সোনার হরিণ-দুই

বোস্টন শহরের একটি দৃশ্য। ছবি: ইন্টারনেট
বোস্টন শহরের একটি দৃশ্য। ছবি: ইন্টারনেট

কাজ করতে কষ্ট হবে জানতাম। তবে বুঝতে পারিনি সারা দিন দাঁড়িয়ে থাকা বেশ কঠিন ব্যাপার। লাঞ্চে একটা ব্রেক আর সকালে আর বিকেলে ছোট্ট একটা ব্রেক। কাজের সময় ফোন ব্যবহার করা যাবে না।

প্রথম ব্রেকে দৌড়ে বাথরুমে গিয়ে আরিফকে ফোন করলাম। ধরছে না। তার মানে, ঘুমাচ্ছে। লাঞ্চে ফোন করে যখন বললাম, ‘খেয়েছ?’ বলল, ‘এত আগে আগে কেউ দুপুরের খাওয়া খেতে পারে? মাত্র বাজে বারোটা?’

এ দেশের সময়গুলোর সঙ্গেও আরিফ এখনো অভ্যস্ত হতে পারেনি।

প্রথম দিন কাজের শেষে ভাইয়া তুলে নিয়ে গেলেন। না হলে যে কী হতো কে জানে। পা দুটো ব্যথায় টনটন করছে। যাওয়ার পথে ভাইয়া আমাকে বাসস্টেশন দেখিয়ে দিলেন। আমার কাজের জায়গা থেকে অন্তত বিশ মিনিটের হাঁটা পথ।

কিছু করার নেই। মেয়েদের স্কুল খুলবে। ওদের খরচ আছে। সেটার জন্য তো আর ভাইয়ের কাছে হাত পাতা যাবে না। শীত আসছে, সবার জন্য গরম জামা ও জুতাও কিনতে হবে। তা ছাড়া, আমার ইচ্ছা দুজনে কাজ শুরু করে ভাইয়ার হাতে মাসে মাসে কিছু টাকা অন্তত দেওয়ার।

রাজ্যের ক্লান্তি নিয়ে বাসায় এসে কাপড় ছেড়েই ঢুকে গেলাম রান্নাঘরে। ভাবি সপ্তাহে এক দিন রান্না করেন। সারা সপ্তাহ ধরে সেটা ফ্রিজ থেকে বের করে খান। তাঁদের কোনো সমস্যা হয় না। সমস্যা হচ্ছে আমাদের। বিশেষ করে আরিফ আর আমার। একটা মাছ বা ডিম, সবজি কিছু একটা টাটকা রেঁধে খাই। সব মাছ এমনকি মাংসতেও গন্ধ লাগে। দুপুরে আগের রাতের খাওয়া ছিল বলে অর্ধেক খাওয়াই পড়ে আছে।

শরীর আর চলছিল না। ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছে। কতক্ষণে শুতে যাব, তাই ভাবছি। সাধারণত আরিফ আমার অনেক আগেই ঘুমিয়ে পড়ে। এই প্রথম আমি বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুমিয়ে গেছি। শোবার আগে দুটো পেইন কিলার খেয়েছি।

পরদিন খুব ভয় লাগছিল। একা একা যেতে পারব তো? বাসার কাছের স্টেশনটা বেশি দূরে না। আরিফ সঙ্গে গিয়েছিল। সে মনে হলো অবাক হয়ে আমাকে দেখছে, ‘তোমার এই রূপ আমি দেখিনি কখনো’। আমি জানি সে আমার ভিন্ন ধরনের পোশাকের কথা বলেনি।

আমি কিছু বললাম না। শুধু বাসে ওঠার আগে বললাম, ভাইয়া তোমাকে কতগুলো লিংক পাঠিয়েছে, ফরমগুলো পূরণ করো।

এই সপ্তাহটা তবু মেয়েরা বাসায় আছে। সামনের সপ্তাহ থেকে তো আরিফ বাসায় একা। ভাবতেই আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। কেউ নিজের ভালো না বুঝলে তাকে নিয়ে খুব সমস্যা।

বিকেলে কাজের শেষে যখন হেঁটে বাসস্ট্যান্ডে আসছি, আমার চোখ ফেটে জল আসছিল। আমি কাঁদিনি। কাঁদলে আমি হেরে যাব। এই যুদ্ধে আমাকে জয়ী হতেই হবে।

পরের সপ্তাহে মেয়েদের স্কুল শুরু হলো। এত ভালো নিয়ম। নামমাত্র টাকায় লাঞ্চ। বই দিচ্ছে সব লাইব্রেরি থেকে। স্কুল বাসে করে নিয়ে যায়, দিয়ে যায়। পড়ালেখার স্টাইল অনেক গোছানো। প্রাইভেট টিউটরের কাছে দৌড়াতে হচ্ছে না। পাগলের মতো পড়ালেখার চাপ নেই।

আমার মনে হলো, আমার দুই মেয়ের জীবনের অনেকটা ভার আমি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছি। নিজেকে দিনরাত সেটাই বোঝাই। মেয়েরাও বাবাকে বোঝায়। আরিফ যেসব জায়গায় দরখাস্ত করছে, খুব একটা আশাব্যঞ্জক কোনো সাড়া পাচ্ছে না। সে আরও হতাশ হয়ে পড়ছে। চাকরিদাতারা হয় এ দেশের ডিগ্রি চায় বা এ দেশের কাজের অভিজ্ঞতা। অন্য জায়গার কিছুতে তেমন আস্থা নেই এদের।

আমি আরিফকে বললাম, মাস্টার্স করে ফেলো।

: তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? এই চল্লিশ বছর বয়সে এসে মাথায় পড়া ঢুকবে? তা ছাড়া পড়তে তো টাকা লাগবে। নিজের সংসার নিয়ে অন্যের গলগ্রহ হয়ে আছি।

আমি চুপ করে যাই। সারা দিন একা বাসায় কিছু চাকরি খোঁজা আর টিভি দেখা ছাড়া আরিফ কিছুই করে না। মেয়েদের স্কুল এত ভালো, পড়ালেখায় খুব একটা সাহায্য তাদের লাগে না। তবু আরিফ মেয়েদের পড়াশোনায় লেগে থাকে। দিনের এই একটা সময়েই আমি ওর মাঝে আগের আরিফকে খুঁজে পাই। আর মেয়েদের মাঝে যেন আরও বেশি উৎসাহ ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞা।

প্রথম যেদিন বেতন পেলাম, আমার একদম বিশ্বাস হচ্ছিল না। আমার জীবনের প্রথম উপার্জন। তা–ও আবার বিদেশে। আমার নিজের দোকান থেকেই ভাইয়া–ভাবি, তাদের ও আমার বাচ্চাদের জন্য অনেক কিছু কিনে ফেললাম। আরিফের জন্যও শার্ট–প্যান্ট। এখানকার প্যান্টের কাটিং অনেক সুন্দর। মনে মনে চিন্তা করলাম, আরিফ যদি কোনো ইন্টারভিউতে ডাক পায়।

উপহার পেয়ে সবাই খুব খুশি। তবে কেন যেন মনে হলো আরিফ একটু চুপসে গেছে। আমার কি তবে বোঝার ভুল হলো? রাতে ঘুমাতে গিয়ে সেদিন ঘুম আসছিল না। বুঝতে পারছি আরিফ জেগে আছে। ওর গায়ে একটা হাত রাখলাম।

আরিফ আস্তে করে বলল, তোমার দোকানে স্টোর রুমে বা পেছনে এমন কোথাও কাজ আছে, যেখানে আমাকে কেউ দেখবে না?

আমি উঠে বসলাম। তারপর বললাম, সত্যি তুমি কাজ করবে?

আরিফ বলল, হ্যাঁ, একটা বাসা নেওয়া দরকার, শুনেছি কিছু সরকারি বাসাও আছে অল্প ভাড়ায়। আজ সকালে ভাইয়া আর ভাবির বেশ কথা-কাটাকাটি হয়েছে আমাদের নিয়ে। প্রায় চার মাস হতে চলছে।

তারপর আমি আরিফকে শক্ত করে জড়িয়ে শুয়ে ছিলাম। আমি জানি তারিন আর জেরিন যেদিন অনেক বড় হবে, এই দিনটির কথা আর মনে থাকবে না হয়তো।

পরদিন সকালে আমি জোর করে ভাবির হাতে চার শ ডলার গুঁজে দিয়ে বললাম, তোমাদের অনেক অসুবিধা করছি। সে তুলনায় এটা কিছুই না। দোয়া করো যেন শিগগিরই একটা যেমন–তেমন বাসায় হলেও উঠে যেতে পারি।

তারপরও ভাবির মুখের আঁধার কাটছে না কিছুতেই।

শুরু হলো আরিফের জন্য এবার জোরেশোরে কাজ খোঁজা। এর মধ্যে দিন ছোট হয়ে এসেছে। ঠান্ডাও পড়ছে খুব। কনকনে হাওয়া। বিষণ্ন আবহাওয়া। কাজ থেকে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায়। মনটা আরও খারাপ লাগে।

প্রথম যেদিন তুষার পড়ল, সেদিন কাজ থেকে বেরিয়ে আমি হতভম্ব হয়ে গেছি। এ এক অপার্থিব দৃশ্য। রাস্তার আলোয় পেঁজা তুলার মতো তুষার পড়ছে। আমি হাঁ করে দেখলাম। তারপর পা টিপে টিপে হাঁটছি। ঠান্ডাটা সহ্য হয় না একদম। নাক–মুখ সব ঢাকা।

ফেরার সময় চিন্তা করি আরিফ এখন কী করছে? বাড়ি ফিরে দেখি দুই মেয়ে জোর করে বাবাকে রাস্তায় নামিয়েছে তুষার দেখার জন্য। কেন যেন অনেক দিন পরে মনটা ভালো লাগল।

শেষ পর্যন্ত আরিফের কাজ জুটল একটা ফ্যাক্টরিতে। ইলেকট্রিক গুডস বানায়। তারা রাতের শিফটে লোক খুঁজছিল। রাতে কাজ করার মানুষ পায় না। আরিফ তো তাই চায়। তার ওপরে রাতে বেতন বেশি।

আমি কড়া করে কফি বানিয়ে দিতাম। আরিফ প্রথম দিন কাজে যাওয়ার সময় মেয়েদের মাথায় হাত দিয়ে ম্লান হেসেছিল। তার কি চোখের কোনা একটু চিকচিক করছিল? আমি বুকে পাথর বেঁধে থাকি। মেয়েদের একেকটা গ্রেড পাই, ওদের উৎফুল্ল মুখ দেখি। আমি ওদের চোখের স্বপ্নে নিজের চোখ রাঙিয়ে দিই।

দুজন মিলে একটু সময় পেলেই হিসাব করি। যা পাব তা দিয়ে একটা বাসা ভাড়া কড়া যায় কি না। এক বেডরুম হলেও হবে। মেয়েরা লিভিং রুমে ঘুমাবে দরকার হলে। কিন্তু বেশি দূরে যাওয়া যাবে না। আমাদের গাড়ি নেই, ড্রাইভিং লাইসেন্সও নেই। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট আর পা ভরসা।

না, হিসাব মেলাতে পারি না। একটাই ভরসা, সরকারি বাসা। আমাদের নিম্ন আয়, বাচ্চাদের বয়স সবকিছুর কারণে অবশেষে আরও কয়েক মাস পরে এল সেই প্রতীক্ষিত দিন। নিজেদের জন্য সরকারি একটি বাসার অনুমোদন। এক বেডরুম নয়, রীতিমতো দুটো বেডরুম। অবশ্যই আমাদের ঢাকার বাসার তুলনায় কিছুই নয়। আমেরিকা আসার সাত মাস পরে একটা সরকারি বাসায় উঠলাম আমরা।

ভাইয়ার গ্যারেজ থেকে দুটো ম্যাট্রেস এনেছিলাম। তাই মাটিতে ঘুমাতে হয়নি। সেই খালি বাসায় পা দিয়ে মনে হলো, অনেক দিন পরে প্রাণভরে নিশ্বাস নিলাম। ভাইয়া–ভাবির ঋণ কোনো দিন শেষ হবে না। তবে আর কিছুদিন গেলেই সম্পর্কটা তেতো হয়ে যেত।

তাদের বাচ্চারা একদম পড়ালেখায় মনোযোগী না। তারিন, জেরিনের সিরিয়াস ভাব দেখে ওরা বিরক্ত। ভাবিও প্রায়ই এই প্রসঙ্গ টেনে আনতেন। সে এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। তা ছাড়া বাড়তি রান্না, বাজার, বাসা অপরিষ্কার, তারা হিমশিম খাচ্ছিলেন। বাথরুম শেয়ার করা, নিজেদের প্রাইভেসি নেই এগুলোও তো অনেক বাড়তি মানসিক চাপ।

মনে হচ্ছিল নতুন সংসার শুরু করেছি। হাঁড়ি–পাতিল, খুন্তি থেকে সবই কিনতে হচ্ছিল। তবে সময় নিয়ে। আরিফ সারা রাত কাজ করে দিনে ঘুমায়। আর আমি দিনে ব্যস্ত। সব মিলিয়ে সপ্তাহে একটি দিন আমাদের দেখা হয়।

একদিন কাজ শেষে বাড়ি ফিরে দেখি বেডরুমের ওয়ালে একটা বড় আয়না লাগানো। মেয়েরা অনেক দিন ধরে চাচ্ছিল। নিশ্চয়ই আরিফ এনে দিয়েছে। এত দিন বাথরুমের আয়নাতেই সবাই কাজ সারতাম। মেয়েদের জন্য আমি আর সুযোগই পেতাম না।

সেদিন বড় আয়নায় নিজেকে খুঁটিয়ে দেখলাম। নিজেকে চিনতে পারছিলাম না। বেশ মুটিয়েছি। মাথার চুল পাতলা হয়ে গেছে। বেশ কিছু পাকা চুল দেখা যাচ্ছে। রং জ্বলে গেছে। আর মুখে বয়সের ছাপ। চোখের নিচে রাজ্যের ক্লান্তি। এ জন্যই কি আরিফ আর আজকাল একদম কাছে চায় না? নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল।

পরদিন কাজে থাকা অবস্থায় দুটি সুখবর পেলাম। জেরিন অঙ্কের দুটো ক্লাস স্কিপ করতে পারবে। আর আরিফ ড্রাইভিং লাইসেন্স পেয়েছে। আমাদের আমেরিকা জীবনের সংগ্রামে আরেকটি ধাপ পার হলাম আমরা। (চলবে)

ধারাবাহিক এ রচনার আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন