একটা অস্পষ্ট মুখের অপেক্ষা

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

নদীপারে গড়ে উঠেছে সার কারখানার এই কলোনি। শ খানেক পরিবারের যূথবদ্ধ বসবাস। পুরো কলোনিটা চার দেয়ালে ঘেরা। পশ্চিমে দেয়ালের দুই প্রান্তে দুটি প্রবেশ গেট। সারি সারি তেতলা বাড়িগুলো একটার সঙ্গে আরেকটা লাগানো। মুখোমুখি বাড়িগুলোর মাঝখান দিয়ে চলে গেছে রড-সিমেন্টের ঢালাই করা পথ। সেই পথের দুধারে থেকে থেকে আম–কাঁঠালের গাছ। প্রায়ই শীতল বাতাসের তোড়ে শন শন শব্দে ঝরে পড়ে দু–একটা করে হলদে পাতা।

সাদা রঙের পাশাপাশি দুটি বাড়ির মাঝখানে একটুখানি করে ফাঁকা জায়গা। শীতকালে বিভিন্ন বাসা থেকে নানা রকম সবজির চাষ করা হয় সেখানে। সবুজ লতাপাতায় একধরনের অদ্ভুত সৌন্দর্য ফুটে ওঠে তখন। বাড়ির সামনে ছোট মতো লেপ্টে থাকা ফাঁকা জায়গায় কেউ কেউ ফুলের গাছও লাগান। বাহারী জাতের ফুল। যখন ফুল ফোটে, তখন এক অদ্ভুত নৈসর্গিক সৌন্দর্য ছড়ায় চরাচরে।

বিকেলটা যখন পড়ন্ত হয়, তখন ছোট বাচ্চারা বাসা থেকে বের হয়। বিকেলের নরম রোদটা গায়ে মেখে ঢালাই করা পথের ওপরে ছুটাছুটি করে বেড়ায় বাচ্চারা। ওদের কিচিরমিচির শব্দে তখন এক অদ্ভুত মায়া আছড়ে পড়ে কলোনির কানায় কানায়। একটু বড়রা দক্ষিণের শেষ প্রান্তে কলোনির সঙ্গে লাগানো চিকন সবুজ মাঠটায় খেলে বেড়ায়। কখনো ফুটবল কখনো বা ক্রিকেট। সন্ধ্যাটা যখন চুইয়ে চুইয়ে আসে, তখন ওরা দল বেঁধে বাসায় ফিরে। পথের ধারে সোডিয়াম লাইটগুলো মিটিমিটি জ্বলে ওঠে। সাঁজবেলার পাতলা আঁধারটা মিলিয়ে যায় গাঢ় অন্ধকারে। জোনাক পোকারা ধীরে ধীরে ভীর করে সেই গাঢ় অন্ধকারের গায়ে গায়ে।

শফির বাবা বদলি হয়ে এই কলোনিতে এসেছেন মাসখানেকের বেশি নয়। উঠেছেন ১ নম্বর লেনের ২ নম্বর বাড়িতে। দ্বিতীয় তলার দক্ষিণমুখী ওদের ঘর। শফি ঠিক জানে না ওর বাবা অফিসে কোন পদে চাকরি করেন। তবে বিকেলে ও যখন হাঁটতে বা খেলতে বের হয়, তখন ওর প্রতি অন্যদের আদুরে সমীহ ভঙ্গি দেখে কেমন করে যেন ও ঠিক বুঝতে পারে ওর বাবা একটু ওপরের পদেই কাজ করেন। সেটা তাকে একধরনের রাশভারী আনন্দ দেয় বটে।

এর মধ্যে শফি বেশ কয়েকজন ক্রিকেট খেলার বন্ধু পেয়ে গেছে। সেদিন পড়ন্ত হলদে বিকেলে চিকন সবুজ মাঠটায় ক্রিকেট খেলছিল ওরা। মাঠের চারদিকে মাঝারি সাইজের মেহগনিগাছের সারি সারি অবস্থান। সবুজ মাঠের তিন দিকে মেহগনিগাছের গা ঘেঁষে কলোনির সীমানাপ্রাচীর। অন্য পাশটা ওঠে গেছে কলোনির ঢালাই পথের ওপর। পথের সঙ্গে খানিকটা লাগানো কলোনির শেষ লেনের বাড়িগুলো একটার সঙ্গে একটা যেন যূথবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

শফি তখন পথের সঙ্গে লেগে দাঁড়িয়ে ফিল্ডিং করছিল। হঠাৎ করেই একটা বল ওভার বাউন্ডারি হয়ে গেল। দৌড়ে সাদা রঙের তেতলা বাড়িটার সামনে গেল ও। বলটা পড়ে আছে বাউন্ডারি দেওয়া দেয়ালের ভেতরে। তেতলা বাড়িটার সঙ্গে লাগানো একটুখানি ফাঁকা জায়গা লেপ্টে আছে। সেখানে ব্যাডমিন্টন খেলছে তারই সমবয়সী এক অপ্সরী। বয়সের সীমারেখাই যেন বলে দেয় সঙ্গে খেলছেন তার মা। ভারী আড়ষ্ট হয়ে গেল শফি। গলাটা কেমন যেন শুকিয়ে শুকনো কাঠ হয়ে গেল শফির। ঢুক গিলার চেষ্টা করে ও। কিন্তু গলা দিয়ে যেন কোনো কিছুই নামছে না। এমন সময় ওদের নজরে পড়ে শফি। নজর পড়তেই বয়স্ক মতো মানুষটা বলে ওঠলেন, অর্পি মা বলটা ওকে তুলে দাও তো। ধীর পায়ে কাঁঠালতলা থেকে বলটা হাতে নিল অপর্ণা। তারপর দুই পা এগিয়ে এসে বলটা ছুড়ে মারল শফির হাতে। বলটা হাতে নিয়ে হাঁ করে তাঁকিয়ে আছে শফি। কী করবে কিছুই যেন বুঝে উঠতে পারছে না ও। একটা নৈঃশব্দ্যে কেটে গেল কিছু মুহূর্ত। সেই নৈঃশব্দ্য যেন অনেক কথাই বলে গেল দুজনের অগোচরে। মৃদু বাতাসে শন শন শব্দ ওঠে কাঁঠালগাছের ডালে ডালে। কিছুটা ঝিমঝিম করে ভারী হয়ে ওঠে শফির দেহ-মন। এমন সময় দ্বীপের ডাকে হঠাৎই যেন সম্ভিত ফিরে পেল শফি। তারপর একটা ভৌঁ দৌড়ে মাঠে ফিরে গেল ও।

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

সারাটা নরম বিকেল কেটে গেল বড় আনমনে। কোনো কিছুতেই যেন শফি মন বসাতে পারছে না। তার চোখে লেপ্টে আছে একটা বড্ড আদুরে মুখ, এক জোড়া আয়ত কাজল কালো চোখ, একটা লাল পাতলা ফ্রেমের চশমা। নয়ন জোড়া বুজলেই নীলের মাঝে কালো দাগ টানা প্রগে যেন একটা নীল অপ্সরী ভেসে ওঠে। কি অপূর্ব শান্ত, কি স্নিগ্ধ চাহনী তার। বড় চনমনে হয়ে ওঠে ভেতরটা। শফির মনে নানা প্রশ্ন। মেয়েটা কি তার চেয়েও ওপরের কোনো ক্লাসে পড়ে? না বোধ হয়। দেখে তো সে রকম মনে হয়নি। ওর ক্লাসে অথবা নিচের ক্লাসেই হবে হয়তো। এ রকমটাই ভাবতে চায় ও। হঠাৎ করেই যেন শফির মনে পড়ল—হায় হায়, এমন মায়ায় আর্দ্র পরীটাকে তো ধন্যবাদই দেওয়া হলো না। মেয়েটি নিশ্চয়ই ওকে খুব অকৃজ্ঞ মনে করেছে। না, নিশ্চয়ই কাজটি ভালো হয়নি। খানিক বাদে এও ভাবে সে ধন্যবাদ দিলে যদি অন্য কিছু ভাব তো অর্পি। না, তবু দিলে হয়তো ভালই হতো। এমন ভাবনায় শফির ভেতরটা যেন বড় আড়ষ্ট। যেন একটা জুবুথুবু ভাব ওকে দাঁত কামড়ে গিলে খাচ্ছে।

একটা স্বপ্নীল মুগ্ধতায় কয়েটা দিন কেটে গেল। ভোরের চিকচিকে সোনালি আভা তপ্ত হয়, ভর দুপুরের খর রোদ্দুর আছড়ে পড়ে বৃক্ষ-লতায়, সাদা রঙের তেতলা বাড়ির ছাদে। শেষ বিকেলটা নরম রোদে ঢলে পড়ে পশ্চিমে। গোধূলি লগ্নে কনে দেখা আলোয় দারুণ মুগ্ধতায় কেটে যায় শফির গেল কয়েকটা দিন। প্রতি বিকেলে খেলার মাঠে যাওয়ার ছলে অর্পিদের বাসার সামনে দিয়ে দু–একবার করে হেঁটে চলে শফি। কিন্তু সেদিনের পর থেকে ওকে আর দেখতে পায়নি ও। শুধু আজ সকালে শফি যখন কলোনির বাইরে লাগানো মুদি দোকানটায় গেল মায়ের জন্য বেসন আনতে তখন আচমকাই চোখ জোড়া যেন আটকে গেল ওর। রিকশা করে অর্পি ওর মায়ের সঙ্গে বের হয়ে গেল। শুধু এক ঝলকের জন্য ওদের দেখল শফি। সকাল গড়িয়ে দুপুর। হঠাৎ শফির মনে হলো, ও তো গেটের পাশে অপেক্ষা করতে পারে। হয়তো একটা সময় ওরা ফিরে আসবে তখন হয়তো একটু খানি দেখা হবে আবার। সেদিন সারাটা বিকেল ও বসে ছিল গেটের অদূরে জামতলায়। চাতক পাখির চোখে ও তাকিয়ে ছিল গেটের ওপর। না, কতজন এল গেল, কিন্তু অর্পিরা আর ফিরল না সেদিন।

অর্পির সঙ্গে দেখা করা, ওর সঙ্গে একটু সময় কাটানোর জন্য ফন্দি আঁটে শফি। ছোটদের নিয়ে একটা খেলার প্রতিযোগিতার আয়োজন করে ও। সবার কাছ থেকে ১০ টাকা করে চাঁদা ওঠানো হলো। খেলায় থাকবে দৌড়, লম্বা লাফ, আর উচ্চ লাফ। পুরস্কার দেওয়া হবে প্রথম তিনজনকে। এক বিকেলে খেলার আয়োজন হলো। স্নিগ্ধা যে কিনা ক্লাস টুয়ে পড়ে, ওকে দিয়ে অর্পিকে জানানো হলো। শুধু তা–ই নয়, স্নিগ্ধাকে দিয়ে অর্পির কাছ থেকে ১০ টাকা চাঁদাও নিয়ে এসেছে শফি। মোটামুটি নিশ্চিত যে অর্পি খেলায় আসছে। চাঁদার টাকাটা পেয়ে আরও একটু স্বস্তি পায় শফি।

সেদিনের বিকেলটা ঢলে পড়ল পশ্চিমের কোলে। ততক্ষণে এক–দুজন করে সবাই খেলতে চলে এসেছে শুধু অর্পি আসেনি তখনো। শফি একে ওকে জিজ্ঞেস করছে আর কেউ কি বাকি আছে আসার। এর নাম ওর নাম বললেও কেউ অর্পির নাম বলল না। আরও কিছুটা সময় শফি খেলাটা ধরে রাখে। না, অর্পির আসার নামগন্ধও নেই। হঠাৎ সাদা ফ্রকে একজনকে আসতে দেখল ও। মুহূর্তেই ভেতরটা যেন মোচড় দিয়ে উঠল। কিন্তু খানিকটা কাছাকাছি আসতেই সমস্ত আবেগ যেন বাষ্প হয়ে উড়ে গেল। না, ওটা অর্পি নয়। বড় আফসোস হচ্ছে শফির। তিনটার মধ্যে দুটিতেই প্রথম হয়েছে ও। কিন্তু যাকে দেখানোর জন্য এত কিছু, সেই কিনা থাকল অধরায়।

এক সন্ধ্যা রাতে শফির মা ওকে নিয়ে বের হয়েছে তমা আন্টির বাসায় যাবে বলে। ওদের বাসা থেকে বের হয়ে সামান্য বাঁয়ে মোড় নিয়ে সোজা গেলেই শেষ লেনে তমা আন্টির বাসা। কিন্তু শফি বায়না করল, মা এদিক দিয়ে গেলে ওই জামতলার অন্ধকারে আমার খুব ভয় করে। অগত্যাই যেন ডান পাশ দিয়ে যেতে হলো ওদের। ডানে খানিকটা গিয়ে বাঁয়ে মোড় নিল। পথে সোডিয়াম লাইটের মিটি মিটি আলো জ্বলছে। থেকে থেকে গাছের গোড়ায় গোড়ায় গাঢ় অন্ধকার জমে আছে। মায়ের হাত ধরে হেঁটে চলে ও। শেষ মাথা থেকে আবার বাঁয়ে মোড় নিল ওরা। আর একটু হাঁটলেই তমা আন্টিদের তিন নম্বর বাসা। কিন্তু তার আগে ২ নম্বর বাসাটায় থাকে অর্পিরা। অর্পিদের বাসার সামনে যেতেই একটা মৃদু শীতল হাওয়া যেন বয়ে গেল। গাটা ছমছম করে ওঠে ওর। হঠাৎ করেই অর্পিদের বারান্দায় ভেতর থেকে আলো আছড়ে পড়ে। কাঁঠালপাতার ফাঁকফোকরে আবছা আলোয় অর্পির মুখটা যেন আচমকাই জ্বলে উঠল। বারান্দার তারে ঝোলানো তোয়ালেটা টেনে নিয়ে মুহূর্তেই যেন ভেতরে চলে গেল অর্পি। নিঃশব্দের বেঘোরে বড় শক্ত হয়ে আসে শফির দেহ-মন। আলো–আঁধারীর ধোঁয়াটে ভাবটা যেন মুহূর্তেই কেটে গেল। বেঘোরটা কেটে গেলে শফি টের পেল শীতল হাওয়ার তোরটা যেন একটুখানি বেড়ে গেল।

এমনি করে দেখতে দেখতে কয়েকটা মাস কেটে গেল। তখন ডিসেম্বর। ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। স্কুল গেটে অর্পির সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে ওর মা। ওদের দেখে শফি কেমন যেন একটু জুবুথুবু হয়ে গেল। শফির সঙ্গেও ওর মা আছে। নিঃশব্দে কাটে কিছু সময়। খনিকটা সময় পর অনেকটা নিজ থেকেই যেন অর্পির মা ভারী আন্তরিকতায় পরিচিত হলো শফির মায়ের সঙ্গে। অর্পির মায়ের কথা থেকেই শফি বুঝতে পারে অর্পি ওর ক্লাসেই পড়ে। এমনটা শুনে মনটা যেন এক অচেনা আনন্দে ভরে গেল শফির। মেয়েদের সেকশন আলাদা হওয়ায় হয়তো এত দিন অর্পির সঙ্গে দেখা হয়নি শফির।

আজ রোববার। শফিদের শেষ পরীক্ষা। চারুকলা দিয়ে শেষ হচ্ছে। আচমকাই ছেলেমেয়েদের একসঙ্গে পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন শিক্ষকেরা। হুড়মুড়ে গাদাগাদি করে বড় হল রুমটায় ঢুকল ওরা সবাই। পিছনে ঘাড় ঘুরাতেই চোখে চোখ পড়ল দুজনের। এক অদ্ভুত অজানা কারণে আবারো আড়ষ্ট হয়ে গেল শফি। অর্পি নিজ থেকেই বলল কেমন আছো? ভালো। এর বেশি কিছু বলতে পারল না শফি। শুরু হয়ে গেল পরীক্ষা। একটু পরে অর্পি পেছন থেকে পেনসিল দিয়ে গুঁতো দিল শফিকে। শফি পেছন ফিরতেই অর্পি ফিসফিসিয়ে বলল, কাঁঠালের সঙ্গে কয়টা পাতা আঁকব। এক অচেনা উত্তেজনা নিয়ে শফি বলল, চারটে। তারপর আবার পেনসিল দিয়ে গুঁতো দেয় অর্পি। এবার একটু দুষ্টু ফন্দি আঁটে শফি। ও ফিসফিসিয়ে বলে, ব্যথা লাগে তো। দুঃখিত ভাবে ঠোঁট কামড়ে ধরে অর্পি। তখন এক অদ্ভুত মায়ার বাষ্পে আর্দ্র হয়ে ওঠে শফি। এবার ডান হাতের নরম আঙুল দিয়ে খোঁচা দেয় অর্পি। শফি ফিসফিসিয়ে বলে, কি? অর্পি বড় চাপা কণ্ঠে বলে, আমের সঙ্গে কয়টা পাতা দেব? এমনি করে উষ্ণ সময়টা যেন বড় দ্রুতই কেটে গেল। শফির একটু আগেই অর্পি বের হয় হল থেকে। খানিক বাদে শফি বের হয়ে হন্যে হয়ে খোঁজে অর্পিকে। কিন্তু সেদিন অর্পির আর দেখা পেল না শফি।

বাসায় ফিরে স্কুল শার্টটা সযত্নে খোলে শফি। ঠিক পেছনে যে জায়গায় অর্পির আলতো ছোঁয়া লেগেছিল, সেখানটায় হাত বোলায় ও। শার্টটা একটু লুকিয়ে রাখে শফি। খানিক বাদে ও দেখল, ওর মা শার্টটা ধুইয়ে বারান্দায় টানানো তারে ঝুলিয়েছে। বড় কষ্টে দাঁত কাটে ও। শফি ভেবেছিল, ওটা না ধুইয়ে রেখে দেবে। যখনই অর্পিকে মনে পড়বে, তখন আলতো করে অর্পির নরম স্পর্শের অনুভূতি নেবে ও। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না বলেই যেন শফির মন বড় বিষণ্ন আজ।

ওই দিন পরীক্ষা শেষে শফিদের নিয়ে ওর বাবা চলে গেল গ্রামের বাড়িতে। সপ্তাহখানেক পরে ওরা ফেরে। শফি ভাবে, আজ বিকেলেই অর্পিদের বাসায় যাবে ও। সারাটা দিন কাটে বড় উত্তেজনায়। বিকেলটা ঢলে পড়ে। চিকচিকে নরম শীতের রোদটা মাড়িয়ে শফি ওদের সাদা রঙের বাড়িটার সামনে গেল। দারোয়ান বলল, বাবু কোথায় যাবে? অর্পিদের বাসায়, জবাব দিল শফি। দারোয়ান বলে, ও আচ্ছা, আতাউর স্যারের বাসায়। বাবু, ওনারা তো বদলি হয়ে চলে গেছেন দুদিন আগে, শফিকে জানায় দাঁরোয়ান। বড় হতাশ কণ্ঠে শফি বলল, অর্পিরা কি আর আসবে না? দারোয়ান চাচা বলল, ওনারা তো আর এখানে আসবে না, বাবু।

শফির মনটা বড় বেদনায় ভরে গেল। ভেতরটা কেঁপে উঠল। মনে হলো পুরো আকাশটা যেন ভেঙে পড়ল ওর মাথায়। এই কয়টা দিন কত স্বপ্ন, কত আশা নিয়ে সে পার করেছে, তা কেবল সে–ই বোঝে। আজও অর্পিতা নামে ফেসবুকে সার্চ দেয় শফি। কিন্তু হাজারো অর্পিতার মধ্যে ওর ডাগর ডাগর চোখের অর্পিকে আর খুঁজে পায় না ও। মৃদু বাতাসে আজও কাঁঠালগাছের ডালে ডালে শন শন শব্দ ওঠে আজও অচেনা মুগ্ধতায় বড় আড়ষ্ট হয়ে আসে শফির দেহ-মন। আজও সেই ২৩ বছর আগে কোনো এক নরম বিকেলে হারিয়ে যাওয়া কোনো এক অস্পষ্ট মুখের অপেক্ষায় থাকে ও।

আজ এত কাল পরে শফি তার বউ জুঁইকে সেই অবুঝ বয়সে হারিয়ে যাওয়া গল্প শোনাচ্ছিল। ছুটির দিনের রাত বলেই হয়তো তাঁদের ঘুম আসছিল না আজ। ফলে এই রসিক যুগল মনে হঠাৎ বুদ্ধি এল ট্রুথ অর ডেয়ার খেলার। আচমকাই শফির ভাগ্যে পড়ল ট্রুথ আর সেই সুযোগে জুঁই বেগম জানতে চাইল ছোট্ট বেলার কোনো এক রোমান্টিক স্মৃতি, যা তাঁকে এখনো কাতর করে। এ সূত্রেই সেই হারিয়ে ভূত হয়ে যাওয়া মধুর স্মৃতিচারণা।

গল্প শেষে কিছুটা সময় নৈঃশব্দ্যে কেটে গেল। দৃষ্টিটা যেন বড় ক্ষীণ হয়ে আসে দুজনের। ধীর পায়ে খাট থেকে নামল জুঁই। নিজের ছোট্ট একটা গোপন ব্যাগ থেকে একটা ফটোগ্রাফ বুকে আগলে ফিরে আসে। টলমল চোখে সেই ফটোগ্রাফটি শফির সামনে তুলে ধরে জুঁই। ‘দেখ তো এই সেই তোমার নীল পরি কি না?’ সেই ফটোর সেটে অপলক দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে থাকে শফি। বড্ড মায়াবী মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে নীল ফ্রকের সেই স্বর্গীয় অপ্সরী। সেই লাল পাতলা ফ্রেমের চশমার, সেই কাজল কালো আয়ত চোখ, কি বড্ড আদুরে মুখ। এক অদ্ভুত অনুভূতিতে বড় ঝাপসা হয়ে আসে দুজনের দৃষ্টি।

নিঃশব্দের গাঁথুনি ভেঙে শফি জিজ্ঞেস করে, ‘তাহলে, অর্পিতা...?’
‘হুম, আমার নাম তো সাবরিনা আক্তার জুঁই’ই, শুধু মা–ই ডাকত অর্পি বলে। তারপর সেই ছোট্ট কালেই মা চলে গেল ওপারে। বাবা করলেন দ্বিতীয় বিয়ে। বাবার বিয়ের পর ছোট মামা তাঁর কাছে নিয়ে গেলেন আমাকে। তারপর জীবনের কত ঘাত কত প্রতিঘাত। কত চড়াই কত উতরাই। একটা সময় জীবনস্রোতে ভাসতে ভাসতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষে কোনো এক ক্লান্ত পড়ন্ত বিকেলেই তো তোমার সঙ্গে আমার দেখা। তারপর...’

বলতে বলতে ঢুকরে কেঁদে উঠল অর্পি। টলমল চোখ আর নরম বাঁকা ঠোঁটে যেন শফি ফিরে পেল হারিয়ে যাওয়া তার সেই অপ্সরীকে। শফি যেন বেঘুরে স্বপ্ন দেখছে। ছিমটি কাটে নিজের হাতে। একি সত্যি নাকি স্বপ্নপুরীর নিছক এক দিবা স্বপ্ন। শফি এতটা কাল হয়তো পুরো আকাশটা চায়নি, চেয়েছিল শুধু দূর আকাশের নীলিমাটুকু। অথচ আজ যেন সে সেই দূর আকাশটাই হাতে পেয়ে গেল। এটাই হয়তো নিয়তির এক অদ্ভুত গাঁথুনি। বেদনার গায়ে গায়ে এমনি করে হয়তো লুকিয়ে থাকে কত জীবন, জীবনের কত মাধুরী, সুখের কত সুনীল রাত। শফি এতকাল শুনে এসেছে, বড় প্রেম শুধু দূরেই ঠেলে। অথচ আজ সে দেখল, বড় প্রেম যে শুধু দূরেই ঠেলে তা নয়, কখনো কখনো কাছেও টানে। সে ভাবে জীবন থেকে যেমন করে গল্প হয়, ঠিক তেমনি করে কখনো কখনো গল্প থেকেও বুঝি জীবন হয়। স্রষ্টার এ এক অদ্ভুত লীলাখেলা।

*ডক্টরাল ফেলো, অবার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, আলাবামা, আমেরিকা (সহকারী অধ্যাপক, শাবিপ্রবি)।