করোনাভাইরাসের মধ্যে লন্ডভন্ড জীবন

লেখকের ভাইয়ের করোনায় আক্রান্ত পরিবার। পরে তাঁরা সবাই সুস্থ হয়েছেন। ছবি: সংগৃহীত
লেখকের ভাইয়ের করোনায় আক্রান্ত পরিবার। পরে তাঁরা সবাই সুস্থ হয়েছেন। ছবি: সংগৃহীত

করোনার দিনগুলো কেমন যাচ্ছে আমাদের? ঘরে বসে থাকার বিলাসিতা, খিচুড়ি খাওয়া, মুভি দেখা, নাটক-ম্যাগাজিন দেখা, পরিবারের সঙ্গে মিলেমিশে সময় কাটানো একেবারে মন্দ নয় কিন্তু। তা ছাড়া, আপনার যদি রান্নার হাত ভালো থাকে, তাহলে হরেক রকমের রান্না করে সেসবের টেস্ট পরোখ করে নেওয়া, যেমন হালিম, রসমালাই, মোগলাই পরোটা, সজিনার সঙ্গে দেশি জিয়েল মাছের ঝোল, লাউ চিংড়ি, হরেক বাঙালি ভর্তা-ভাজি, বারবিকিউ ইত্যাদি আইটেম গলাধঃকরণ করতে কার না মন চায়! করোনার দুঃসময়ের মধ্যেও মনকে চাঙা রাখতে ঘরে বসে পরিবারের সঙ্গে কিছু মূল্যবান সময় কাটানোর কোনো তুলনা হয় না।

কিন্তু এসব করতে হলে মনকে চাঙা রাখতে হলেও পকেটে কিছু পয়সার দরকার হয়। পকেটে পয়সা না থাকলে কোনো কিছুতেই মন তখন ভরে না। সেই পয়সা আসে কর্ম থেকে। কর্মক্ষেত্রের দরজা–জানালা যখন বন্ধ থাকে, টেবিল–চেয়ারগুলোতে যখন ময়লা ও ধুলাবালির স্তর জমে থাকে, তখন তো বুঝতে হবে কিছু না কিছু একটা সমস্যা হয়ে গেছে। জীবিকার সমস্যা।

করোনার কারণে আমেরিকাতে মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষ বেকার। সরকারের আন-ইমপ্লয়মেন্ট (বেকার) বেনিফিটের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে তাঁরা। করোনাভাইরাস ইতিমধ্যে প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে আমেরিকার ভূমি থেকে, আক্রান্ত করেছে প্রায় ২৮ লাখ মানুষকে, তবু করোনার দাপটকে এখনো এখানে থামানো যায়নি।

বলতে গেলে মার্চ ও এপ্রিল, দুই মাসই আমরা এখানে ঘরের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে ছিলাম। মে মাসেও প্রায় ঘরবন্দী। একটু একটু করে জুন থেকে অফিস ও ছোট ছোট ব্যবসা এখানে খুলে দিল। মানুষ তাতেই হুমড়ি খেয়ে পড়তে গেল ফ্লোরিডা ও ক্যালিফোর্নিয়ার বিচগুলোতে। মনের মধ্যে যে চাপ সৃষ্টি হয়েছিল, এত দিন ঘরের মধ্যে আটকে থাকতে থাকতে, তা যেন সাগরের বিচে গিয়ে এক নিমেষে উথাল–পাতাল ঢেউয়ের মধ্যে ঝেড়ে ফেলা। কিন্তু করোনা তাতে সেই আনন্দে সায় দিল না। আবারও বাদ সাধল, জেঁকে বসল। মাঝখানে আক্রান্তের সংখ্যা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও তা আবারও একটু একটু করে বাড়তে শুরু করল।

মেঘ যেমন বিষণ্ণতার ছায়া মেলে কালো হয়ে জমে থাকে আকাশে, আবার একটু পরে তা বৃষ্টি হয়ে কেটে যায়। করোনা আমাদের মধ্যে পৃথিবীতে এসেছে ঠিকই, কিন্তু তা মেঘের মতো কেটে যাচ্ছে না শিগিগরই। থেকেই যাচ্ছে আমাদের অগোচরে আশপাশে এখানে–সেখানে। আমরা না পারছি খোলা আকাশের নিচে মন খুলে হাত ধরে হাঁটতে, আবার না পারছি পরিবারের কাছের মানুষের বাসায় গিয়ে নক করতে বা কুশল বিনিময় করতে, না পারছি সামাজিক দাওয়াত দিতে বা নিতে। না পারছি বিশ্বের সেরা স্পটগুলো ভ্রমণ করতে। ঘাতক করোনাভাইরাস মানুষের মনের রসকে শুষ্ক করে তুলেছে।

তাই বলা যেতে পারে যে করোনার অবসাদ দিনগুলোতে জীবন চলার পথ যেন আঁকাবাঁকা ও এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। বছরের যে প্ল্যানগুলো আগে থেকেই সাজানো ছিল পঞ্জিকাতে, সেগুলো আপাতত মনের পঞ্জিকাতেই চাপা দিয়ে রাখতে হচ্ছে। যেমন ধুমধাম করে যার বিয়ের অনুষ্ঠান করার ইচ্ছা ছিল, সেই ধুমধাম শব্দটিকে আপাতত মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হচ্ছে করোনা পরিস্থিতিতে। যার স্কুল বা ইউনিভার্সিটি/কলেজ গ্র্যাজুয়েশন সেলিব্রেশনের উৎসব ছিল, কিংবা যার সামার ভ্যাকেসনে হনুলুলু কিংবা ডিজনিওয়ার্ল্ড যাওয়ার প্ল্যান ছিল, কিংবা জন্মদিনের মতো একটি বিশেষ দিনে বন্ধুবান্ধব নিয়ে হইহুল্লোড় করে বিশেষ উৎসব আয়োজনের ইচ্ছা ছিল, আপাতত সব শিকেই তুলে ফেলতে হচ্ছে। ঘাতক করোনাভাইরাসের প্রকোপ দৈনন্দিন জীবনের বিশেষ মুহূর্তের আনন্দঘন দিনগুলোর মধ্যে নির্ঘাত একটা অদৃশ্য দেয়াল তৈরি করে দিয়েছে।

আমরা করোনার আগের পৃথিবীতে ফিরে যেতে চাইছি, অথচ আর সেভাবে ফিরে যেতে পারছি না, ফিরে যেতে পারব কি না, তা–ও জানি না। মুখে মাস্ক পরে সোশ্যাল ডিসটেনসিং মেইনটেইন করে জীবন চালাতে আগে কখনোই আমরা অভ্যস্ত ছিলাম না। আমরা অনভ্যস্ত ছিলাম ঘরের মধ্যে ঘরবন্দী জীবন কাটাতেও। অথচ সেই অনভ্যস্ত অংশগুলোই আজ আমাদের চলার পথের অনিবার্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

করোনার সময়ে নিজের পরিবারের দু–একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করছি উদাহরণ হিসেবে। রিনভী, আমার মেয়ে। কলেজ গ্র্যাজুয়েট হলো এবার। মে মাসে। আমেরিকাতে কলেজ মানে ইউনিভার্সিটি। ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটস (এমহাস্ট ক্যাম্পাস) থেকে, বায়োকেমিস্ট্রিতে। মনটা তার খারাপ। কারণ, ঘরে বসে আছে টানা দুই মাস। তার মনে কত আশা ছিল। কনভোকেশন বা গ্র্যাজুয়েশন সিরিমনি হবে। সেখানে বিশেষ গাউনে শরীর মুড়িয়ে মাথায় বিশেষ হ্যাট পরে হাজার হাজার স্টুডেন্ট ও অভিভাবকের উপস্থিতিতে জনাকীর্ণ আনন্দঘন পরিবেশে ইউনিভার্সিটির উপাচার্যের হাত থেকে তার ইউনিভার্সিটি জীবনের প্রথম সার্টিফিকেটটি সে নেবে। করোনা–পূর্ববর্তী সময়ে সেটাই হওয়ার কথা ছিল। অথচ তা আর হলো না। করোনাভাইরাস প্যান্ডেমিক তা হতে দিল না। ইউনিভার্সিটির সেই কনভোকেশন আয়োজনটি আর অন-ক্যাম্পাসে হলো না। হল ভার্চ্যুয়াল আয়োজন। জুমের মাধ্যমে কম্পিউটারে ভিডিও কল। ভার্চ্যুয়ালে এসব আয়োজনে সদ্য গ্র্যাজুয়েট হওয়া তরুণ বয়সের ছেলেমেয়েদের মন কি ভরে? ভরলও না। শুধু রিনভী একা নয়, তার মতো সদ্য গ্র্যাজুয়েট হওয়া হাজারো ছেলেমেয়ে মনে বিষাদ চিহ্ন নিয়ে তাঁদের স্ব স্ব বাসায় ফিরে এল। তাঁদের জীবনের অসাধারণ অর্জনের সার্টিফিকেটটি হাতে পেল তাঁরা খুব সাধারণভাবে। মেইলের মাধ্যমে। পোস্টাল মেইল।

আমেরিকাতে ছেলেমেয়েরা যখন স্কুল (দ্বাদশ ক্লাস) এবং ইউনিভার্সিটির গ্র্যাজুয়েট হয়, তখন তাঁদের সার্টিফিকেট বিতরণ অনুষ্ঠানটি হয় দেখার মতো, মুগ্ধ হওয়ার মতো। টেকনোলজির যুগে প্রত্যেক স্টুডেন্টের ছবিসহ প্রোফাইল আগে থেকেই কম্পিউটারে সেট করা থাকে। গ্র্যাজুয়েশনের দিনে যখন তাঁরা স্কুলের প্রিন্সিপাল কিংবা ইউনিভার্সিটির উপাচার্যের হাত থেকে সার্টিফিকেটটি গ্রহণ করে, বিশাল স্ক্রিনে তখন তাঁদের ছবি ভেসে ওঠে। সেই সঙ্গে স্টুডেন্টদের বিশেষ অর্জনের কৃতিত্ব লাউড স্পিকারে বিশেষ ভঙ্গিতে তা প্রোনাউন্স হতে থাকে। তখন উপস্থিত আত্মীয়স্বজন, বন্ধু–বান্ধব, রিলেটিভের মুহুর্মুহু করতালিতে মুহূর্তটি সত্যিই আনন্দে মুখরিত হয়ে ওঠে। কোমলমতি ছেলেমেয়েদের মন সেই আনন্দে উদ্বেলিত হয়।

রিনভীর এই কনভোকেশন উপলক্ষে তার ইচ্ছা ছিল যে বাংলাদেশ থেকে তার দাদা ও দাদি আসবেন। তাঁরা এই অনুষ্ঠানে আমাদের সঙ্গে গ্যালারিতে বসে কনভোকেশন অনুষ্ঠানটি উপভোগ করবেন। সে জন্য আমেরিকার ভিসার জন্য যেসব কাগজপত্রের দরকার হয়, সবকিছু আগে থেকেই রেডি করে রেখেছিল নিউইয়র্কে বসবাসরত রিনভীর ছোট চাচা মানে আমার ছোট ভাই বিদ্যুৎ। দেশে পুলিশ ভেরিফিকেশনের কাজগুলো সমাপ্ত হয়ে ঢাকার ইউএস এম্বাসিতে যখন ভিসার জন্য যাওয়ার সময় এল, তখন করোনাভাইরাসও পৃথিবীতে আবির্ভূত হলো। আমার মা–বাবা ইউএস এম্বাসিতে ভিসার জন্য লাইনে দাঁড়ানোর জন্য আর সুযোগই পেলেন না।

সদ্য গ্র্যাজুয়েট করা মেয়ে রিনভীর সঙ্গে লেখক। ছবি: সংগৃহীত
সদ্য গ্র্যাজুয়েট করা মেয়ে রিনভীর সঙ্গে লেখক। ছবি: সংগৃহীত

রিনভীর মনে আরও কত আশা ছিল। তার বন্ধু–বান্ধবকে সে দাওয়াত করবে, তার কাছের ও দূরের আঙ্কেল–অ্যান্টিরা সেই দাওয়াতে আসবেন, তাকে সেলিব্রেট করবে, কংগ্রাচুলেশনে তার মনটা উষ্ণতায় ভরে উঠবে। অথচ তা আর হলো না। হবেও না। কারণ, সময়। সময় যে চলে স্রোতের বেগে। সময়কে কেউ আটকাতে পারে না। এই একটিমাত্র প্যারামিটার পৃথিবীতে আছে, যার নাম সময়, তাকে কোনোভাবেই ধরে বেঁধে আটকানো যায় না। আপনি নিজেই সময়ের কাছে আটকে যাবেন, সময় আপনার কাছে আটকাবে না। সময়ের এ এক অসীম শক্তি, যা কেবল প্রবহমান।

শুধু আমেরিকাতে নয়, ইউরোপসহ সারা পৃথিবীর স্কুল, কলেজ বা ইউনিভার্সিটির ছেলেমেয়েদের মনে একটা কষ্টের আঘাত হেনে দিয়েছে করোনাভাইরাস। কনভোকেশন বা গ্র্যাজুয়েশন উপলক্ষে যে স্বপ্নের আনন্দগুলো কল্পনার সাগরে তাঁরা এত দিন ধরে বুনেছিল মনে মনে, তাতে করোনাভাইরাস হঠাৎ করে বায়বীয় আকারে উড়ে এসে একটি কঠিন বাধা সৃষ্টি করে দিল।

করোনাভাইরাস যখন প্যান্ডেমিকের তুঙ্গে, তখন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সদ্য গ্র্যাজুয়েট হওয়া স্কুল কলেজ বা ইউনিভার্সিটির ছেলেমেয়েদের মনের অবস্থা বিবেচনা করে মাত্র ১৫ মিনিটের একটি উপদেশমূলক লেকচার দিয়েছিলেন মে মাসে, যা ছিল অসাধারণ। আমেরিকার ঘরে ঘরে ছেলেমেয়েরা ওবামার সেই লেকচার শোনার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে টেলিভিশনের সামনে সেদিন বসে ছিল। পিনপতন নীরবতা নিয়ে। আমার ছেলেমেয়েরাও।

বারাক ওবামা এমনিতেই একজন ভালো শ্রুতিমধুর স্পিকার বা বক্তা। নতুন জেনারেশনের ছেলেমেয়েদের কাছে তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং আদর্শের প্রতীক। তাঁর মতো এত ইন্সপাইরেশনাল বক্তা এখনকার সময়ে দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া দায়। করোনার এই দুঃসহ পরিস্থিতিতে বারাক ওবামা টিভির স্ক্রিনের মাধ্যমে সেদিন যে উৎসাহব্যঞ্জক কথাগুলো বলেছিলেন, সদ্য সমাপ্ত কোমলমতি স্কুল-কলেজ/ইউনিভার্সিটি গ্র্যাজুয়েটদের উদ্দেশে, তা তাঁদের মনে কেবল আশার সঞ্চারই করেনি, বরং কীভাবে তাঁরা এই করোনা প্যান্ডেমিক মোকাবিলা করে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে, তার মূলমন্ত্রটিও যেন সেই লেকচারের মধ্যে ওবামা শিখিয়ে দিয়েছিলেন।

তাঁর ওই লেকচারটি প্রচারিত হওয়ার পরপরই আমার ছেলেমেয়ে একসঙ্গে সমস্বরে বলেই উঠল, আহ! এই রকম প্রেসিডেন্ট কি আবার আমরা দেখতে পাব আমেরিকাতে। যে আমাদের আশার কথা বলবে, মানসিক শক্তি জোগাবে, সামনে চলার পথ দেখাবে।

এবার আসি নিউইয়র্ক শহরের একটি করোনায় আক্রান্ত পরিবারের কথা নিয়ে। তারা দূরের আর কেউ নয়, খুব কাছের। আমার আপন ছোট ভাই বিদ্যুৎ। করোনার মধ্যে এমনিতেই নিউইয়র্ক শহরের অবস্থা ছিল বেসামাল। বিদ্যুৎ তার পরিবার নিয়ে থাকে নিউইয়র্কের কুইন্স ভিলেজে। এলাকাটি করোনায় হয়েছে ছিন্নভিন্ন। হাসপাতালগুলো করোনা রোগীর চাপে গত এপ্রিল–মে মাসে ছিল দিশেহারা। মে মাসের শুরুতে বিদ্যুৎ ও রিতিও (বিদ্যুতের স্ত্রী) হলো করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। রিতি এনওয়াইপিডির একজন পুলিশ অফিসার। করোনায় আক্রান্তের আগে সে ছিল ম্যাটারনিটি লিভে। টানা পাঁচ মাস। তারপর চাকরিতে যোগ দিল এপ্রিলের শেষে। ঘটনা ঘটল তখনই। এক সপ্তাহের মধ্যেই রিতি প্রথমে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলো। তারপর বিদ্যুৎ, তাওই ও মাওই সাহেবও (বিদ্যুতের শ্বশুর ও শাশুড়ি) আক্রান্ত হলেন।

ওই বাড়িতে দুজন কনিষ্ঠ সদস্য ও আশার প্রতীক আছে। আমার ভাতিজা ছোট্ট ফুটফুটে শিশু আদিয়ান ও শায়ান। এটা কি ভাবা যায় যে একটি বাড়িতে দুটি ছোট্ট শিশু নিয়ে সব মানুষ যখন করোনায় আক্রান্ত হয়ে তার সঙ্গে জীবনযুদ্ধ করে টিকে থাকার লড়াইয়ে ব্যস্ত, তখন তাঁদের মনোবল, শক্তি ও সাহস কতটুকু দৃঢ় রাখার দরকার ছিল? সে সময় আমি বোস্টন থেকে প্রতিদিন ওদের সঙ্গে কথা বলছি, অথচ যেতে পারছি না। এ এক ভীষণ চাপ মনের মধ্যে। এখনো যেতে পারছি না। যা–ই হোক, করোনার সময়ে মানসিক শক্তির কোনো বিকল্প নেই। মানসিক শক্তি দিয়ে করোনার বিরুদ্ধে টানা এক মাস সংগ্রাম করে করোনাকে জয় করে আরোগ্য হলো তাঁরা সবাই।

করোনার ছোবল দেশে আমার আপনজনের কাউকে কাউকেও ছুঁয়ে গেছে। তবে তাঁরা সুস্থও হয়েছেন।

আমরা এটা জানি যে কদিন আগেও আমেরিকা ছিল করোনার মৃত্যুপুরী। বিশেষ করে নিউইয়র্কে ছিল রিয়াল করোনা প্যান্ডেমিক। হাসপাতালের সামনে ছিল করোনা পরীক্ষার জন্য সুদীর্ঘ লাইন। নিউইয়র্কের হাসপাতালগুলো থেকে ফিউনারেল হোমে থাকত প্রতিদিন লাশের মিছিল। নিউইয়র্কের আকাশ যেন লাশের বাতাসে ভারী হয়ে উঠেছিল। মানুষ ঘর থেকে বাইরে বেরোতেও ভয় পেত। অবশ্য এখন পরিস্থিতি অনেকটাই হালকা হয়ে এসেছে। স্টেটগুলোতে লকডাউন কিছুটা শিথিল করা হয়েছে। যদিও করোনা ইনফেকশনের সংখ্যা ফ্লোরিডা, অ্যারিজোনা, টেক্সাস, ক্যালিফোর্নিয়া, নর্থ ক্যারোলাইনাসহ কিছু স্টেটে হু হু করে আবারও বাড়তে শুরু করেছে। এই জুলাই–আগস্ট মাসের শেষে আমরা হয়তো বুঝতে পারব করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঝড় আমেরিকার আকাশকে কতটা ভারী করে তুলছে।

যে করোনাভাইরাস আজ আমাদের জীবন চলার পথকে করেছে স্থবির, আশা ও স্বপ্নের মধ্যে তৈরি করেছে ছেদ, জীবিকার পথগুলোকে করে তুলেছে দুঃসহ, সেই করোনা মোকাবিলার জন্য কার্যকর কোনো ভ্যাকসিন বা চিকিৎসা আজও আবিষ্কৃত হয়নি। আমেরিকার বোস্টনে অবস্থিত মডার্না থেরাপিউটিকস কিংবা নোভাভ্যাক্স কিংবা ইনোভিও অথবা ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ড/এস্ট্রাজেনিকা ফার্মাসিউটিক্যালস কিংবা জার্মানির বায়োনটেক এবং তার সহযোগী ফাইজার যেসব ভ্যাকসিন আবিষ্কারের দৌড়ে এখনো এগিয়ে আছেন, সেই ভ্যাকসিনগুলোর দিকেই আজ সারা বিশ্বের মানুষ চাতক পাখির মতো তাকিয়ে আছে। ভ্যাকসিনগুলোর সেফটি ও ইমিউন রিসপন্স এফিকেসির জন্য মানবদেহে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল থেমে নেই। একই সঙ্গে চলছে পরীক্ষামূলক ভ্যাকসিনগুলোর কোটি কোটি ডোজ উৎপাদন।

এটা আমাদের মানতেই হবে যে যত দিন কার্যকরী ভ্যাকসিন মানুষের হাতে হাতে এসে না পৌঁছাবে, তত দিন নিউ-নরম্যাল এবং স্বাস্থ্যবিধির ডাক্তারি পরামর্শগুলোই আমাদের জীবন বাঁচানোর ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা হিসেবে কাজ করবে। মানসিক শক্তি তো বটেই।

* লেখক: বোস্টনের একটি ফার্মাসিউটিক্যালস ইন্ডাস্ট্রিতে ড্রাগ ডিসকোভারি রিসার্চের সঙ্গে জড়িত। [email protected]