প্রবাসে মাহে রমজান

সিডনির আকাশে রমজান মাসের চাঁদ
সিডনির আকাশে রমজান মাসের চাঁদ

অস্ট্রেলিয়ায় রোজা শুরু হয় দুইভাবে। এখানকার মুসলমানদের একাংশ চান্দ্রবর্ষ অনুযায়ী যেদিন চাঁদ ওঠার কথা সেদিন রাতে সাহরি খেয়ে রোজা রাখেন। তাঁদের ব্যাখ্যা হচ্ছে, যেহেতু আজ চাঁদ ওঠার কথা ছিল সেটা খালি চোখে দেখা যাক বা না যাক, রোজা শুরু হবে। আরেক অংশ চাঁদ দেখে রোজা শুরু করেন। আমরা চাঁদ দেখে রোজা শুরু করি। কারণ চাঁদ দেখাটাকে আমাদের বাসায় আমরা উৎসবে পরিণত করেছি। প্রতিবারই আমরা রোজার শুরুতে বা ঈদুল ফিতরের আগের সন্ধ্যায় আমাদের বাসার বাইরের ঘরটাতে বসে থাকি। আমাদের বাসার অবস্থানটাই এমন যে পশ্চিম আকাশ পুরোটা দেখা যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এমন হয়, আমার অফিস রয়েছে তাই আমি অফিসে। আমার মেয়ে তাহিয়া চাঁদ দেখে আমাকে ফোন করে জানায়, চাঁদ দেখা গেছে। বলার সময় ওর কণ্ঠে খুশি ঝরে পড়ে। এবারও অফিসে ভীষণ কাজের চাপ ছিল। ইস্টারের লম্বা দশ দিনের ছুটি কাটিয়ে অফিস শুরু করেছি। তাই অনেক কাজ জমে আছে। এক সপ্তাহ ছুটি কাটিয়ে দুই সপ্তাহ ধরে সেই কাজের জের টানছি।

সন্ধ্যায় তাহিয়া ওর মায়ের মোবাইল থেকে মেসেজ দিল, বাবা চাঁদ দেখা গেছে। আমি আর দেরি না করে ডেস্ক থেকে উঠে প্রথমে জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু সুবিধা করতে না পেরে অফিসের বাইরে চলে গেলাম। প্রায় এক শ গজ হাঁটার পর বোটানি পাবলিক স্কুলের প্লে গ্রাউন্ড। আশা করছিলাম ওখান থেকে পশ্চিম আকাশ পুরোটা দেখা যাবে। আমার আশা বিফলে যায়নি। প্লে গ্রাউন্ডের গাছের ওপর দিয়ে দেখা যাচ্ছে ধনুকের পাতার মতো সরু বাঁকা চাঁদ। আমি ছোটবেলায় যেভাবে সালাম দিতাম, সেভাবে সালাম দিয়ে তাঁকে স্বাগত জানালাম আর তুলে নিলাম একটা ছবি। তারপর তাহিয়াকে ফোন দিলাম। তাহিয়া বলল, সেও ছবি তুলে রেখেছে আমাকে দেখাবে বলে। এভাবেই শুরু হয়েছে আমাদের এবারের রোজা।

অস্ট্রেলিয়ায় রোজা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছু বিষয় দেখা যায়। যেমন নির্দিষ্ট কিছু পণ্যে ছাড় দেওয়া হয়। খেজুর আমার খুবই পছন্দের একটা ফল। কিন্তু চেইনশপ উলর্থে সেটার দাম সাধারণত বিশ ডলার প্রতি কিলোগ্রাম। তাই আর সেটা কেনা হয়ে ওঠে না। কিন্তু রোজা শুরুর সঙ্গে সেটার দাম একেবারে অর্ধেক কমিয়ে দশ ডলার প্রতি কিলোগ্রাম হিসাবে দাম রাখা হয়। আমরা রোজার মাস এলেই এই খেজুর খেয়ে সারা বছরের অভাব পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করি। এবার রোজা শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই প্রচণ্ড ঠান্ডা পড়া শুরু হয়েছে। তাপমাত্রা একেবারে পাঁচ-ছয় ডিগ্রির মধ্যে ওঠানামা করছে। তাই ভোরবেলা উঠে সাহরি রান্না করে খাওয়ার সাহস আমরা করিনি। অবশ্য অফিসে যাওয়ার জন্য একটু পরেই আবার উঠতে হবে। তাই যত তাড়াতাড়ি পারা যায় সাহরি খেয়ে আবার আমরা শুয়ে পড়ি, যাতে অফিসে যাওয়ার আগে একটা ছোট ঘুম দেওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে আমাদের জন্য সবচেয়ে সহজ সাহরির আইটেম হলো খেজুর। কয়েকটা খেজুর পানি দিয়ে ধুয়ে পটাপট মুখে পুরে দিলেই সারা দিন আর ক্ষুধা লাগে না। ঠিক তেমনি, ইফতারের সময় যেহেতু কোথায় থাকা হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই ব্যাকপ্যাকের মধ্যে একটা ছোট বাক্সে খেজুর রেখে দিই। ইফতারের সময় গিন্নি মেসেজ দিলে সেখান থেকে কয়েকটা খেজুর খেয়ে ফেলি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অফিস থেকে ফেরার পথে বাসে বা ট্রেনে ইফতার করতে হয়। তাই খেজুর অনেক ভালো বিকল্প হিসেবে কাজে দেয়।

সাহরির সময় ঘুম থেকে ওঠাটা অনেক বেশি কষ্টের। তাই আমার মেয়ে তার মায়ের মোবাইলে সাহরির শেষ সময়ের আধা ঘণ্টা আগে অ্যালার্ম সেট করে রেখেছে। তবুও আমাদের বেশির ভাগ দিনই দেখা যাচ্ছে ওঠা হয়ে ওঠে না। তখন বারবারই দেশের রোজার সময়ের স্মৃতিরা এসে ভিড় করে মনের দরজায়। কে কার আগে চাঁদ দেখবে সেটা নিয়ে আমাদের পাড়ার তেমাথায় বাচ্চাদের মধ্যে চলত তুমুল প্রতিযোগিতা। তারপর পাড়ার সবাই মিলে তারাবিহ পড়তে যাওয়া। একসময় শুরু হলো খতম তারাবিহ পড়ার চল। তারপর শবে কদরের রাতে আমরা ছোটরা কে কয় রাকাত নফল নামাজ পড়েছি, সেটা নিয়েও মনে মনে আমাদের এক ধরনের অহংবোধ কাজ করত। আর সাহরির সময়টা ছিল স্বপ্নের মতো।

তারাবিহর পর আড্ডা
তারাবিহর পর আড্ডা

আমাদের পাড়ার মাতুব্বর মন্টু চাচা সব বিষয়েই করিতকর্মা মানুষ। তিনি দল বেঁধে পাড়ার প্রতিটি বাড়ির সামনে গিয়ে সেই বাড়ির পুরুষ মানুষদের নাম ধরে ডাকা শুরু করতেন। কোনো বাড়িতে পুরুষ মানুষ না থাকলে অমুকের মা বা অমুকের চাচি বলে ডাকা শুরু করতেন। যতক্ষণ পর্যন্ত ভেতর বাড়ি থেকে কেউ উত্তর না নিচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি ডেকেই যেতেন। আমাদের বাড়ির সামনে এসেই শুরুতে আব্বার নাম ধরে তারপর একে একে আমাদের তিন ভাইয়ের নাম ধরে ডাকা শুরু করতেন। আমরা কেউ উত্তর নিলেই তবে তিনি শান্ত হয়ে অন্য আরেকটা বাড়িতে গিয়ে ডাকা শুরু করতেন। পাশাপাশি মসজিদের মাইকে ঘণ্টায় ঘণ্টায় ডাকাডাকি চলত। তবে শহরের মতো অতটা ঘন ঘন না। আর গ্রামে মসজিদের সংখ্যাও একসময় অনেক কম ছিল।

আমাদের পাড়ার মসজিদের ইমাম মালেক চাচার আজান ছিল আশপাশের দশ গ্রামের মধ্যে বিখ্যাত। ওনার সুললিত কণ্ঠের আজান শুনলেই আমরা ভেতরে ভেতরে নামাজের জন্য এক ধরনের তাগাদা অনুভব করতাম। নামাজ শেষ করে ওনার সঙ্গে আড্ডা দেওয়া ছিল আমাদের প্রতিদিনকার নিয়মিত রুটিনের অংশ। আমার কাছে জামাতের বাইরে নামাজ পড়াটাকে কেন জানি নামাজ মনে হয় না কখনো। মসজিদে জামাতে নামাজ পড়তে গেলে অনেকের সঙ্গে দেখা হয়, কুশল বিনিময় হয়। নামাজ শেষে ছোট আড্ডা। এগুলো আমাকে বরাবরই টানে। তাই হয়তো বা জামাতে নামাজ পড়াটা এত ভালো লাগে। সাহরি খেয়ে মসজিদে গিয়ে জামাতে ফজরের নামাজ পড়ে আমরা জিকিরে শামিল হতাম।

রমজান মাসে প্রতিটি দিনই রুটিন করে ফজরের নামাজের পর জিকির করা হতো। আর তারাবিহর নামাজের শেষেও একই রকমের আড্ডা হতো প্রতিদিন, যেটা এই প্রবাসেও চালু রেখেছি। মিন্টোতে আমাদের বাসা থেকে হাঁটাপথে ১০ মিনিটের রাস্তা তারাবিহ পড়ার জায়গাটা। এই রাস্তাটুকু আমি হেঁটেই যাই। কারণ হেঁটে গেলে আমার কাছে মনে হয় কুষ্টিয়ার বাড়াদীতে আমি আমাদের গ্রামের মাটির রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে মসজিদে যাচ্ছি। তারাবিহর নামাজ শেষ করে আমি, বাপ্পি ভাই, স্বপন ভাই, আশফাক ভাই আড্ডা দিই। কখনো মিথুন ভাই বা পুলক ভাইও এসে যোগ দেন আমাদের সঙ্গে। আমরা চলে যাই সেভেন ইলেভেনের তেলের পাম্পে। সেখান থেকে কফি নিয়ে আড্ডা চলে গভীর রাত পর্যন্ত। তবে আমাদের এই আড্ডা হয় সাধারণত শুক্র ও শনিবার রাতে। কারণ অস্ট্রেলিয়াতে সাপ্তাহিক ছুটি শনি ও রোববার।

হেলডন স্ট্রিটের মেলা
হেলডন স্ট্রিটের মেলা

এবার আসি রোজা নিয়ে এ দেশি বা বিদেশিদের মনোভাবের বিষয়ে। আমার বস তৃতীয় প্রজন্মের ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত অস্ট্রেলিয়ান। তিনি রমজান এলেই বলেন, ‘তোমাদের রমাদান এসে গেল।’ এমনকি তিনি ঈদের খবরও রাখেন। আর আমাকে আগে থেকেই মনে করিয়ে দেন ঈদের ছুটি নেওয়ার ব্যাপারে। তাই ঈদের ছুটি নিয়ে আমাকে কখনো তাঁর সঙ্গে দেন দরবার করতে হয় না। রোজা শুরুর আগে চাঁদ দেখা থেকে শুরু করে তাঁর সবকিছুতেই আগ্রহ। কেন ঈদের সময় আমরা সরকারি ছুটি নিই না, সেটার বিষয়েও তিনি ওয়াকিবহাল। মুসলিমদের সংগঠনগুলো নিজেদের মধ্যে এখনো একক সিদ্ধান্তে আসতে না পারায় সরকারি ছুটি পাওয়া যাচ্ছে না। আমার মালয়েশিয়ান সহকর্মী যিনি ধর্মে খ্রিষ্টান আমাদের রোজার নিয়ম শুনে খুবই অবাক হন। আমাকে প্রায়ই জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমরা পানি না খেয়ে কীভাবে বেঁচে থাকো।’ আমার আরেক সহকর্মী রোজার সময় আমার ইফতারের জন্য মাঝে মধ্যেই অফিসে খেজুর নিয়ে আসেন। বছরের অন্য সময়ে আমি অবশ্য তার জন্য খেজুর নিয়ে এসে সেটা একটু পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি।

রোজার মাসে সিডনির বাঙালি পল্লিখ্যাত লাকেম্বাতে প্রতিদিনই রকমারি ইফতারির বাজার বসে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় এ যেন পুরান ঢাকার চকবাজার। এ ছাড়া বেশ কয়েক দিন হেলডন স্ট্রিটের একটা অংশ বন্ধ করে রাতজুড়ে চলে মেলা। ইফতারির সময় থেকে শুরু করে সেই মেলা চলে সাহরি পর্যন্ত। আমরা বন্ধুরা মিলে এক দিনের জন্য হলেও পরিবার পরিজন নিয়ে সেই মেলায় যাই। সেখানে গেলে মনে হয় এ যেন বাংলাদেশের কোনো গ্রামীণ মেলা। ছোট ছোট বাচ্চারা রাস্তাজুড়ে খেলা করে বেড়াচ্ছে। বড়রা খাবার কিনে খাচ্ছেন তার ফাঁকে ফাঁকে দিচ্ছেন আড্ডা। সে এক অন্য রকম পরিবেশ। সেখানে বিভিন্ন দেশের মানুষ ভিড় করেন সেই সব খাবারের স্বাদ নিতে। আমাদের সঙ্গে আমাদের অন্য ধর্মাবলম্বী বন্ধুরাও অংশ নেন। তখন মনে হয় আসলেই উৎসবগুলো সবার।