল। এই বৃষ্টি–কাদা ভেঙে, কনকনে ঠান্ডার মধ্যে ছুটির দিনে কে আসবে? রাস্তায় একসময় প্রবল বৃষ্টির জন্য দুই হাত দূরের গাড়িও দেখা যাচ্ছিল না। অনেকখানি সাহস করেই হাজির হলাম নির্ধারিত জায়গায়।

স্থাপত্যের প্রাক্তন ছাত্রী রেশমিনের নিজের হাতে তৈরি ব্যানার লাগাতে লাগাতে আর টুকটাক কিছু প্রস্তুতি নিতে নিতেই চলে আসতে শুরু করলেন সবাই। দেখা গেল, শুধু আমি নই, বৈরী আবহাওয়াকে তোয়াক্কা না করে প্রাণের টানে ছুটে এসেছেন সবাই। প্রায় ৫০ জন বিভিন্ন বয়সী প্রাক্তন বুয়েটিয়ানের কলতানে মুখরিত হলো ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রাক্তন ছাত্রী শারমিনের বাসা। ওখানেই আমরা সবাই মিলিত হয়েছিলাম।

কতজনের সঙ্গে কতজনের দেখা হলো কয়েক যুগ পরে। সদ্য তরুণী প্রাণচঞ্চল মুখগুলো সময় আর অভিজ্ঞতার সঙ্গে হয়েছে পরিণত। কিন্তু এখনো আগের মতোই আপন। পরিচয় হলো অনেক নতুন মানুষের সঙ্গেও। বিশেষ করে পুরোনোদের সঙ্গে নতুনদের। উপস্থিত ছিল ১৯৭৫ থেকে শুরু করে ২০১০ সালের ব্যাচ। ৫০ জন সফল নারী, আত্মবিশ্বাসে ঝলমল। মেধা, শিক্ষা, বুদ্ধির অপরূপ আলোয় আলোকিত। আবার একই শিকড়, একই সুতোয় বাঁধা প্রাণ।

প্রাথমিক আলাপচারিতার পর্বটাই ছিল ভীষণ আনন্দঘন। বহুদিন পরে ফিরে পাওয়া বান্ধবী, আপা আর ছোট বোনদের সঙ্গে জমে থাকা কত দিনের কত গল্প। প্রাণ উজাড় করা কথা। কত মধুর স্মৃতিচারণা। পুরোনো দিনে হারিয়ে যাওয়া। দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পর শুরু হয় মূল অনুষ্ঠান। আমাদের জন্য সুরেলা কণ্ঠে গানের দুই কলি গাইলেন স্থাপত্যের প্রাক্তন ছাত্রী ওয়াহিদা রশিদ। একে একে সবাই তাঁদের পরিচয় দিলেন। সঙ্গে কেউবা করলেন স্মৃতিচারণা, কেউ জানালেন তাদের অনুভূতি। উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল কারও কারও উৎসাহদানকারী কর্মজীবনের গল্প। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ১৯৮১ সালে বুয়েট থেকে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত রাশেদা আপা ও ১৯৯৬ সালে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত সামিনা আপা। ছিলেন বেশ কয়েকজন পিএইচডি ডিগ্রিধারী।

ব্যানার ও স্মারক উপহার
ব্যানার ও স্মারক উপহার

আলোচনা ও বিভিন্ন বক্তব্যে উঠে এসেছে পেশাগত জীবনে বা ছাত্রজীবনে মেয়েরা আগে ও বর্তমানে কী কী ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন বা আজও হচ্ছেন। আগের চেয়ে বর্তমান অবস্থার উন্নতি কিছু কিছু ক্ষেত্রে আশাব্যঞ্জক। বিশেষ করে পড়ালেখার ব্যাপারে মেয়েরা পরিবার থেকে এখন আগের চেয়ে বেশি উৎসাহ বা ফোকাস পায় তাঁদের ছাত্রজীবনে। আলোচনা চলে নতুন মায়েদের চাকরি করার ক্ষেত্রে কোন কোন ধরনের বাধা আসতে পারে। এমনই একজন মা জান্নাতুল ফেরদৌস শোনান তাঁর চাকরি বদলের গল্প। অনেক ক্ষেত্রে মেয়েরা এগিয়ে গেলেও পুরকৌশলের মতো ক্ষেত্রে এখনো অনেক কম মেয়ে দেখা যায় উন্নত দেশ আমেরিকাতেও। ফিল্ডের কাজে মেয়েরা এখনো দ্বিধা করেন। সেই দ্বিধাকে কীভাবে জয় করেছেন, সে গল্প শোনালেন আশফিয়া ইয়াসমিন। আমরা শুনেছি, বর্তমান যুগে কীভাবে মা-বাবা, স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ির কাছ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা পাচ্ছেন রুবাইয়া। আলোচনা হয়েছে নারী নির্যাতন, যৌতুক ও বিবাহবিচ্ছেদের মতো কিছু জটিল কিন্তু বাস্তব সমস্যা নিয়েও। কম্পিউটারের ছাত্রী সোনিয়া জাহেদ শুনিয়েছেন, কীভাবে ওই বিভাগের প্রাক্তন ছাত্রীরা বর্তমান ছাত্রীদের বিভিন্ন বিষয়ে জীবনমুখী উপদেশ দিয়ে সাহায্য করছেন।

আমরা সবাই আমাদের আলোচনায় এতই মগ্ন ছিলাম যে কেউ হয়তো খেয়ালই করেননি কোন ফাঁকে বৃষ্টি থেমে গেছে, মেঘ কেটে মিষ্টি রোদ উঠে গেছে। সম্মেলন শেষ হলো কেক কাটার মধ্য দিয়ে। ব্যতিক্রমধর্মী সুন্দর একটি দিন কাটিয়ে আমরা সবাই ফিরে এলাম কিছু মধুর স্মৃতি সঙ্গে নিয়ে আর অনেকখানি প্রাণশক্তি নিয়ে। আমরা সবাই বুয়েটিয়ান, যেখানে আমাদের শিক্ষা আর ব্যক্তিত্বের ভিত গড়ে উঠেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে আমরা ছড়িয়ে দিচ্ছি সেই শিক্ষার আলো, কর্মক্ষেত্র, পরিবার, সমাজ—সবখানে, মানচিত্রের সীমারেখা পেরিয়ে।