টেনেরিফের বতুতা বাহিনী ৪

লোরো পার্কের ডলফিনের কসরতআদিবা আমাথ

৮.

ভাজা পাঁপড়েরমতো মচমচে রোদ উঠেছে। পাহাড়ি পথ বেয়ে ড্রাইভ করে যাচ্ছি আমরা। রেন্ট-এ-কার থেকে সারা দিনেরজন্য গাড়ি নেওয়া হয়েছে। গাড়ি ভালোই। তবে রাস্তা ‘রোড টু হেল’। এমন ঘুর পথ বাপের জন্মে দেখিনি। এঁকেবেঁকে কোন তেপান্তরে যে মিশেছে, বলা মুশকিল। তার ওপর বিশাল এক একটা লরি ভুঁই ফুঁড়ে উল্টো দিক থেকে ধেয়ে আসছে হুশহাশ। পাশ কাটানো রীতিমতো মিশন ইম্পসিবল সিনেমার স্টানবাজি। মুহূর্তের বেখেয়ালে কত কী ঘটে যেতে পারে, ভেবে সিঁটিয়ে বসে প্রমাদ গুনছি। আর যে গাড়ি চালাচ্ছে তার অবস্থা ঘেমে-নেয়ে একাকার।

মনোযোগ ঘুরিয়ে আনলাম চালকের দিকে। বেশ লাল্টু চেহারা। নাকের ডগায় ফোঁটা ফোঁটা ঘাম জমেছে। গড়িয়ে পড়ল বলে। ড্রাইভিং সিটের পাশে বসেছি। সাইড মিররে নাক বোঁচা একটা কালো মেয়ে দেখা যাচ্ছে। মনে মনে ক্রূর হাসি হাসলাম। বাংলাদেশের সমস্ত শ্যামলা-কালো মেয়েদের তরফ থেকে এক ফরসা, লাল্টু ছেলে বাগিয়ে মধুর প্রতিশোধ নিয়ে ফেলেছি। কালো মেয়েদের সাধ-আহ্লাদ নেই নাকি?

ভাজা পাঁপড়েরমতো মচমচে রোদ উঠেছে। পাহাড়ি পথ বেয়ে ড্রাইভ করে যাচ্ছি আমরা। রেন্ট-এ-কার থেকে সারা দিনেরজন্য গাড়ি নেওয়া হয়েছে। গাড়ি ভালোই। তবে রাস্তা ‘রোড টু হেল’। এমন ঘুর পথ বাপের জন্মে দেখিনি। এঁকেবেঁকে কোন তেপান্তরে যে মিশেছে, বলা মুশকিল।

আদিবা-আকরামরা অবশ্য দু’জনই ভীষণ সুশ্রী। একেবারে ব্রাহ্মণ লেভেলের ফরসা। খালি তাদের বাচ্চাটা হয়েছে জাপানি। তার চেহারা পুরোই হিরোশিমা-নাগাসাকি। তাকে যথেচ্ছ জাপানি পুতুল বলে খেপানো হয়। ব্যাপারটা সে দারুণ উপভোগও করে। বড় হয়ে আবার কোনোকনিচিয়াওয়া-আরিগাতোকে বিয়ে না করে ফেললে হয়। প্রবাসে প্রথম প্রজন্ম। ভবিষ্যৎ মতি গতি হলফ করে কিছুই বলা যায় না।

৯.

লোরো পার্ক নামটা শুনেই বেশ নড়ে চড়ে বসেছিলাম। কোথাও বেড়াতে গেলে লোকে বেশ পড়ে টড়ে নেয়, কোথায় কী আছে না আছে দেখার। অতিরিক্ত অলস হওয়ার কারণে এ সমস্ত হ্যাপায় যাই না। অন্ধের মতো বাকিদের পিছু পিছু হাঁটি। এটা এক ধরনের ফাঁকিবাজি। তবে কী মনে করে এবার কিছু পড়াশোনা করে এসেছি। পথে আসতে আসতে পানি-জুসের সঙ্গে সে বিদ্যা আবার গিলেও ফেলেছি। এমনকি লোরো পার্ক যে টেনেরিফের কোন মাথায়, সে জায়গারই বা নাম কী, কিছুই মনে পড়ছে না। সুতরাং, প্লাসে-মাইনাসে রসগোল্লা। তা ছাড়া, বিদ্যার একটা ভার আছে। সব ভুলে গিয়ে বেশ নির্ভার লাগছে। বেড়াতে এসে এত জ্ঞান পেটে নিয়ে ঘুরবোই বা কেন?

ডলফিনের ঝাঁক
লেখক

শুধু মনে আছে লোরো পার্ক একটা চিড়িয়াখানা টাইপ জায়গা। চিড়িয়াখানা বরাবরই ভালো লাগে। সারাক্ষণ মানুষ নামের দু’পেয়ে লেজকাটা চিড়িয়া দেখে দেখে একঘেয়েমি পেয়ে বসে। তখন রংবেরঙের লেজওয়ালা, শিংওয়ালা, পাখাওয়ালা নতুন চিড়িয়ার দেখা পেলে তাই মন্দ লাগে না। তবে লোরো পার্কের চিড়িয়ারা শুধু বসে বসে ঝিমায় না। এখানে তাদের নিয়ে নাকি অনেক রকম খেলা দেখানো হয়। একটা সার্কাস সার্কাস গন্ধ পেয়ে ছেলেমানুষি মনটা চনমনে হয়ে উঠল।

প্রথমেই আমরা পেঙ্গুইনের ডেরায় হানা দিলাম। মাঝারি আকারের পেঙ্গুইনগুলো কাচ ঘেরা বরফ রাজ্যের বাসিন্দা। কৌতূহলী হয়ে কাচে নাক ঠেকাতেইতাদের একজন ব্যস্ত পায়ে টলমল এগিয়ে এল। ভাব দেখে মনে হচ্ছে যেন অভিযোগ করছে, ‘এতক্ষণে আসার সময় হলো? সেই কখন থেকে টাক্সিডো চাপিয়ে বসে আছি। খালি বো টাইটা খুঁজে পাচ্ছি না। কই যে রাখলাম...’। বলেই আবার তেমনি ব্যস্ত ভঙ্গিতে বাকিদের কাছে ফিরে একটা মাছ খুঁজে নিয়ে হতাশ ভঙ্গিতে চিবোতে লাগল। এদিকে, এতগুলো টাক্সিডো-ম্যানের সাজগোজের টাই-ফিতা আমি কোত্থেকে জোগাড়দেব? তাই আস্তে করে সটকে এলাম।

১০.

ইঁদুর-বাদুড়, হাতি-ঘোড়া, বাঘ-ভালুক ইত্যাদি স্যান্ডার্ড চিড়িয়া দেখে-দুখে সি লায়নের বিশাল ছবিটার সামনে এসে দাঁড়ালাম এবং সেখানে ঢুকে পড়লাম। এত দিন ধারণা ছিল সিন্ধুঘোটকই বুঝি সি লায়ন। হাত-পা তেমন নেই। অলস। বুকে হেঁটে বেড়ায়। কিন্তু সে হিসেবে দেখা গেল। সি লায়নগুলো দুই ডানায় ভর দিয়ে রীতিমতো দাবড়ে বেড়াচ্ছে পুলের পাড়ে। মেজাজ খিঁচড়ে গেলে এক আধবার কান ফাটিয়ে চ্যাঁও ভ্যাঁও করে চ্যাঁচাচ্ছেও তাদের সঙ্গের মানুষ সঙ্গীদের উদ্দেশে।

তাঁরা সংখ্যায় পাঁচজন। একে একে নাম ডেকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো। একজনের নাম মা তারা। ভুল শুনলাম না তো? লোকটা বলেই চলল, ‘আর এই হলো লিসা, তার পাশে পেত্রা...’ ইত্যাদি। বাকিদের নাম লোকজনের হাততালিতে আর কানে এসে পৌঁছাতে পারল না।

খেলা শুরু। প্লাস্টিকের রিং ছুড়ে ছুড়ে মারা হচ্ছে। মা তারা তার দলবল নিয়ে ‘ব্যোম কালি’ জপে কাজে লেগে পড়ল। অসাধারণ ক্ষিপ্রতায় মাথা বাগিয়ে রিংগুলো পরে নিতে লাগল ঝটপট। তাদের গাঁদা ফুলের মালা পরা মন্ত্রী-মিনিস্টারদের মতো দেখাচ্ছে একদম। আমাদের ছানাগুলো খেলা দেখে মুগ্ধ হয়ে আনন্দে চিৎকার জুড়েছে। উত্তরে সি লায়নগুলোও হালকা মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন জানাল পেশাদারি কায়দায়।

লোরো পার্কের ডলফিনের কসরত
আদিবা আমাথ

এই সুযোগে বিশাল হোঁৎকা একজন, পালের গোদা হবে হয়তো, অতর্কিতে এক ধাক্কায় তার ট্রেনারকে পানিতে ফেলে দিল। বাকিদের সে কী হাততালি ফ্লিপার থাবড়ে! সঙ্গে আবার ‘এহে এহে এহে’ হেঁচকি তুলে বিচিত্র এক হাসি। মানুষ-চিড়িয়া জলে পড়ে গেছে, এই খুশিতে একটা উঁচু দরের তামাশা না করলেই নয়। শোরগোল ছাপিয়ে জোর ভলিউমে গান ছেড়ে দেওয়া হলো। সার্কাস চলতে থাকল গানের তালে।খেলা শুরু। প্লাস্টিকের রিং ছুড়ে ছুড়ে মারা হচ্ছে। মা তারা তার দলবল নিয়ে ‘ব্যোম কালি’ জপে কাজে লেগে পড়ল। অসাধারণ ক্ষিপ্রতায় মাথা বাগিয়ে রিংগুলো পরে নিতে লাগল ঝটপট। তাদের গাঁদা ফুলের মালা পরা মন্ত্রী-মিনিস্টারদের মতো দেখাচ্ছে একদম। আমাদের ছানাগুলো খেলা দেখে মুগ্ধ হয়ে আনন্দে চিৎকার জুড়েছে। উত্তরে সি লায়নগুলোও হালকা মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন জানাল পেশাদারি কায়দায়।

এই সুযোগে বিশাল হোঁৎকা একজন, পালের গোদা হবে হয়তো, অতর্কিতে এক ধাক্কায় তার ট্রেনারকে পানিতে ফেলে দিল। বাকিদের সে কী হাততালি ফ্লিপার থাবড়ে! সঙ্গে আবার ‘এহে এহে এহে’ হেঁচকি তুলে বিচিত্র এক হাসি। মানুষ-চিড়িয়া জলে পড়ে গেছে, এই খুশিতে একটা উঁচু দরের তামাশা না করলেই নয়। শোরগোল ছাপিয়ে জোর ভলিউমে গান ছেড়ে দেওয়া হলো। সার্কাস চলতে থাকল গানের তালে।

১১.

ডলফিনের আস্তানায় এসেছি। আট-নয়টার একটা ঝাঁক। তাদের মুখ হাসি হাসি। বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। বিশ-তিরিশ ফিট ওপরে দড়ি থেকে বল ঝোলানো। বাঁশির তীব্র এক ফুঁ ফোঁকা হলো। আর সঙ্গে সঙ্গে পানির ভেতর থেকে দারুণ দক্ষতায় উড়ে এল ডলফিনের পাল। জলের প্রাণীর উড়ে বেড়ানো যেন ছেলেখেলা। ধূসর মসৃণ ত্বকে রোদ খেলে গেল ঝিকমিকিয়ে। বলের গায়ে গুঁতো মেরে শূন্যে ঘূর্ণি তুলে ডিগবাজি খেয়ে আবার পানির নিচে হারিয়ে গেল।

শিষ্য সি লায়নের সঙ্গে তার গুরু
আদিবা আমাথ

পরের খেলা যথেষ্ট বিপজ্জনক। সাত-আট বছরের একটা ছেলেকে ডিঙিতে বসানো হলো। সেও কমলা লাইফ জ্যাকেটের ভেতর থেকে দর্শকের দিকে তাকিয়ে খুব এক চোট হাত নাড়ল। ভয় ডরের চিহ্নমাত্র নেই। একটা আলাপী চেহারার ডলফিন এগিয়ে এসে ডিঙির দড়ির লাটাইটা দাঁতে কামড়ে নিল। কিছু বুঝে ওঠার আগের পানিতে বুদ্‌বুদ তুলে সুতীব্র গতিতে ডিঙি টেনে এপার থেকে ওপারে নিয়ে যেতে থাকল। কিন্তু ওপারে না নিয়ে তো পানির নিচেও টেনে নিতে পারত। তখন তো একবারে পরপার অবধি পৌঁছে যেতে হতো। ভাবতেই ঘেমে গেলাম। কেন যেন মনে হলো, বিনোদন ব্যবসার কাছে বিপদ-আপদের সীমাগুলো ফিকে হয়ে যায় কখনো সখনো।

যা হোক, বাচ্চাটাকে আস্ত আর জ্যান্ত পৌঁছে দিয়ে ডলফিনটা গোটা দুই মাছ গিলে সন্তষ্টচিত্তে ফেরত গেল।

ঘুরপাক খেতে থাকা ছোট্ট আকারের আরেক ডলফিন শিষ্যকে ডেকে নিল তার মানুষ গুরু। তারপর তার মাথায় চড়ে দু’দিকে দুহাত ছড়িয়ে লোকটা সার্ফিং করার ভঙ্গিতে পুরোটা পুল এক পাক ঘুরে দেখাল। গতি, ভারসাম্য আর উত্তেজনার এ এক অদ্ভুত মিশেল। হাত তালি দিতে যাব, অমনি গুরু সমেত শিষ্য জলের অতলে ডুব! ক’টা বুদ্‌বুদ ভেসে উঠল খালি। তারপর একেবারে সব চুপ। আমার খানিক আগের আতঙ্ক সত্যি প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে নাকি। পুরো গ্যালারি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। পাঁচ-দশ সেকেন্ডকে অসীম অনাদিকাল মনে হচ্ছে। তারপর চোখে-মুখে অতল রাজ্য জয়ের হাসি নিয়ে লোকটা হঠাৎ ভুশ্ করে ভেসে উঠল ডলফিনের পিঠে আঁকড়ে। আর আমরাও ফোস করে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। যাক বাবা, চোখের সামনে কারও সলিলসমাধি দেখতে হলো না। (চলবে)

লেখক: রিম সাবরিনা জাহান সরকার, গবেষক, ইনস্টিটিউটঅব প্যাথোলজি, স্কুল অব মেডিসিন, টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি মিউনিখ, জার্মানি