নদীর পাড় ভাঙার শব্দ বিদেশেও শুনি

নদী ভাঙন।
নদী ভাঙন।

ঘর বাঁধে, নীড় বাঁধে, বেলা শেষে নীড়ে ফিরে পাখি। পাখির নীড়ের মতো একচিলতে ভিটেমাটি, ছোট্ট একটা ঘর, একটু ছায়া, একটু মায়া সব মানুষেরই বোধ হয় চিরায়ত স্বপ্ন। তাই তো প্রজন্মের স্মারক, পিতা-পিতামহের স্মৃতিবিজড়িত ভিটেমাটির জন্য মানুষের ভালোবাসা চিরন্তন। ভিটেমাটিতে জড়িয়ে থাকে জীবনের দুঃখ-সুখের এক সুদীর্ঘ উপখ্যান, প্রজন্মের ইতিহাস আর গৌরবগাথা।

পৃথিবীতে ভিটেমাটি হারানোর গল্পও তাই অনেক ট্র্যাজিক। চৌদ্দ পুরুষের বাস্তুভিটা, জন্মভূমি রক্ষার জন্য মানুষ জীবন দেয়, লড়াই করে। এরপরও নানা কারণে মানুষ ছিন্নমূল হয়, দেশান্তরি হয়, নির্বাসনে যায়।
নির্বাসিত মানুষ নিশিদিন অপেক্ষায় থাকে কবে ফিরবে তার জন্মভূমিতে, অস্তিত্বের শিকড় ভিটেমাটিতে। পিতা-পিতামহের স্মৃতিবিজড়িত পৈতৃক ভিটেমাটিটি চিরতরে হারিয়ে গেলে কেমন অনুভূতি হয় কখনো উপলব্ধি করেছেন? মানুষ যত বড়ই হোক, যেখানেই থাকুক তার অন্তর বারবার চায় ভিটেমাটিতে গিয়ে দাঁড়াতে, কালের উজান বেয়ে ফেলে আসা সময়ে চলে যেতে। জীবনের সব হিসাব চুকিয়ে মানুষের মন চায় গ্রামের ভিটেতে বাঁশবাগানের ছায়ায় চিরনিদ্রায় শায়িত হতে। এটাই শিকড়ের চিরন্তন টান, এটাই মাটির মায়া, এটাই ভালোবাসা জন্মভূমির জন্য।
ছোটবেলায় পদ্মা নদীকে আমরা বলতাম বড় গাং (বড় গঙ্গা), আর বর্ষায় বাঁধের নিচে বন্যা এসে যে নদী তৈরি হতো, সেটাকে বলতাম ছোট গাং। আমাদের উচ্ছ্বাস-আনন্দ আর দুরন্তপনা ছিল এই ছোট গাং নিয়ে । এখানেই শিখেছি আমি সাঁতার, নৌকা চালানো। বড় গাং ছিল অনেক দূরে (অন্তত ৫ কিমি)।
প্রথম যেদিন আব্বার সঙ্গে বহু পথ হেঁটে বড় গাং দেখতে গিয়েছিলাম, সেদিন আমার বিস্ময় আর আনন্দের সীমা ছিল না। এত বড় নদী! এত উঁচু পাড়! এত স্রোত! একবার গরুর গাড়িতে করে খড় আনতে গিয়ে সারা দিন খেলেছিলাম পদ্মার জল আর কাদামাটিতে। এই গাঙের করালগ্রাসে আমাদেরসহ গ্রামের অধিকাংশ মানুষের ফসলি জমি বিলীন হয়ে গেল আমার কিশোর বেলায়। সবার খাদ্যনিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়ল। মানুষ অনেকটা দিশেহারা। মাঠ ভাঙা শেষ হলে ভাঙল জনপদ, স্কুল, রাস্তাঘাট। একসময় প্রমত্ত পদ্মা চলে এল বাড়ির একেবারে কিনারে। বর্ষায় গভীর রাতে পাড় ভাঙার শব্দে ঘুম ভেঙে যেত। রাতদুপুরে দৌড়ে গেছি বিপন্ন গ্রামবাসীর ঘর ভাঙা, গাছ কাটা, চাল-চুলা সংসারের কত কী এগিয়ে দেওয়ার জন্য। মানুষের ভিটেমাটি ভাঙার এই করুন চিত্র আমাকে দারুণভাবে বিচলিত করত। চোখের সামনে ঘরের ভিটে, উঠান, বাঁশঝাড় নদীর বুকে বিলীন হতে দেখে বুকের মাঝে বেদনার ঝড় উঠত। শুধুই মনে হতো নদী এত সর্বনাশী কেন? শেউড়াতলা ভেঙে যখন বাঁশবাগানের কোনায় নদী চলে এল, তখন আমরা ইট-কাঠ, ঘরের চাল আর চার পুরুষের ভিটেমাটির স্মৃতি বুকে নিয়ে উঠলাম দুই কিলোমিটার দূরের গ্রামে। বদলে গেল আমাদের ঠিকানা। সেখানে নতুন করে বসতি স্থাপন করা হলো। আমাদের প্রিয় বসতভিটা, আমগাছ, ইঁদারা, বাঁশঝাড়, বুড়িমার কবর ছেড়ে চলে এলাম নতুন জায়গায়। যেদিন চিরতরে হারিয়ে গেল পিতা-পিতামহের স্মৃতিবিজড়িত ভিটেমাটি সেদিন দাদি, আব্বা-মায়ের সঙ্গে আমরাও অঝরে কেঁদেছিলাম নীরবে। পুরোনো ভিটায় নদীর শেষ পাড়টি ভাঙা পর্যন্ত বসে ছিলেন দাদি, আব্বা, মা। বুকের পাঁজর ভেঙে ইট-কাঠ, চাল-চুলা বয়ে নিয়ে গেলেও পদ্মার জলে মিশে গেল প্রিয় মৃত্তিকা, প্রিয় জন্মভূমি, জীবনের গন্ধমাখা ভিটেমাটি; যে মাটি ছুঁয়ে ধন্য হয়েছিল ক্রন্দনরত এক নবজাতক।
নৈঃশব্দ্য, হাহাকার, অন্তহীন অসহায়ত্বকালের উজান বয়ে নিয়ে যায় শিকড়ের কাছে, মাটির কাছে। যে ভূমিতে ফেলে আসা জীবনের সোনারোদ, ছেলেবেলা নিহত সময়, সেখানেই উড়ে যেতে চায় পোড়া মন। করোনাকালে পরবাসে ভিটেমাটির কথা, নিহত সময়ের কথা, দুরন্ত শৈশবের কথা খুব নাড়া দেয়। একাকী বসে চোখ বন্ধ করে সময়ের উজান বেয়ে চলে যাই ঘুঘু ডাকা সন্ধ্যা নদীর বাঁকে। নিস্তব্ধ নিশিতে বুকের ভেতর এখনো নদীর পাড় ভাঙে, রাত ঘুমে এখনো স্বপ্ন দেখি সেই ভিটেমাটি, সেই ইঁদারা, বাঁশঝাড়, কাঁঠালতলা। করোনাকালের পাথর সময়ে পদ্মা নদীর শাঁ শাঁ আর্তনাদ আর পাড় ভাঙার শব্দ অন্তরে ঢেউ তোলে, স্মৃতির আর্কাইভে তুফান ওঠে। একচিলতে অতীত ডানা ঝাঁপটে মরে এক জ্বালাময় শকটে। সমৃদ্ধির স্বপ্নালোকে বসে শুধুই মনে পড়ে বাথান বাড়ি, কুঁড়েঘর আর নদীর ঘাটের চৈরী কোলাহল। পাহাড়ের পাদদেশে বসে শুধু ভেসে ওঠে ষাঁড়ের দীপ্ত হুংকার, সাঁঝের মায়া, আজানের ধ্বনি, শঙ্খ-চিল, তেপান্তরের মাঠ, দুরন্ত সাতার, মায়ামমতা আর জীবনের গান। পল্লিমায়ের আঁচলজুড়ে কী এক নির্ভেজাল জীবন, কী এক সরল সমীকরণ। যে সমৃদ্ধির অলীক স্বপ্নে আমরা ঘর ছাড়ি, সেই সমৃদ্ধি তো পল্লিমায়ের আচলেই বাঁধা চিরকাল। স্বপ্নের অস্ট্রেলিয়াতে প্রযুক্তির উৎকর্ষ আছে, সুপারসনিক গতি আছে। মায়া নেই, ছায়া নেই, নেই বটতলা-হাটখোলা, খেয়াঘাট, বাথানবাড়ি। পরবাসে নদী দেখলেই থমকে দাঁড়াই, বুকের মাঝে নদীর পাড় ভাঙার শব্দ শুনি। জলরাশির দিকে ফ্যালফ্যালিয়ে চেয়ে থাকি। জলের নীলিমায় খুঁজি জীবনের বাঁশরি। নীরবে বুকের মধ্যে বেজে ওঠে ‘সর্বনাশা পদ্মা নদী...
উৎসবে-পার্বণে, ছুটির অবসরে বাড়ি যাই, নীরবে পদ্মা পাড়ে গিয়ে দাঁড়ায়। ওপারে চেয়ে থাকি হারিয়ে যাওয়া ভিটেমাটির দিকে। খুঁজে ফিরি আমার কিশোরবেলার ডাঙ্গুলি, ঘুড়ির লাটাই, গোল্লাছুট আর গাদন খেলার দিনগুলো। পলিমাটির গন্ধ, পোয়াল পালা, সাঁঝের মায়া, সন্ধ্যাপ্রদীপ, ঝিঙে মাচায় ঘুঘুর বাসা আর কাঁঠালতলার ছায়া কেউ ফিরিয়ে দেবে না আমায়। নতুন কোনো বন্ধুকে পদ্মাপাড়ে দাঁড়িয়ে আঙুলের ইশারায় দেখায়, ‘ওইখানে আমাদের ভিটেমাটি ছিল, স্বপ্ন ছিল, জীবনের গল্পগাথা আর গান ছিল—এখন শুধুই বালুচর আর অথৈ জল…
*লেখক: পিএইচডি ফেলো, ইউনিভার্সিটি অব নিউ ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। [email protected]