অহনার চিঠি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ফোনের পর ফোন। অহনার সবিনয় অনুরোধ উপেক্ষা করার আর কোনো উপায় রইল না। নিজের সঙ্গে অনেক বোঝাপড়া শেষে ওই অনুরোধ বুকে ধরেই এগিয়ে চলল অজিত। ওর এসব পাগলামির কোনো যুক্তিসংগত কারণ খুঁজে পায় না সে। মনে মনে বলে, ওর স্বামী মারা গেছে প্রায় তিন মাস আগে। কত মেয়ে তার স্বামীর স্মৃতি বুকে জড়িয়ে জীবন পার করে দেয়...।

অজিতকে দেখে অহনা সামনের চেয়ারটায় বসতে ইঙ্গিত করে। অজিত বসে।

এই অকালমৃত্যু মেনে নেওয়া কঠিন। কী হয়েছিল প্রণবের?

অহনা স্বাভাবিকভাবেই বলে, কিছু একটা তো অবশ্যই হয়েছিল। নইলে মরবে কেন।

অজিত এবার অহনার দিকে তাকাতেই পরিবেশটার অসহায়ত্ব অনুভব করে তার বুকটা কেঁপে ওঠে।

: না অজিত। এখন আর প্রণবকে নিয়ে কোনো কথা নয়। ওই অতীতকে আর কাছে ডাকতে চাই না।

বলেই অহনা কাছে এসে অজিতের একটা হাত খুব শক্ত করে বুকে চেপে ধরে।

অজিত জোর করে অহনার বুক থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নেয়। বারান্দায় এসে ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে উত্তর আকাশের দিকে চেয়ে থাকে। আজ কেন যেন পুরো দৃশ্যটাই অসহ্য হয়ে ওঠে। নিজের কাছেই তার ডজনখানেক প্রশ্ন। এসব কী হচ্ছে। না, অনেক দেরি হয়ে গেছে। এখন আর কিছু করার নেই।

: এই, একা একা বারান্দায় বসে কী সব বিড়বিড় করছ।

: অহনা, একটা মানুষের জীবন তোমার কাছে কিছুই না!

বারান্দার রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে অহনা অজিতের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ।

: মানুষ নিজেই যদি নিজের মূল্য না বোঝে, তাতে আমার কী করার আছে। দেখো না, কত মানুষ সুইসাইড করে। কেন করে?

: বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মানসিক রোগ। আবার অন্য কারণও থাকে।

: তাই বলো। আমাকে দেখে ওর হুঁশ ছিল না। প্রথম যখন আমাকে দেখতে আসে সবাই মিলে সব ঠিকঠাক। দেখাদেখিও শেষ। অবশেষে আড়ালে ডেকে নিয়ে আমি ওকে বেশ বিনয়ের সঙ্গেই বলেছি, প্লিজ, আমাকে বিয়ে করো না।

: আচ্ছা, সে তখন কী বলল?

: বলল, যাকে ভালোবাসো, তার সঙ্গে তোমার বিয়ের কি কোনো সম্ভাবনা আছে? বললাম, না। একেবারেই না।

এ কথা বলেই অহনার চোখ দুটি ভিজে আসে।

: হ্যাঁ, এরপর?

: এরপর প্রণব আনন্দে ঝকমকিয়ে ওঠে। বলে, তবে আমাকেই বিয়ে করো। তার এত আগ্রহ দেখে সবিনয়ে আবারও বললাম, জানি না কী হতে যাচ্ছে। কী হবে পরিণতি। আমার এ বুকে একটু জায়গাও খালি নেই, যেখানে আমি আর কাউকে ঠাঁই দিতে পারি। আমি আপনার কষ্টের কারণ হতে চাই না। সে তখন বেশ আগ্রহ নিয়ে বলে, না না, কষ্টের কী আছে। আমিও যে একজনকে ভালোবাসতাম। তাকে পাইনি। তোমারও একই অবস্থা। ভালোবাসা যাদের সফল হয় না, তারা কি ঘর বাঁধবে না? পাস্ট ইজ পাস্ট। ফরগেট ইট। এই হলো তার কাহিনি। এরপর কেটে যায় ছয় বছর। ভুলে যাওয়া? হলো আর কই। আজ বুঝি, ভালোবাসাকে নিয়ে গোঁজামিলের খেলা খেলতে নেই। এ খেলায় মানুষ হেরেই যায়। উদগ্র কামনায় কোনো একটা মেয়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার অধিকার পেয়ে গেলেই জীবনের হিসাব মিলে যায় না। সংসারে এমন কত প্রণব জীবনের কাছে পরাজিত হয়ে খসে পড়েছে। তাদের মনের কথাটা আর কাউকে বলেও যেতে পারে না।

একটা অস্পষ্ট হাহাকার গোপন করে অজিত বলে, দেশব্যাপী কাহিনিগুলো তো একই রকম।

: জানি না কার কী কাহিনি। আমি জানি আমার কাহিনি। এ গল্পের চেয়ে বড় আপন আমার জীবনে আর কিছু নেই।

এতক্ষণ অজিত অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল অহনার দিকে। এবার উদাস দৃষ্টি তার বাইরের দিকে। উত্তর দিগন্তে ধূসর একখণ্ড মেঘ সরে যায় ধীরে। কষ্ট ভেজা দু–একটি নীরব নিশ্বাসে অজিত বলে, আমি এমনটা চাইনিরে অহনা। নিজকে ক্ষমা করতে পারছি না।

অহনা অকপটে জবাব দেয়, এখানে তুমি আমি কেউ না। এখানে দায় বলতেও কিছু নেই। জীবনের রূপই এমন। যে যেদিকে নিজেকে প্রবাহিত করতে চায়, জীবন সেদিকেই যায়। প্রণব এর চেয়ে বেশি কিছু নয়। জীবনের ওই গুপ্ত জিজ্ঞাসার মাঝে তুমি আর আমি। আর কেউ নেই।

: তবে প্রণব...।

: প্রণব..., এই প্রণবরা বিয়ের জয়গান করে। বিয়ে নামক একটি অতিপ্রাচীন প্রথা এই একুশ শতকেও টিকে আছে বলেই কোনো নারীকে ছুঁয়ে দেখার সৌভাগ্য হয় ওদের। বুঝতেও চেষ্টা করে না যে অর্থ আর ক্ষমতার জোরে অধিকার করা কোনো নারীতে কখনো অন্তরের হাহাকার দূর হয় না। আমি চাই শিল্পময় স্বাধীন জীবন। বেশি কিছু চাই না।

কিছুক্ষণ দুজনই আনমনা। বসা থেকে উঠে অজিত বলে, আজ তবে আসি।

: আসি মানে! কোথায় যাবে এখন?

: সমগ্র বাংলা ঘুরে দেখব। দর্শনীয় স্থানগুলো। এই এক মাসে যতটুকু পারি। আপাতত যাচ্ছি শান্তিনিকেতনে।

: আমারও যে ইচ্ছে করছে তোমার সঙ্গে যেতে...।

: হ্যাঁ, ঠিক আছে। মন খারাপ করো না। সময় তোমার অনুকূলে আসা অবধি অপেক্ষা করতে হবে।

প্রবল আত্মবিশ্বাসে অহনা বলে, সময় আমার অনুকূলেই আছে। আর মনে রেখ, আলো আমার একেবারে অসহ্য। স্বামী মরার সঙ্গে সঙ্গেই ঝলমলে আলোর নাট্যমঞ্চ থেকে বিদায় নিয়েছি।

: আমাদের এ দেশে এখনো মানুষকে আলোর নাট্যমঞ্চেই বসবাস করতে হয়। ওখানে অভিনয় ছাড়া আর কিছুই নেই। কিছুক্ষণ ভেবে অজিত বলে, আচ্ছা, ঠিক আছে। তুমি সঙ্গে যাবে। তাই আর ওদিকে যেতে ইচ্ছে করছে না। চলো, কক্সবাজারে যাই।

অহনার চোখে আনন্দের ঝিলিক।

: আমারও খুব ইচ্ছে করছিল সাগর দেখতে। তবে তাই হোক।

অহনা আনন্দে অজিতকে জড়িয়ে ধরে। তার শরীরটা নিথর হয়ে পড়ে। অশ্রুভেজা চোখ দুটি নিরন্তর বহমান। জড়ানো কণ্ঠে অহনা বলে, এই এক কঠিন জেলখানায় কী করে কাটল আমার ছয়টি বছর। অনেক ত্যাগের পর বুঝতে পারছি নিজেকে স্বাধীন করতে না পারলে ভালোবাসা যায় না। মনের শিল্প-সুন্দর বাসনাগুলোকে গলাটিপে মেরে মানুষ কি কখনো সুখী হয়?

: মানুষ কি জানে সুখ কী?

: ওইভাবে কখনো চিন্তা করিনি।

: সাময়িক একটা অনুভূতি ছাড়া আর কিছুই না।

: তবে, তুমি আমি কিসের পেছনে দৌড়াই?

: জানি না। আচ্ছা, এত কাঁদছ কেন?

: তোমাকে পেয়ে অনেক ভালো লাগছে। আবার প্রণবের জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে। শুধু একটা ভুলের জন্য ব্যর্থতার অতলে তলিয়ে গেল ওর জীবন।

: তুমি নিশ্চয়ই জানো, প্রতিটি মৃত্যুই আমাদের কোনো না কোনো দিকে ছোট করে দেয়।

: হ্যাঁ, ঠিক তাই। মানুষ নিজেই যখন নিজের ধ্বংসের কারণ হয়। তার জন্য এক-আধটু দুঃখ ছাড়া আর কীই-বা করার থাকে।

: বলো তোমার ইচ্ছা কী?

: চল কোথাও চলে যাই। যেখানে আমাদের কেউ চেনে না।

: এই চেনা-অচেনার দ্বন্দ্ব বড় জটিল। জীবনকে ছন্নছাড়া করে দেয়। এই খাঁচা থেকে বের হতে না পারলে জীবনকে পাওয়া যায় না।

: চল প্রথমে সাগরপাড়ে যাই। কোনো একটা রিসোর্টে। যেখানে শুধুই তুমি আর আমি।

: রিসোর্ট! কক্সবাজারের কোলাহল থেকে সেন্ট মার্টিন আরও ভালো হবে মনে হয়।

: ঠিক আছে, চল। যেখানে ভালো লাগে।

: ওই দিন সন্ধ্যার পর তৃণা–নিশীথা ট্রেনে করে অহনা আর অজিত চট্টগ্রামের উদ্দেশে যাত্রা করে। কক্সবাজার পৌঁছাতে পরদিন বেলা এগারোটা বেজে যায়। শাওয়ার নিয়ে দুপুরের খাওয়া শেষে দুজনই ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম ভেঙে দেখে, সূর্য অস্তাচলে হেলে পড়েছে।

অহনা জানালার পাশে হেলান দিয়ে বসে চেয়ে আছে সাগরের পানে। কোনো সাড়াশব্দ নেই।

অজিত বলে, আমরা এখন পৃথিবীর বৃহত্তম সমুদ্রসৈকতে। চল ঘুরে আসি।

নিজেকে যথাসম্ভব পরিপাটি করে অহনা আর অজিত বের হয়ে পড়ে। অসংখ্য মানুষের ভিড়ে অহনা হঠাৎ বলে ওঠে, উহ, অনেক মানুষ। বিকট শব্দ আর কী সব চোখধাঁধানো আলো। ভালো লাগছে না। চল কোনো অন্ধকারে।

অহনার এই অদ্ভুত আচরণে অজিত অবাক হয়।

: খুব তো সমুদ্র দেখবে বলেছিলে। এখন আবার এসব কী?

প্রাণপণে অশ্রুজল গোপন করে অহনা বলে, প্রণবের জন্য মনটা কেমন করছে। মনে হয় ওকে ভালোবাসি। দুজনে মিলে অনেক যত্ন করে বাসাটা সাজিয়েছিলাম। আমার বাসাটা ভেঙে গেলেও ওই বাসায় তৈরি হওয়া ওমটুকু গায়ে লেগে আছে যেন।

: এখন তো আর উনি নেই। কী হবে ওসব মনে করে।

: জানি না। তবুও মনে পড়ে। মনে হচ্ছে নদীর পাড়ে শ্মশানের ওই বটগাছটার নিচে ঘাসের ওপর অনেক মায়ার জড়াজড়ি। প্রণবের দেহ ছাই করে চলেছে ওই আগুন। ধূসর ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে আকাশে মিশে যাচ্ছে। কেউ বুঝতে পারেনি ওই ধোঁয়ার মাঝে কী আছে। শুধু আমি জানি।

অজিতের মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।

: এসব কবিত্ব আর বৈরাগ্য আমার ভালো লাগে না।

: না লাগারই কথা। ওই বাস্তবতা তোমাকে ছুঁতে পারেনি।

হোটেলের কক্ষে ফিরে অহনা জানালার ব্লাইন্ড নামিয়ে দেয়। পর্দাগুলো টেনে কক্ষটাকে নিকষ অন্ধকার করে অহনা সোফায় আধশোয়া অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়ে।

অহনা গভীর ঘুমে মিশে গেলে অজিতের কেমন যেন ভয় করতে থাকে। হোটেল বয় খাবার দিয়ে গেলে অহনাকে ডাকতে গিয়ে কেন যেন আর পারে না। ক্লান্ত দেহটা এলিয়ে অজিতও শুয়ে পড়ে।

কক্ষের বারান্দার দরজাটা খোলা। ভোরের স্নিগ্ধ আলোয় অজিতের ঘুম ভাঙে। শিহরিত দৃষ্টিতে চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে বুকটায় মোচড় দিয়ে ওঠে। দেখা গেল, মেইন দরজাটাও একটু খোলা। অহনা নেই। টেবিলের ওপর একখানা চিঠি। দীর্ঘ চিঠিটি পড়া শেষে অজিত হোটেল থেকে দ্রুত বের হয়ে এসে সমুদ্রের সামনে দাঁড়ায়। একটা লম্বা নিশ্বাস ছেড়ে বলে, জীবন আসলেই সুন্দর।
...

ইসহাক হাফিজ: সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।
ই–মেইল: <[email protected]>, ফেসবুক: <Ishaque Hafiz>