বন্ধন-তিন

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

বন্ধনের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব পড়ার পর এক বান্ধবীর প্রশ্ন, ফাল্গুনী, তৃতীয় পর্ব কই? আরও একজন আছে তোমার জীবনে? কে ইনি?

আমার এই ভাইবোন ব্যাপারটা নিয়ে চরম এক তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি পড়েছিলাম ২০১১ সালে। সে সময় যে ছেলেটি ভাই হয়ে আঠার মতো লেগে থাকত পাশে, সে আমার থেকে অনেক ছোট ছিল বয়সে এবং তার প্রেমিকাটিও তা-ই। এ ছেলেটি ছাত্র খারাপ ছিল না। তবে পড়া বোঝাতে হতো তাকে। প্রেমিকাটি শুরুতে কিছু না বললেও, একটা সময় বন্ধুমহলে রটিয়ে দিল, আমি নাকি তার প্রেমিককে ‘চুরি’ করেছি তার কাছ থেকে! বুঝুন আমার অবস্থা তখন। দোষ না করেও দোষী! তখন থেকে পণ করেছিলাম, থাক বাবা, আমি একা রিফাতকে নিয়েই থাকব, ভাই হওয়ার যোগ্যতা সব ছেলের থাকে না!

২০১৪ সালের মাঝামাঝি। আমি তখন বাংলাদেশের এক নামকরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি। মাঝে কিছু বছর চাকরিজীবনের স্বাদও নিয়েছি। তবে মারাত্মক এক সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে পড়ালেখা থেকে দূরে থাকতে হয়েছিল বেশ কিছুদিন। তাই ২০১৪ সালে আমার সব সহপাঠীই আমার থেকে একটু, বয়সে ছোট, যা আমার জন্য শাপে বর ছিল।

কিন্তু ওই যে বললাম, পণ করেছি আর কাউকে ভাইবোন ভাবতে পারব না, তাই মানুষ ঘনিষ্ঠ হতে চাইলেও, আমি শীতল আচরণে দূরে ঠেলতাম সবাইকেই। এর মধ্যে আর একজন হাজির!

সিগারেট খেকো বাঁদরগুলো ছিল আমার দুই চোখের বিষ। আমি এই ভোঁস ভোঁস ধূম্র শলাকায় ডুবে থাকা ভদ্রসন্তানদের থেকে ৫০০ হাত দূরে থাকতাম।

আরেক জাতের ভদ্র বাঁদরিও ছিল ক্লাস ও এর আশপাশে। এই হুরপরি সুন্দরীদের ধারণা ছিল, আমি হয়তো কোনো বাংলা মাধ্যমের ছাত্রী (বাংলা মাধ্যমকে ছোট করছি না মোটেও)। এই সুন্দরীরা মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করতেন, এসএসসি, সাল? এসএসসি সমমানের ইংরেজি মাধ্যমের ডিগ্রিটির নাম যেই নিতাম (Ordinary Level-O Level) অমনি বাঁকা হাসি, আপু, আপনি সারা দিন রবিঠাকুর নিয়ে থাকেন, বাঙালি ঢঙে সালওয়ার কামিজ, রেশমি চুড়ি, চুলে বিনুনি, আপু, মিথ্যা বলছেন আপনি!

কী যে অপমান মনে হতো বলার বাইরে। যখন এদের সব প্রশ্নের উত্তর ইংরেজিতে দিতে শুরু করতাম, ভুল ভাঙত তাদের। তবে ততক্ষণে বুঝে গেছি, ছেলে তো বটেই, মেয়েদেরও এড়িয়ে চলতে হবে।

অতএব, সবার সঙ্গেই বন্ধুবৎসল, তবে জানি হাসিমুখে কথা বলছি ঠিক, তবে কারও ওপর নির্ভর করা যাবে না।

তবে এর মধ্যে একজন একটু অন্য রকম ছিল। একদম ছিপছিপে গড়ন, উজ্জ্বল চোখের এ ছেলেটির মুখের সারল্য টানত আমায়। যেহেতু সে বিড়ি টানে না, এর পাশেই বসতাম ক্লাসে। উনি আবার ক্লাস মনিটর ছিলেন, তাই যোগাযোগ রাখতে হতো লেখাপড়ার ব্যাপারে জানতে। এনার নামটিও বেশ, ‘মৌসুম!’ মাঝে মাঝে রাগানোর চেষ্টা করতাম, ‘বলি ও পিচ্চি, কেউ মৌসুমী ডাকে না তোমায়?’ পাল্টা জবাব, ‘ডাকে তো!’

সিঁড়ি ভেঙে ওঠা আর এভারেস্টের চূড়ায় ওঠা এক আমার কাছে। এ কাজটি অসম্ভব কষ্টকর, যদিও কাউকে বুঝতে দিই না কখনো। নামতে পারব, কিন্তু তিন তলার বেশি উঠতে গেলেই মনে হয় মারা যাচ্ছি। আর যেখানে পড়তাম, সেই ভবনের সিঁড়ি অনেক খাঁড়া ছিল। বাধ্য হয়েই একদিন রাজকে (মৌসুম) বলতে হলো, ‘বই কিনে এনে দিতে পারো নিচের জলিল মামার দোকান থেকে? আমার পক্ষে একবার নামলে আবার ওঠা সম্ভব নয়, আর লিফটেও অসম্ভব ভিড়!’

‘এই যাচ্ছি, আপনার পাশের চেয়ারটা আমার জন্য রাখবেন শুধু।’ বলে একছুটে নিচে নামল সে। আমিও ব্যাগ দিয়ে একটা চেয়ার আটকে নিলাম।

সিঁড়ি ভাঙার কাজটি আমার হয়ে কেউ করা, মানে আমাকে সারা দিনের এক প্রচণ্ড শারীরিক যন্ত্রণা থেকে বাঁচানো। যদিও মারা গেলেও বলব না আমার সাহায্য প্রয়োজন। কারণ কারও করুণা নিয়ে থাকতে চাই না। করুণার দৃষ্টি আমার খুব চেনা, ঘৃণা করি করুণাকে।

আমার ব্যাগে একটা বড় Kitkat চকলেট বার ছিল। রাজ বই নিয়ে ফেরত এলে ধরিয়ে দিলাম ওকে, ছোট্ট কৃতজ্ঞতা। (যে কৃতজ্ঞতার কারণ তখনো রাজের অজানা।)

সে রাতে কৌতূহলী রাজ জানতে চাইল, ব্যাপার কী? আপু আপনাকে দেখে তো খুব একটা কিছু বোঝা যায় না। আপনার হাতে যা থাকে, তাতে এটুকু জানি একটা ঝামেলা আছে আপনার শরীরে, তবে তা তো খুব কঠিন কিছু মনে হয় না।

না আলহামদুলিল্লাহ খুব খারাপ কিছু না...তবে...। (সব খুলে বলতে হলো ওকে।)

কথায় কথায় জানলাম, রাজের জন্ম লেলুর মৃত্যুর ঠিক ২০ দিন আগে। আবার চমকালাম। তবে কী আল্লাহ একে আমার জন্য পাঠিয়ে তবে ওকে তুলে নিয়েছেন?

এখন বুঝি, হয়তো তা-ই। আপনি থেকে তুমিতে উঠতেই রাজের প্রায় দুই বছর লাগল। রিফুর মতো তুইতে উঠবে কবে, কে জানে। আমি অবশ্য তুইই বলি ওকে। আজ রাজের নিজস্ব একটা জায়গা আছে আমার জীবনে, আমার প্রতি ওর সম্মানজনক ভালোবাসার কারণেই। বয়সের তুলনায় চিন্তায় অনেক পরিপক্ব সে। তবে আমার কাছে এখনো সে সেই পিচ্চি, ছোট্ট খরগোশ। এখনো মাঝে মাঝে আবদার—‘আপ্পুউউউ...। সব আদর একা রিফাত ভাইয়ার? আমিও চাই তো!’

এই যে, লেখা শেষও হলো না, আমার মুঠোফোনে ডাক—‘আপ্পুউউউউ!’

কি রে রাজ, Kitkat খাবি না? অনেক আদর তোকে।
...

ধারাবাহিক এ লেখার আগের পর্ব দেখতে ক্লিক করুন