সে আমার ছোট বোন

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

সুনিরের ঘুম ভেঙে গেছে অনেকক্ষণ আগে। চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে আর ভাবতে চেষ্টা করছে ভাইয়া থাকলে কী করত এখন। নিশ্চয়ই ওর রুমে এসে চেঁচামেচি করত, সুনির প্যান কেক বানা না। প্যান কেক খেতে ইচ্ছা হচ্ছে। ও আলসেমি করে বলত, আমি একা একা করতে পারব না। তুমি যদি হেল্প করো তাহলে করতে পারি।
আচ্ছা তাই করব। মা-বাবা তখনো ঘুমাচ্ছেন। দুই ভাইবোন ধুপধাপ সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসত কিচেনে। ভাইয়া কিন্তু তেমন বেশি কিছু করত না, কিন্তু মাতব্বরি ষোলো আনা। সুনির মাত্র বারোতে পা দিয়েছে। কিন্তু অনেক ছোটবেলা থেকেই ওর রান্নার শখ। আসলে শখটা ছিল ভাইয়ারও, ওর কাছ থেকেই পাওয়া। কিন্তু সুনির যখন আস্তে আস্তে এটা-সেটা রান্না করতে শুরু করল, ওর রান্নার সবচেয়ে বড় ভক্ত হয়ে গেল ভাইয়া। তবে মাতব্বরিটা পুরোপুরি ছিল নিজের হাতে। প্যান কেকের ব্যাটার বানানো হয়ে গেলে, ভাইয়া ভাজত। প্যানে তেল স্প্রে করে সুনির ব্যাটার ছড়িয়ে দিলে ভাইয়া বকা দিত, আরও পাতলা কর। আগুনের আঁচের ব্যাপারে ও ছিল খুব সাবধান। একদম ঠিক আঁচে, ঠিক সময় রেখে যে কোনো রান্না নামাবে। একটু এদিক-ওদিক হলেই আর খেতে চাইবে না। সুনিরের চকলেট সিরাপ পছন্দ, তার সঙ্গে হুইপ ক্রিম। ভাইয়ার রেগুলার মেপেল সিরাপ।

ওদের এই হইচইয়ের মাঝে কখন যেন মা নেমে আসত ফোলা চোখে। পেছন পেছন বাবাও। প্রতি মিনিটে ব্যস্ত থাকা মা কাজ না পেয়ে কেমন যেন বোকা বোকা চোখে এদিক-ওদিক ঘুরত। তার ৩৬৫ দিনের খাওয়া ওটমিল। কীভাবে যে এই অখাদ্যটা খায় মা কে জানে? চা বানানোটা সারা জীবন বাবার দায়িত্ব। দুকাপ চা নিয়ে এসে বসতেন টেবিলে। টেবিলে অকারণেই তর্কের ঝড় উঠত। তুচ্ছ কথায় হাসির রোল উঠত। ১৫ মিনিটে ভাইয়া পনেরো বার ওকে গাধা বলত। মা আর বাবা খাবেন না খাবেন না করেও ওদের প্যান কেকে ভাগ বসাত। সেটা নিয়েও এক দফা হইচই হতো। আর প্রতিবার বাবা বলতেন, এমন রান্না আমি জীবনেও খাই নাই, আমার মায়ের হাতের রান্নার মতো।
সুনির অনেকক্ষণ কান পেতে থাকে, যেন এখুনি শুনতে পাবে ভাইয়ার চিৎকার। না কোনো শব্দ নেই কোথাও। সারা বাড়িটা কী ভীষণ নিঃশব্দ। মার হয়তো ঘুম ভেঙে গেছে ঠিকই। হয়তো রুমে গেলে দেখবে বালিশে মুখ লুকিয়ে কাঁদছে। জোর করে চোখ খোলে সুনির। কিছুক্ষণ পরে বাস্কেট বল গেম আছে। আর শুয়ে থাকা যাবে না। চোখ খুলতেই দেয়ালে ওর আর ভাইয়ার ছবিটা দেখে ও আর কান্না আটকাতে পারল না। ছবিতে সুনির ভাইয়ার গালে চুমু খাচ্ছে। অনেক ছোটবেলার ছবি। ভাইয়া এখন কী করছে? বড় হয়ে ভাইয়া আর বেশি চুমু খেত না। বরং মাঝে মাঝেই চুল টেনে দিত। ও পরিপাটি করে চুল বাঁধার পরই ওর চুল ধরে টানতে হবে। ভাইয়া জানে ও অনেক খুঁতখুঁতে। কত দিন কেঁদে মার কাছে নালিশ করেছে। আশ্চর্য ব্যাপার হলো, ভাইয়া ওকে একদিন চুলে বেণি করে দিয়েছিল। মা পর্যন্ত ভীষণ অবাক, চুলে বেণি করা শিখলে কবে বাবা?
এটা কী এমন কঠিন কাজ? ঠোঁট উল্টেছিল ভাইয়া।

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

সুনির পায়ে-পায়ে সৌরভের ঘরে এসে ঢুকে। ঘরটা ঠিক তেমনই আছে। এলোমেলো বইয়ের পাহাড় টেবিলের ওপর। মেঝেতে কাপড়ের স্তূপ। বিছানার চাদরটাও এলোমেলো। ওদের মা ভীষণ টিপট। বিছানায় বসে কেউ উঠে গেলে সেটাকেও টান টান করে দেন। ভাইয়া মাকে খেপাত নিট ফ্রিক আর ক্লিন ফ্রিক বলে। সেই মা ভাইয়ার অগোছালো রুমটাকে একই রকম রেখে দিয়েছেন দেখে ভীষণ অবাক হয়েছিল সুনির। রুমটাতে পা দিয়ে কান্নাটা আবার ছিটকে পড়ে বুকের ভেতর থেকে। অসময়ে রুমে ঢোকার জন্য কত যে বকা খেয়েছে ভাইয়ার কাছে।
মেঝেতে একপাশে সৌরভের গিটারটা পড়ে আছে, অযত্নের ছাপ। ধুলার হালকা আস্তরণ জমেছে। যত্ন করে সেটাকে মুছে দেয় সুনির। ভাইয়ার খুব গানের ঝোঁক ছিল। অনেক দিন শখ করে গিটার শিখেছিল। এমনকি কিছুদিন পিয়ানো। সুর বুঝত খুব ভালো। সুনির ভায়োলিন বাজাতে গেলেই ওকে নিয়ে হাসত আর খেপাত, তোর তো সুরের কোনো সেন্স নেই। ও গান গাইতে গেলেও চেঁচাত, থামবি? এমন বেসুরো গান শোনা কানের ওপর অত্যাচার। দুঃখে চোখে পানি চলে আসত সুনিরের।
ভাইয়া চলে যাওয়ার পর বাড়িটা একদম নিষ্প্রাণ হয়ে গেছে। ওর সঙ্গে কেউ আর এখন রিমোট নিয়ে মারামারি করে না। সামারের লম্বা দিনগুলোতে যখন দুই ভাইবোন বাসায় একা থাকত, কত দিন ওকে টাইম আউট করে দিয়েছে ভাইয়া। সুনির টিভির পোকা, টাইম আউট মানেই ওর টিভি দেখা বন্ধ। অকারণেই এই শাস্তি। লাঞ্চ রেডি করতে দেরি হলো, তাই শাস্তি।
অথচ, ও ছিল ভাইয়ার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। চুপচাপ ভাইয়াটার বন্ধু হাতেগোনা। সুনিরের কাপড় যদি মার পছন্দ না হতো, ভাইয়া বলতো, আমরা একটা ক্রেজি ফ্যামিলিতে আছি, সেটা মনে রাখলেই সব ঠিক। মা আর বাবার ইংরেজি নিয়ে দুজনে কত যে মজা করত, কত হা–হা–হি–হি। ওর ব্রেস্ট ফ্রেন্ড এভা যেদিন ওর সঙ্গে স্কুলে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছিল, ভাইয়া ওকে কত বুঝিয়েছে কীভাবে মন খারাপ না করতে হয়। ওর সব সময় মনে হতো ভাইয়া ওকে এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি বোঝে। আর ও এটাও জানে সে ওর ভাইয়াকে সব চেয়ে বেশি জানে। ভাইয়া কেন সবার সঙ্গে কথা বলে মজা পায় না, ভাইয়া কী স্বপ্ন দেখে, কখন রাগ হয়ে যায় সব। আর ভাইয়াকে ওর পৃথিবীতে সবচেয়ে স্মার্ট মনে হয়। মাঝে মাঝে বন্ধুদের কাছে গল্প করে ফেলে এটা নিয়ে। কিন্তু ভাইয়া আবার এটা নিয়ে ভীষণ রাগ হতো।

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

গেমে যাওয়ার সময় ও চুপ করে ছিল। এমনিতে বাবার সঙ্গে সে অনেক বকবক করে। কিন্তু আজ কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। কাল মার জন্মদিন। গত বছর মার জন্মদিনের আগে ভাইয়াকে পটিয়ে পটিয়ে মলে নিয়ে গিয়েছিল। সে মাত্র নতুন লাইসেন্স পেয়েছে তখন। সেই গিফট পেয়ে মা যে কী খুশি হয়েছিলেন। এ রকম খুশি মাকে সে কখনো হতে দেখেনি, এমনকি বাবা গিফট দিলেও না। আজ সে কী করবে? বাবাকে নিয়ে দোকানে যাবে গেমের পর? ইচ্ছে করছে না একদম।
আরেকদিন রাতে ওর খুব আইসক্রিম খেতে ইচ্ছা করছিল। মা–বাবা টায়ার্ড। তারা সব শোয়ার কাপড় পরে ফেলেছেন। মাকে গিয়ে আইসক্রিমের কথা বলতেই এক ধমক দিলেন। ভাইয়ার কাছে একটু ঘ্যান ঘ্যান করতেই ভাইয়া রাজি, টাকাটা যদিও ওকেই জোগাড় করতে হয়েছে বাবার কাছ থেকে।
সুনির খুব খেলার পাগল, গেমে জিতলে ভীষণ খুশি হয়। আর বাবার তো খুশি ধরে না। আজ ওরা ভালো খেলেছে। সেও স্কোর করেছে। বাবা শুকনো মুখে বললেন, গুড জব মা, আলতো একটা হাগ। ও জানে ভাইয়া চলে যাওয়ার পর থেকে মা–বাবা কারওরই মন ভালো নেই। পুরো বাড়িটা কী আনন্দহীন। আজ দুই মাস হলো। সে জানে না, কত দিন লাগবে সব আগের মতো হতে।
বাড়িতে ঢুকেই মনে হলো বাতাসটা অন্য রকম। বসার ঘরটা মনে হয় হাসছে, ঝলমলে হাসি। আরে? হাসির শব্দ আসছে না কিচেন থেকে? মাকে একদম খুকি খুকি লাগছে। লাগবেই তো, ভাইয়া বসে আছে যে ওর সেই নবাবি স্টাইলে কিচেনের টেবিলটায়। মা কলকল করে বলছেন, পাগল ছেলে, মার জন্মদিন বলে চার ঘণ্টা ড্রাইভ করে চলে এসেছে একদিনের জন্য। পড়ালেখার কত ক্ষতি হবে না? মাত্র ইউনিভার্সিটি শুরু করল, পড়ার যা চাপ। বুড়ো বয়সে আবার কীসের জন্মদিন? মার কথায় কান না দিয়ে সুনির দৌড়ে ছুটে যায় ভাইয়ার কাছে। ভাইয়া ওকে জড়িয়ে না ধরে বেণিটা ধরে জোরে এক টান দেয়, কিরে হেরেছিস? এক দম গোহারা তাই না?