ঘুম ভাঙতেই মৃত্যুর খবর পেলাম

করোনাভাইরাসে পাল্টে গেছে জীবনের বাস্তবতা। আক্রান্ত হয়েছেন অনেকেই। করোনায় জীবন নিয়ে লিখছেন অনেকেই। এই চিকিৎসকও করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর সিরিজ লিখছেন। আজ পড়ুন ১৯তম পর্ব।

ঘুম ভাঙতেই আরও একটি মৃত্যুর খবর পেলাম বাবার কাছ থেকে।

এত দিনে জেনেছেন, আমার মেজ মামা সড়ক দুর্ঘটনায় ইন্তেকাল করেছেন। তাঁর জানাজায় এসেছেন অনেকেই। তার মাঝে একজন আমার চাচা। আমার দাদির বোনের ছেলে। বাড়ি আমার নানির বাড়ির কাছে। দাদি যত দিন বেঁচেছিলেন, কোনো দিন নানি বাড়ি গিয়ে দাদি এবং চাচাদের দেখাটা মিস করতাম না। তাঁর ছেলে এসেছিলেন জানাজায় শরিক হতে। আমার বাবা জানালেন, তিনি বাসায় গিয়ে চেয়ারে বসেছিলেন, চেয়ার থেকে পড়ে গিয়ে আর ওঠেননি। সম্ভবত স্ট্রোক!

ছোটবেলা থেকেই জেনে এসেছি, খারাপ খবর আসে দল বেঁধে। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মৃত্যু কার কোথায়, কীভাবে লেখা, আমরা জানি না।

আল্লাহ তাঁর দোষত্রুটি ক্ষমা করে, জান্নাতের ব্যবস্থা করুন, সে প্রার্থনাই করি।

গতকাল আমার আদার হাফের অবস্থা বেশ কাহিল ছিল। তবে যেহেতু ও পজিটিভ মানুষ, এই ভীষণ গরমেও জ্যাকেট পরে ঠিক করেছে হাঁটতে যাবে, আমি বাধা দিইনি, ও যদি ভালো ফিল করে যে ওর হাঁটাটা কন্টিনিও করতে পারছে। তাতে যদি ওর মন ভালো থাকে, যাক! জাস্ট প্রপার প্রটেকশন নিলেই আমি খুশি, যাতে অন্য কারও এক্সপোজার না হয়।

নরমালি খাওয়াদাওয়া করতে চায় না সে, তবে যেহেতু ভালো হতে হবে, খাবারের কথা মনে করিয়ে দিলে, ফাস না করেই খেয়ে নিচ্ছে। অ্যাটলিস্ট খাচ্ছে। খাবারের ইচ্ছা ভীষণ কমে যায় কোভিডে। আমার আর মেয়ের সেই স্টেজে খুব খারাপ লেগেছে।

মেয়েটা আজ ভালো ফিল করছে! ঘুম থেকে উঠতে উঠতে দেরি করে ফেলেছি। নিচে নেমে দেখি কর্তা হাসিমুখে কাজ করছে, থ্যাংক্স গুডনেস সে আজ কালকের চেয়ে ভালো আছে। সবার নাশতা শেষ। এদিকে আমার মেডিকেলের বন্ধুরা খুঁজে বের করেছে, শত বছর আগে এই দিন আমরা প্রথম মেডিকেলে গিয়েছিলাম! তারা জুম মিটিং করবে! আমার যেহেতু দিন, তারিখ, মাসের হিসাব নাই, আমি ভেবেছি দুঘণ্টা আগেই এই মিটিং শেষ হয়ে গেছে, যখন আমি ঘুমাচ্ছিলাম। পরে সবাই বলছে, না এখন হচ্ছে, যোগ দাও। আমার বর শুনে বলছে, জয়েন কর, ভালো লাগবে। এক কাপ চা নিয়ে জয়েন করলাম—আসলেই সবাইকে দেখে অনেক ভালো লেগেছে।

চা শেষ করতেই জুম মিটিং শেষ, আমার ব্রেকফাস্ট হয়নি/এদিকে লাঞ্চ টাইম! এরা সবাই আজ স্পাইসি থাই অর্ডার করেছে, মিটিং শেষ হতেই খাবার চলে এসেছে বাসায়। আমার ছুটি এপ্রুভ হয়েছে, আমি ভাবছি কী করব! আমার বরও চিন্তিত—এতটা সময় আমি বাসায় বসে কী করব? কোভিড এমন বিশ্রী সময়ে এল! আমি ১০ বছরে এত সময় পাইনি, এখন এই সময় আমি কী করব?! আবার কোথাও যাওয়াও যাবে না! আসলে তার ভয়, আমি তাকে ভীষণ বিরক্ত করব। মনে মনে বলি, সুস্থ হও, আর ছেলেটাকে কোভিড দিয়ো না।

আমার করার লিস্ট অনেক বড়, তবে করতে পারব কি না জানি না। এই যেমন গতকাল ভাবলাম, একটু ভালো লাগছে, হয়তো দু–একটা গাছ প্ল্যান্ট করতে পারব। না শেষে আর ধৈর্য, শক্তিতে এবং সাহসে কুলায় নাই! হয়তো এভাবেই পুরোটা সময় যাবে। আবার সবাই সুস্থ হলে, আমি যদি খুব বোর ফিল করি, কাজে ফিরেও যেতে পারি। আমরা সবাই কাজপাগল মানুষ। ব্যস্ততার ভণিতা করতে হয় না, ব্যস্ত না থাকলে পাগল পাগল লাগে।

লেখক
লেখক

এর মাঝে ভাইয়ের ম্যাসেজ পেলাম, ছোট ভাইয়ের বউয়ের প্রিমাচ্যুর ডেলিভারি হয়ে গেছে। এটা এক্সপেক্টেড ছিল। মা–ছেলে সুস্থ...মন ভালো হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে একটা সুসংবাদের অপেক্ষাতেই ছিলাম। এই গুমোট, দমবন্ধ করা, ঘরে বন্দী কোভিড নিয়ে, পরিবারের মেটামুটি সবার অসুস্থতা নিয়ে, সঙ্গে পরিবারে মৃত্যুসংবাদের ছড়াছড়ি নিয়ে, শারীরিক, মানসিক—সবদিক দিয়েই অবসাদগ্রস্ত লাগছিল, দমবন্ধ লাগছিল। একটু ফ্রেশ হাওয়া মন্দ নয়। বাচ্চাটাকে হয়তো কয়েক মাস হসপিটালে থাকতে হবে, তবে এতে মা–বাচ্চা দুজনেরই শারীরিক অবস্থার উন্নতি হবে।

আমরা এখানে প্রেগন্যান্সির জন্য তেমন ছুটি পাই না। দুই সপ্তাহ অনলি। আমাদের রেসিডেন্সি চলাকালীন অনেকেই শেষ বর্ষে প্রেগন্যান্ট ছিল আর সবাই ডেলিভারি হওয়ার আগের দিন পর্যন্ত কাজ করেছে। বলাতে মনে হয় ভাবছেন সহজ ছিল মনে হয়। আমাদের রেসিডেন্সি ভীষণ টাফ। সকালে মানে ভোর পাঁচটায় কোন রোটেশনে, স্পেশালি হসপিটালে হলে, আমাদের ওপরই প্রতিটি রোগীর দায়িত্ব, ভালো যে ৩০ ঘণ্টার বেশি একটানা কাজ নয়।

তবে যদি এরই মাঝে ভিন্ন রোটেশন, তবে হয়তো শহরের একপ্রান্ত থেকে ভিন্ন প্রান্তে যেতে হতো, সময়ের হেরফের করা যাবে না, দায়িত্বে কোনো গাফিলতি করা যাবে না। কফি ব্রেক বলে কিছু নাই। লাঞ্চ ব্রেকেই হয়তো ঘণ্টাখানেক ড্রাইভ করে নির্দিষ্ট গন্তব্যে যেতে হবে। লাঞ্চ টাই কোনো রকমে ড্রাইভ করতে করতে শেষ করতে হতো। আর কফি, হাতে নিয়ে হসপিটালের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে হাঁটার ফাঁকে, পেশেন্টদের রোটেশনের মাঝে চুমুক দেওয়া যেত। অবশ্যই পেশেন্ট দেখার সময় নয়, সেটা প্রফেশনাল নয়। তো যা–ই হোক, এমন সময়ে প্রেগন্যান্সি মুখের কথা নয়! আর প্রেগন্যান্ট বলে কোনো স্পেশাল খাতির নাই। সেই ডেলিভারির আগ পর্যন্ত নিশ্বাস ফেলার সময় নাই, আর বাচ্চা হবার দুসপ্তাহের মাঝে কাজে ফিরে আসা সহজ নয়। তবে কোনো উপায়ও নাই। বিনা দরকারে সিজারিয়ান ডেলিভারি নয়, আর সিজারিয়ান হলেও দ্বিতীয় দিনেই বাসায় চলে যেতে হয়। সেম নরমাল ডেলিভারিতে। বাচ্চার সমস্যা হলে শুধু বাচ্চা হসপিটালে থাকে বেশির ভাগ সময়ে। মা দেখতে আসতে পারে। আদর করে অতিরিক্ত একটি দিনও কোনো মাকে হসপিটালে রাখা হয় না। আসলে মানুষ ভীষণ প্র্যাকটিকাল এখানে, ভীষণ হিসেবি হোক সে সময়ের ব্যাপারে, হোক সে অর্থনৈতিক ব্যাপারে। কেউ লোক দেখানোর জন্য একটি পয়সাও খরচ করে না, প্রতিটা পয়সা কত কষ্টের এরা তা ভালোই জানে। জানে হাত পাতলেই বাবা–মা বা আত্মীয়স্বজন একটি পয়সা ও দেবে না। নিজেদেরটা নিজেদের করতে হবে আর সে জন্যই সবাই স্বনির্ভর। আর তার জন্য এদের মনে কোনো কষ্টও নেই, কারণ এটাই স্বাভাবিক। আর আমরা কতশতভাবে অপচয় করি! নিজের না থাকলেও অন্যের কাছে ধার করে হলেও লোক দেখানো শো অফ। আশা করি বন্ধ হবে এসব, একদিন আমরাও সবাই স্বনির্ভর হব, মানুষের কাছে হাত পাতা বন্ধ করব, হোক সে বাবা–মা বা আত্মীয়স্বজন। হয়তো একদিন আমরাও কঠিন পরিশ্রমে বিশ্বাস করব। চলবে...

আরও পড়ুন: