প্রাণে প্রাণে জাগিয়েছি সাড়া

প্রবাসীদের একাংশ
প্রবাসীদের একাংশ

গত বছর ফোনে আমার জন্মদিনের প্রথম প্রহরে নিজের কণ্ঠে গান শুনিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন এক শুভাকাঙ্ক্ষী। এখন তিনি কোথায় তা জানি না। আমার খুব ভালো বন্ধু তাবাসসুম। যে কোনো প্রয়োজনে তাকে পাশে পাই। ফেসবুকের লিও, তামিম ভাই, ইয়াসমিন আপা, রাজু, ইমরান ভাইসহ অনেককেই খুব কাছের মনে হয়। নিয়মিত যোগাযোগ হয় সবার সঙ্গে। আবার কিছু আপন মানুষ হারিয়ে গেছেন জীবন থেকে। স্বার্থের টানে ছিন্ন করেছে মায়ার বাঁধন। কিছু কাছের মানুষ পাড়ি জমিয়েছেন পরপারে। সমবয়সী এক ভাই কাদির দেশে গিয়ে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে আর বের হলো না। তার অপারেশন সাকসেসফুল হয়নি। সোহেল ছোট ভাই। ২০১০ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালের রাতে কৃষ্ণাঙ্গ সন্ত্রাসীরা খুন করল তাকে। হারিয়ে যাওয়াদের মিছিলটা আরও বড়। অনেক মিস করি হারিয়ে যাওয়া আপন মানুষগুলোকে।
জীবনের বাঁকে বাঁকে কত মানুষ আসে আবার কতজনে হারিয়ে যায় অজানায়। শুধু কিছু স্মৃতি রেখে যায় সযতনে। আমি শুধু আসা যাওয়ার মাঝখানের সাক্ষী হয়ে থাকি।

শশী-সমীরণের মতো শিশুদের সঙ্গে আমার সখ্য গড়ে উঠেছে। সমীরণ আস্তে আস্তে মিষ্টি করে কথা বলে। ভাইয়া বলে ডাকে আমাকে। শশী দারুণ কবিতা আবৃত্তি করে।
প্রবাসের এই লোকালয়ে প্রথম যেদিন ঢুকেছিলাম, সেদিন যে কুকুরটা হিংস্র মূর্তি ধারণ করে তেড়ে এসেছিল আমার দিকে সেই কুকুরের মালিক থামিয়েছিলেন কুকুরটাকে। এ বছর কুকুরটা আমার ভক্ত হয়ে গেছে। পায়ের সঙ্গে গা লাগিয়ে ঘষাঘষি করে। কিন্তু কুকুরের মালিক আমাকে আগের মতো পছন্দ করেন না। কারণ তাকে দোকানের পণ্য বাকিতে দিইনি। কুকুর একটা পশু। এরা হিংস্র হলে বড় জোর কামড় দেবে, আহত হব। কিন্তু মানুষ হিংস্র হলে সব পারে। বুকে ছুরিও দেয়।

ইস্টার্ন কেইপপ্রবাসী সরকার বাড়ির কয়েকজন
ইস্টার্ন কেইপপ্রবাসী সরকার বাড়ির কয়েকজন

আগের একটা ঘটনা বলি। প্রায় এক যুগ আগের ঘটনা। চাচাতো ভাই সমবয়সী সেলিম ও আমি—দুজন বন্ধু ছিলাম আমরা। একসঙ্গে গিয়েছিলাম সাইপ্রাসে। কিন্তু বেশি দিন সেখানে থাকতে পারিনি। দুই মাস পরেই রাস্তা থেকে একদিন দুজনকে একসঙ্গেই ধরে নিয়ে গেল গোয়েন্দারা। এগারো দিন নিকোশিয়ার সেন্ট্রাল প্রিজনে রেখে দুজনকেই দেশে পাঠিয়ে দিল। দেশে ফিরে আসতে হলো আমাদের। তারপর সেলিম একদিন আসল এ দেশে। আমিও আসলাম কয়েক বছর পর। সেলিম এ দেশে এখন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। আর আমি? শুধুই ব্যবসায়ী। নামমাত্র ব্যবসায়ীও বলা চলে।
আমি দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকি। পাহাড়ের পাদদেশে একটি লোকালয়ে আমার একটি ছোট দোকান আছে। কত মহাকাল ধরে রঙিন প্রজাপতি থেকে শুরু করে নিযুত জিন-পরি এই পাহাড়ের বুকে ছড়িয়েছিল ভালোবাসার গান। ছন্দে ছন্দে গেয়েছিল প্রেমের কবিতা। অথচ একই পাহাড়ে আমি আজ ভাগ্যের পরিহাসের নজরবন্দী। দুঃস্বপ্নের রাত্রে হারানো সাম্রাজ্যের রাজার মতো নিঃস্ব আর অসহায়ত্ব থেকে সান্ত্বনা নিয়ে জেগে থাকি নিষ্পলক। মনে হয় জনম জনম পার হয়ে যাচ্ছে তবুও এই পথের শেষ দেখি না। প্রতি রাতেই বিলীন হয়ে যাই অমাবস্যার নিকষ কালো অন্ধকারে।
যা হোক, জীবন শুধু দুঃখ আর হতাশা আর অপূর্ণতাই দেয়নি। এই জীবনে পাওয়ার তালিকাটাই বড়ই। মানুষের স্নেহ-ভালোবাসা পাই, কাছের মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্কও বজায় আছে। যা মানসিক প্রশান্তি দেয়। বিশেষ করে পরিবারে কোনো রকমের ঝুটঝামেলা নাই, টানাপোড়েন নাই। যা সবচেয়ে বড় পাওয়া। অল্পতেই তুষ্ট আমি। অনেক অনেক টাকাও মানুষের পরিবারে শান্তি আনে না।

লেখক
লেখক

তার ওপর এই বলে সান্ত্বনা পাই, দেশের জন্য, পরিবারের জন্য অন্তত কিছু করছি তো। ছোট ভাই মহসিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। ছোট বোন জিনিয়ার বিয়ে হলো কয়েক মাস আগে। মা-বাবার টেনশন দূর করতে পেরেছি। বাড়িতে আরও অনেক কিছুই করা বাকি এখনো! একদিন সব শেষ করব আশা রাখি।
আমরা প্রবাসে যারা থাকি তারা শুধু নিজের ও পরিবারের জন্যই ভাবি তা নয়। দেশের জন্যও আমাদের ভাবনার শেষ নেই। দেশে কী হলো তা নিয়মিত খোঁজ নিচ্ছি। খারাপ কিছু শুনলে হৃদয়টা ভেঙে পড়ে। ভালো খবরে কত গর্ব করি। ক্রিকেট খেলার সময় যেন আমরা একটা গ্যালারির দর্শক হয়ে যাই। কত টেনশন যে করি তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।
নারায়ণগঞ্জের কুড়েরপাড় গ্রামেরই আমরা কয়েক শ লোক এখানে দুটি শহরকে কেন্দ্র করে থাকি। সবার সঙ্গে সবার যোগাযোগ ও খোঁজখবর আছে। এর মধ্যে আমরা সরকার বাড়ির লোকই বেশি। বিদেশে থেকেও দেশের জন্য কিছু করার ইচ্ছা থেকেই আমরা সরকার বাড়ি ইউনাইটেড নামে একটা সংগঠন করেছি। সমাজের উন্নয়নের লক্ষ্যে শাহজাহান সরকার, জাহাঙ্গীর সরকার, ইসমাইল সরকার, সেলিম সরকার, মামুন সরকার, দ্বীন ইসলাম সরকার ও আলামিন সরকারের নেতৃত্বে একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। আপাতত আমরা বিশ লাখ টাকার ফান্ড তৈরি করে গ্রামের সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ নিয়েছি।
প্রাণে প্রাণে জাগিয়েছি সাড়া, যুদ্ধে জিতব রুখবে কে!