জলে ভেজা পদ্ম

হোটেল শেরাটন থেকে বেরিয়ে যখন আমি গাড়িতে উঠলাম তখন রাত এগারোটা। আজ সেমিনারের শেষ দিন। আমার অস্ট্রেলিয়ান সহকর্মীরা হোটেলেই থাকবে। আমি ফিরে যাওয়ার আগে দুটো দিন বাসাতে থাকব বলে ভাইয়াকে গাড়ি পাঠাতে বলেছিলাম।

‘তসলিম ভাই আপনার অনেক রাত হয়ে গেল, না?’ বড় ভাইয়ার গাড়িচালক তসলিম। আগের বার যখন দেশে এসেছিলাম তখনো দেখেছি। বেশ অমায়িক। কথা একটু বেশি বলে এই যা।

‘না আপা। রাইত কই দ্যাখলেন। ঢাকায় রাইত এগারোটা এহন কিছুই না। মাঝে মাঝে স্যার- ম্যাডাম তো রাইত একটা দুইটা পর্যন্ত বাইরে থাকে। হোটেল, দোকানপাট সবই তো খোলা থাকে।’

‘অত রাত পর্যন্ত ভাইয়া ভাবি বাইরে কি করে?’

তসলিম ভাই রিয়ার ভিউ মিররে আমাকে একবার দেখে। তারপর মিন্টো রোডের দিকে গাড়ি ঘুরিয়ে নিতে নিতে বলে, ‘দোকানপাটে যায়। ক্লাবে যায়।’

‘কিসের ক্লাব?’

‘তা তো জানি না আপা।’ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বলে, ‘আপা আপনারে একটা কথা জিগাই? আগের বার যহন আই ছিলেন তহনও জিগাইতে চাইছিলাম। পারি নাই।’

‘বলেন।’

মিন্টো রোড পার করে সাতরাস্তার দিকে মোড় নেয় গাড়ি। তসলিম ভাই একটু দম নিয়ে বলল, ‘আচ্ছা আপা অস্ট্রেলিয়ায় কি ড্রাইভারি চাকরি নাই? আমি কিন্তু খুব ভালো গাড়ি চালাই। আপনি তো দ্যাখছেনই ………। ’

তসলিম ভাই কথা বলতেই থাকে। একটা দু’টো শব্দ কানে আসে কিন্তু আমার মনোযোগ ছুটে যায়। আমার মাথার ভেতর তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েটি। তার কয়েকটা শব্দ। অবিরাম ঘুরপাক খাচ্ছে। সে তো শ্যাওড়ায় নামবে বলে বাসে উঠেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস। বন্ধুরা ছিল, টুকরো টুকরো কথা, গাদাগাদি, হাসাহাসি। সবই ছিল। ‘সেই আনন্দের রেশ শেষ হওয়ার আগেই কেন আমার জীবন বদলে যাবে? ভুল করে শ্যাওড়ার বদলে কুর্মিটোলায় নামলেই এত বড় একটা ঘটনা ঘটবে? একটা মাত্র ভুল বাস স্টপেজ কেন আমার জীবনে ময়লা কালচে একটা জ্যাকেটের দুর্গন্ধ সেঁটে দেবে সারা জীবনের জন্য? কেন আমাকে প্রতিবার মুখে ভাতের লোকমা তুলতে গেলেও সেই দুর্গন্ধ পেতে হবে? যতই শুকনো করে মুছে রাখি, একটা ভেজা অনুভূতি লেগে থাকে আমার তলপেটে? কিছুতেই মুক্তি নেই সেই ভেজা অনুভূতি থেকে।’

মেয়েটার প্রত্যেকটা শব্দ ড্রামের মতো এখনো আমার কানে বাজছে। মনে হচ্ছে মাথার কোথাও বড়শিতে গেঁথে গেছে। কিছুতেই ছাড়াতে পারছি না।
তসলিম ভাইয়ের কথা তখনো শেষ হয়নি।

‘জানেন আপা, ঢাকা আর আগের মতন নাই। এখন……………।’

মেয়েটা যে সেমিনারে আসবে সেটা নুসরাত আপা আগেই বলেছিলেন। তবে সে যে কথা বলবে এটা আপা আগে বলেননি।

মেয়েটা যখন কথা বলতে উঠছিল তখন আপা পাশ থেকে ফিসফিস করে বললেন, ‘আমরাই মেয়েটিকে কাউন্সেলিং করেছি। ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার থেকেই শুরু। এখনো নিয়মিত আসছে। অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে। তবে আরও সময় লাগবে, আরও সেশন লাগবে।’
‘আপা, কোন দিক দিয়ে যাব?’ তসলিম ভাই জানতে চাইল।
‘আপনার যেদিক দিয়ে খুশি। তবে বাসার কাছাকাছি একটা ফার্মেসিতে দাঁড়াবেন। ওষুধ কিনতে হবে।’

তসলিম ভাই ঠিকই বলেছে, ঢাকা আর আগের মতো নেই। সাত রাস্তার মোড়ে এত রাতেও লম্বা ট্রাফিক জ্যাম। উত্তরা যেতে সময় লাগবে।
নভেম্বরের শুরু। তবুও গরম কমেনি। রাস্তায় সোডিয়াম বাতি। ধুলোময়, ঘোলাটে আলো। চারদিকে এলোপাতাড়ি গাড়ি, বিচিত্র হর্ন। জ্যামে হর্ন বাজিয়ে কি লাভ? বুঝি না?
আমার আরও বেশি গরম লাগে।

‘তসলিম ভাই, এসিটা আরেকটু বাড়িয়ে দেবেন।’

আমি কথা বললাম দেখে তসলিম ভাই জানতে চাইল, ‘আচ্ছা আপা দুলাভাই, মা’মনি আইলো না?’

‘নাসেরের ছুটি নেই। আর মৌমিতার স্কুল খোলা। আমি তো এসেছি ইউনিভার্সিটির কাজে। মাত্র সাত দিনের জন্য। শুক্রবার ফিরে যাব। পরের বার ওরা আসবে।’

পরেরবার আপনাদেরকে……তসলিম ভাই কিছু একটা বলছিল কিন্তু আমার কানে কিছুই ঢোকে না।

মেয়েটা কেন যে মাথায় গেঁথে আছে! মনোবিদের কাজইতো সবার কথা শোনা, নিজের মাথায় গেঁথে রাখা নয়। আমি তো ওই মেয়েটির অভিজ্ঞতার চেয়েও মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা শুনেছি। বহুবার, বহুভাবে। প্রিয় মানুষ, মায়ের দ্বিতীয় স্বামী, সম্মানের মানুষ; ঘাপটি মেরে থাকে। সুযোগ বুঝে থাবা বসায়। কই সেসব কথা তো মাথায় গেঁথে থাকেনি। অথচ মেয়েটা যখন বলল, তার নাভির নিচে সারাক্ষণ অস্বস্তিকর একটা ভেজা অনুভূতি লেগে থাকে। ঠিক তখনই মনে হলো কেউ যেন হঠাৎ একটা বাঁধের বন্ধ কপাট খুলে দিল। আমিও একটা ভেজা ভেজা বিশ্রী অনুভূতি খিল দিয়ে আটকে রেখেছিলাম। মেয়েটা সেই বন্ধ কপাটের খিল খুলে দিল।
আমি ডুবে গিয়েছিলাম চিন্তায়। যেন গভীর পানির তলায় কিছু একটা খুঁজছিলাম।

তসলিম ভাই গাড়ি থামিয়ে বলল, ‘আপা বাসার কাছে এইটাই বড় দোকান। আমারে অষুধের নাম কন, আমি আইনা দেই।’

‘না তসলিম ভাই, আমিই যাই। আপনি বসেন।’

দোকানটা আমাদের বাসা থেকে দূরে নয়। অবশ্য গত দশ বছরে এ জায়গাটার খোলনলচে বদলে গিয়েছে। আমার কাছে সব অচেনা। ইন্টারমিডিয়েটের পরে যখন দেশ ছাড়ি তখন কিছুই এমন ছিল না।

গাড়ি থেকে নেমে দোকানে ঢুকতেই একজন সেলসম্যান এগিয়ে এল। মাফলার দিয়ে মাথা ঢাকা। গায়ে মোটা সোয়েটার। বলল, ‘কী ওষুধ লাগবে আপা।’

‘একটা ওষুধ দরকার কিন্তু প্রেসক্রিপশনটা ভুলে আনিনি। জেনেরিক নাম ব্রেক্সপিপরাজল। এখানে কি নামে পাওয়া যায় তাও জানি না। আমি নিজেই ডাক্তার। আপনি কি সাহায্য করতে পারবেন?’
‘আপা ওই নামের কোনো ওষুধ আছে কি না জানি না।’
‘তাহলে উপায়?’

লোকটা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর খুবই একটা কার্যকর বুদ্ধি পেয়েছে এমনভাবে বলল, ‘আপা, ওষুধটা কি জন্য খায়?’

‘ওটা ডিপ্রেশনের জন্য।’
‘ও আচ্ছা। দাঁড়ান।’ লোকটা দোকানের পেছনে গিয়ে ছয়-সাত রকম ওষুধ এনে আমার সামনে কাউন্টারের ওপর রাখল। আমি জেনেরিক নাম মিলিয়ে দেখলাম। পেলাম না।

কাছাকাছি কম্বিনেশনে একটা পাওয়া গেল। সেটা হাতে নিয়ে বললাম, ‘আপনি কি প্রেসক্রিপশন ছাড়া দিতে পারবেন?’
‘অন্য কেউ হলে দিতাম না। আমি আপনারে চিনি। সাদি ভাইয়ের বোন। আপনার ছবিও দেখছি পেপারে। শেরাটনে বক্তৃতা দিচ্ছেন।’

‘ও।’ আমি কথা বাড়ালাম না। ‘আচ্ছা এই দিকে কোথাও একটা ছোট ওষুধের দোকান ছিল। একজন বয়স্ক লোক চালাতেন। সেটা আর নেই?’
‘উনি আমার নানা। মারা গেছে। এটাই সেই দোকান। ছোটটা ভেঙে পাশের আরেকটা দোকান নিয়ে বড় করছি।’

হঠাৎ আমার মনে হলো, আমি গভীর পানির তলায় সেই অন্ধকার দোকানের শেষ দিকের নির্জন জায়গাটা দেখতে পাচ্ছি। পাওয়ারফুল একটা চশমা চোখে বুড়ো লোকটা আমাকে ডাকছে, ‘ও নাতনি আয়, সি-ভিট নিয়া যা।’ লোকটা কোলে বসিয়ে সি-ভিট দিল। বলল, ‘চুষে খা।’ তারপর আমাকে জাপটে ধরে থাকল। কিছুক্ষণ পরে আমার প্যান্টের পেছন দিকটা ভিজে চপচপে হয়ে গেল। কী বিশ্রী ঘিনঘিনে সে ভেজা অনুভূতিটা।

‘কবে মারা গেছে আপনার নানা?’
‘পনেরো ষোলো বছর।’

ওষুধের দাম মিটিয়ে প্রায় দৌড়ে গাড়িতে এসে বসলাম।
লম্বা করে একটা শ্বাস নিলাম। হঠাৎ আমার মনে হলো, গাড়ির সিটটা ভেজা। আর সেই ভেজা ভেজা অনুভূতিটা আবার ফিরে এসেছে।
লোকটা মরে গেছে কিন্তু এই ভেজা অনুভূতিটা তো মরল না।
আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ভেজা ভেজা অনুভূতিটা আমার পেছন থেকে আস্তে আস্তে কোমর পিঠ বুক কাঁধ হয়ে মাথায় ছড়িয়ে যাচ্ছে। এখনই আমার বমি পাবে। কোনো রকমে বমিটা আটকে বললাম, ‘তসলিম ভাই, বাসায় চলেন।’

*লেখক: শিক্ষক, ডিপার্টমেন্ট অব হিস্ট্রি অ্যান্ড আর্ট হিস্ট্রি, জর্জ ম্যাসন ইউনিভার্সিটি, ভার্জিনিয়া, যুক্তরাষ্ট্র