সংবাদপত্র বিতরণকর্মী জিহাদের কথা

খালিজ টাইমস। এই পত্রিকা বিলি করেন জিহাদ
খালিজ টাইমস। এই পত্রিকা বিলি করেন জিহাদ

চা খেতে খেতে কথা শেষ হয় জিহাদ হোসেনের সঙ্গে। এবার তাঁর একটা ছবি তুলতে চাইলাম। তিনি এতে বিনীত আপত্তি জানালেন। এর পেছনের ঘটনাটা একটু অন্য রকম। সে জন্যই তাঁর ‘না’ বলা। একবার কেউ ক্যামেরায় বন্দী করে তাঁকে। সে ছবি চলে যায় ইন্টারনেটে। ছবি নয়, ছবির পরিবর্তিত রূপ ভাসে একটি সামাজিক মাধ্যমে। এতে বড় কষ্ট পান তিনি। যে এ কাজ করেছে, কী তার লাভ হয়েছে! তাঁকেই এই প্রশ্ন করি আমি। জিহাদ উত্তর যা দেন তাতে বুঝি, লাভ প্রয়োজন নেই। তাহলে কী? তাঁকে হেস্তনেস্ত করেই যেন মজা পায় তারা।
জিহাদ হোসেন নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। তিনি খালিজ টাইমস–এর বিতরণকর্মী। আবুধাবিতে আমি যে এলাকায় থাকি, সেখানে পত্রিকা বিলি করেন। মানুষ যখন গভীর নিদ্রায় মগ্ন, তখন দরজার সামনে তাঁরা পত্রিকা ফেলে যান। সুকান্তের রানার নতুন খবর নিয়ে যান সিলগালা ব্যাগে। তবে এদের খবর অনেকটা খোলা চিঠির মতোই। রানারদের হাতে থাকে ত্রিশূল। সেটা নিরাপত্তার জন্য। এ দেশে এদের সে ভয় নেই।
ভোরে যখন কোনো মা স্কুলের বাস ধরিয়ে দেন তাঁর সন্তানকে, সে সময় খবরের কাগজ তাঁর নজর কাড়ে। কিংবা অফিসে রওনা হওয়ার আগেই কোনো গৃহকর্তা তাঁর চোখের সামনে দেখতে পান পৃথিবীর সর্বশেষ খবর। এ খবর বইয়ে আনেন জিহাদ ও তাঁর মতো কর্মীরা।
সংবাদপত্রের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পেরে জিহাদের আছে অন্য রকম এক তৃপ্তি। গ্রাহকের কাছে তাজা খবরটি পৌঁছে দেওয়া একটা মহান ব্রত। এ কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন তিনি।
রাতে কাজ দিনে ঘুম, স্বাস্থ্যের জন্য সুবিধাজনক নয়—এ কথার পরই এ সংবাদকর্মী আবার বলেন, ভালো লাগে বেতনটা পাওয়ার পর। সত্যিই তা–ই, এরা তখন কাজ করতে উৎসাহ বোধ করেন। মা-বাবা বা স্বজনদের জন্য টাকা পাঠিয়ে তাঁদের অসীম শান্তি।
জিহাদ কাজ শেষে প্রতিদিন ব্যায়াম করেন। মুক্ত পথে হাঁটাকেই তিনি ব্যায়াম বলেছেন। ভোরের বাতাসে দেহ–মন দুটোই সতেজ হয়ে ওঠে, বললেন তিনি। বড় উপভোগ্য সে সময়টি। এ কথা তাঁরই।
কীভাবে তাঁর এই দেশে আসা, জানতে ইচ্ছে করে আমার। জিহাদের সহোদর চাকরি করেন খালিজ টাইমস-এর একই বিভাগে। ম্যানেজার তাঁর ওপর দায়িত্ব দেন একজন বিতরণকর্মী নেওয়ার। সেই সুবাদে জিহাদ পেয়ে যান খবরের কাগজ বিতরণের এই ভিসা।
বিতরণের সঙ্গে গ্রাহক সংগ্রহের কাজটি করেন বলেই হয়তো তাঁর বেতনটা ভালো। এই দেশে গড়পড়তা একজন নির্মাণকর্মী মাসে কত পান? এক হাজার কিংবা বারশ দিরহাম। জিহাদ পান তার তিনগুণ প্রায়। মনে হয় জিহাদ বেশ সুখী। সম্ভবত বেতনটা এর মূল কারণ।
জিহাদ হোসেনের জন্মস্থান বৃহত্তর সিলেটের বিয়ানীবাজার। সেখানে আট কক্ষের একটি বাড়ি আছে তাঁদের, জানান তিনি। এ বাড়ি তৈরিতে টাকার জোগান অবশ্য তাঁর একার নয়। এ নির্মাণ তাঁর বাবা, ভাই ও নিজের যৌথ উদ্যোগের ফসল। তাঁর বাবাও সৌদি আরবে চাকরি করে এসেছেন।
জিহাদ বিয়ের পরপরই চলে এসেছেন এখানে। তিন বছর পূরণ হয়েছে। সামনের মার্চ–এপ্রিলে দেশে যাবেন বেড়াতে। এখন নয় কেন? জিজ্ঞেস করেছিলাম। বলেন, গ্রাহক নবায়নের মৌসুম চলছে। বেশ দায়িত্ব যেন তাঁর কাঁধে। বাড়ি যাওয়ার সময় এখন নয়—এমনই মন্তব্য করলেন তিনি।
সাদাসিধে স্বভাবের মানুষ জিহাদ। সে কারণে মিলে যান মানুষের অনুভূতির সঙ্গে। এটাই তাঁর পুঁজি। এ জন্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে হয়তো পুরস্কৃত হন। যেমন দৈনিকটি বদলাতে চায় আমার পরিবার। সারা বছরই বদলায়। কিন্তু বছর শেষে নবায়ন হয় খালিজ টাইমস। এবারও তা–ই হয়। এটা হয়তো জিহাদেরই শক্তি।
নিরীহ একটি মানুষ। দুনিয়ার সবকিছু দেখেন। তবে কোনো কিছু বলার প্রয়োজন মনে করেন না। অন্তত আমার তা–ই মনে হলো। অথচ ছবি তুলে তাঁর সঙ্গে করা হয়েছে প্রতারণা। হায়রে মানুষ!
আলাপ শেষে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিই জিহাদকে।
নিমাই সরকার
আবুধাবি, সংযুক্ত আরব আমিরাত