মায়ার শহর অবার্ন

অবার্ন ইউনিভার্সিটি তার সৌন্দর্য বর্ণনায় ব্যবহার করে ‘মোস্ট বিউটিফুল ভিলেজ অন দ্য প্লেইন’। ছবি: আলামিন মোল্লা
অবার্ন ইউনিভার্সিটি তার সৌন্দর্য বর্ণনায় ব্যবহার করে ‘মোস্ট বিউটিফুল ভিলেজ অন দ্য প্লেইন’। ছবি: আলামিন মোল্লা

এখনো ভাবতে গেলে বুকটা ভারী হয়ে আসে—যেদিন ঢাকা বিমানবন্দর থেকে ইত্তেহাদের বিশাল বোয়িং বিমানটা আমাকে নিয়ে আমেরিকার পথে যাত্রা শুরু করে ছিল। রানওয়ে চিরে ওপরে উঠতে উঠতে হাজার প্রদীপের মতো জ্বলতে থাকা প্রিয় শহরটাকে অনেক দূরে ফেলে একসময় পৌঁছলাম অবার্ন নামের এক ছোট্ট কলেজ টাউনে। মানুষ আত্মীয়-পরিজন, বন্ধুবান্ধব ফেলে প্রবাসে এসে স্মৃতিকাতরতায় দিন কাটায়, আর আমি উচ্চশিক্ষার টানে ফেলে এসেছিলাম স্বামীসহ দুই বছর বয়সী সন্তানকে। বলা বাহুল্য, মন না টিকলে আবার দেশে ফিরে যাব, এমন সম্ভাবনা মাথায় নিয়েই গ্র্যাজুয়েট স্কুলে আসি।

৮ জানুয়ারি ক্যালেন্ডারের হিসাবে যখন বসন্তের মাত্র শুরু, প্রকৃতি তখন ঠিক ততটাই বিবর্ণ। হিমাঙ্কের কিছুটা নিচের সেই তাপমাত্রা বরফ পড়ার মতো না হলেও আমার মনের বরফ গলিয়ে দেওয়ার উষ্ণতা তার ছিল না। মানসিক এই টানাপোড়েন নিয়ে পিএইচডি জীবনের প্রথম দিন ঘর থেকে বেরিয়ে দেখলাম ভীষণ রুক্ষ, প্রাণহীন প্রকৃতি, পাতাহীন গাছের ডালগুলো দেখে মনে হতো হরর ছবির কোনো দৃশ্য।

দিন কেটে যাচ্ছিল সেমিস্টারের ব্যস্ততায়। এরপর হঠাৎই একদিন খেয়াল করলাম বিষণ্ন আকাশটা আর ধূসর নেই, আকাশের নীল যে এত গাঢ় হতে পারে ভাবতেই পারিনি। রং–তুলির প্যালেটে কটকটে নীলের যেই শেডটা কখনই হাতে উঠতে চায় না, অথবা আনাড়ি আলোকচিত্রীর ওভার এডিট করা আকাশের ছবির মতো ঘন নীল এখানে বাস্তবের আকাশ। আস্তে আস্তে গ্রীষ্মের দিন প্রায় সমাগম। তত দিনে আবিষ্কার করেছি অবার্নের আবহাওয়ার সঙ্গে ঢাকার আবহাওয়ার কী এক আশ্চর্য মিল। যে গরমে আমেরিকানদের প্রাণ ওষ্ঠাগত, আমি ঢাকার পরশ পাই সেই গরমে। অবার্নের বৃষ্টি এত বৈচিত্র্যময়, কখনো ঝুম বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে ফিরতাম তো কখনো আবার গায়েই শুকাত ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি। আর বৃষ্টি শেষে বোনাস হিসেবে রংধনু খুব নিয়মিত উঁকি দেয়। এখানে ছকে বাঁধা প্রকৃতি আর অসংখ্য সৌন্দর্যের ভিড়েও আকাশ আর বৃষ্টি নিয়ে আমার মুগ্ধতা এখনো এতটুকু কমেনি।

যেই ভগ্নমনোরথে এখানে এসেছিলাম, অবার্নের প্রকৃতি দুহাত উজাড় করে সেটাকে ভালো লাগায় পাল্টে দিয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, শুধু আমিই নই, আরও ১ লাখ ৪০ হাজার স্টুডেন্টের ওপর গবেষণার ভিত্তিতে প্রিন্সটন রিভিউ রিপোর্ট করেছে অবার্ন ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্টরাই পুরো আমেরিকার মধ্যে সবচেয়ে সুখী। এরপর দেখতে দেখতে পার হয়ে গিয়েছে চার চারটি শরৎ, গ্রীষ্ম আর বসন্ত। না, এখনো ফিরে যাওয়া হয়নি, বরং যতই দিন গিয়েছে আরও বেশি মায়ায় জড়িয়ে গিয়েছি এই শহরের সঙ্গে। প্রকৃতিই যে শুধু উজাড় করে ভালোবেসেছে তা নয়, অবার্নে এসে ঠিক পরিবারের মতোই আগলে রাখা একঝাঁক নিঃস্বার্থ কিছু বন্ধু পেয়েছিলাম বলেই এখনো গ্র্যাড স্টুডেন্ট লাইফটাকে ভীষণ এনজয় করি। এক বছরের মাথায় মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে আসতে পারলেও স্বামী ড. আসিফ মাহমুদ এখনো বাংলাদেশে কাজ করে যাচ্ছে দেশকে ভালো কিছু দেওয়ার প্রত্যাশায়। হয়তো করোনার থাবা থেকে পৃথিবী সুস্থ হবে শিগগিরই, আর আমরা সংসার সাজাব পৃথিবীর কোনো এক প্রান্তে।

*লেখক: পিএইচডি গবেষক, অবার্ন, অ্যালাবামা, যুক্তরাষ্ট্র