ঐতিহাসিক নানজিং

নানজিং স্মৃতি জাদুঘরে ভাস্কর্য
নানজিং স্মৃতি জাদুঘরে ভাস্কর্য

নানজিংয়েরও আছে আমাদের মতোই ইতিহাস। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে আমরা হারিয়েছি আমাদের ৩০ লাখ সন্তানকে, হারিয়েছি দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম। অন্যদিকে নানজিংয়ের যুদ্ধে চীন হারিয়েছে তাদের তিন লাখ তাজা প্রাণ আর প্রায় ২০ হাজার নারীর সম্ভ্রম। আপেক্ষিক দৃষ্টিতে সংখ্যার বিচারে নানজিং ম্যাসাকার কম ভয়াবহ মনে হলেও আসলে তা কোনো অংশেই কম ছিল না। ছয় সপ্তাহ স্থায়ী এই ম্যাসাকারে তিন লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। সময়ের বিচারে প্রতি ১২ সেকেন্ডে ঝরে যায় একেকটি প্রাণ।

আমার গুটিকয়েক শখের মধ্যে বেড়ানো অন্যতম। বেড়ানোর জায়গাটি যদি হয় ঐতিহাসিক কোনো স্থান তাহলে তা ভিন্নমাত্রা যোগ করতে বাধ্য। বেড়ানো তো হয়ই সঙ্গে পরিচয় হয় ইতিহাসের না জানা সব অধ্যায়ের সঙ্গে। অনেকটা রথ দেখা আর কলা বেচার মতোই! কিছুদিন আগে ঘুরে এলাম চীনের জিয়াংসু প্রদেশের রাজধানী ইতিহাস, ঐতিহ্য আর অপরূপ সুন্দরের সমন্বয় নানজিং।

নানজিং স্মৃতি জাদুঘরে ভাস্কর্য
নানজিং স্মৃতি জাদুঘরে ভাস্কর্য

চীনে আমার সব সময়ের বেড়ানোর সঙ্গী সাংহাইয়ে ডংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি শিক্ষার্থী তৌহিদ ভাই। এবারে নানজিং ভ্রমণে আরও যোগ হয়েছেন সাকেব ভাই ও সহকর্মী চিশতী ভাই ও রকি। আগের দিনই অনলাইনে দ্রুতগতির ট্রেনের টিকিট কেটে রেখেছিলেন তৌহিদ ভাই। সাংহাই রেলওয়ে স্টেশন থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হলো সকাল ৮টা ১০ মিনিটে। সাংহাই থেকে নানজিংয়ের দূরত্ব ৩০০ কিলোমিটারের মতো হলেও দ্রুতগতির ট্রেনে আমরা দুই ঘণ্টারও কম সময়ে পৌঁছে গেলাম নানজিং। সেখানে আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন নানজিংয়ে অধ্যয়নরত সানি ও জুনায়েদ। সবাই মিলে ঠিক করলাম প্রথমেই আমরা যাব নানজিং স্মৃতি জাদুঘর, যা ১৯৩৭ সালে ঘটে যাওয়া ইতিহাসের ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী হয়ে আছে।
জাদুঘরের সামনের ফটকে চোখে পড়ল অর্ধ বক্ষ উন্মোচিত বিশাল এক নারীর ভাস্কর্য। যে তাঁর মৃত বাচ্চাকে জড়িয়ে ধরে অসীম আকাশের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার পাশেই অনেকগুলো ছোট ছোট ভাস্কর্য, যা নানজিং ম্যাসাকারে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলিকে সুনিপুণভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। এর মধ্যে একটা ভাস্কর্যে এক মা মরে পড়ে আছেন; তাঁর ছোট বাবুটা মায়ের দুধ পান করছে আর বড় বাবুটা একটু দূরে বসে কাঁদছে। আহা, ইতিহাস এত নির্মম কেন!

মূল জাদুঘরে ঢোকার মুখে দেয়ালে বড় করে লেখা: ভিকটিম ৩০০০০০
মূল জাদুঘরে ঢোকার মুখে দেয়ালে বড় করে লেখা: ভিকটিম ৩০০০০০

মূল জাদুঘরে ঢোকার মুখে একটি দেয়ালে বড় করে লেখা: ভিকটিম ৩০০০০০। যেটা দেখে যেকোনো বাঙালির ১৯৭১ সালের ঘটনাপ্রবাহ মনে পড়তে বাধ্য। জাদুঘরের ভেতরে আরও কয়েকটা জায়গায় লেখা আছে একই কথা; দেখলেই বুকের ভেতর কোথাও গভীরে গিয়ে লাগে! আমরা ভেতরের দিকে এগিয়ে গেলাম। বিশাল এক কালো দেয়ালে আত্মদানকারী শহীদদের নামের তালিকা টানানো। নানজিং ম্যাসাকারে নিহতদের কয়েকটি গণকবর তুলে এনে স্থাপন করা হয়েছে নানজিং জাদুঘরে। আর জায়গায় জায়গায় ছোট-বড় ফলকে খণ্ড খণ্ড করে সে সময়কার কথা লিখে রাখা হয়েছে। আমরা যখন ফলকগুলোর ছবি তুলে নিয়ে সামনে এগোতে যাচ্ছিলাম, সাকেব ভাই বারবার আটকে যাচ্ছিলেন। আমেরিকান একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সাকেব ভাই ঘটনাক্রমে আজ জাপানের নাগরিক। ফলকে লেখা জাপানিজদের অত্যাচারের ইতিহাস হয়তো ওনাকে বড় বেশি স্পর্শ করছিল কিংবা করেনি!
নানজিং ম্যাসাকারে যা ঘটেছিল তা এ রকম: ৭ জুলাই, ১৯৩৭ ইং জাপান তাদের পূর্ণ আগ্রাসন শুরু করে চীনে। যার ফলে একই বছরের ১৩ আগস্ট তারা আক্রমণ চালায় সাংহাইয়ে। সাংহাই আক্রমণকে মনে করা হয় নানজিং

লেখক ও তার ভ্রমণসঙ্গীরা
লেখক ও তার ভ্রমণসঙ্গীরা

আক্রমণের প্রথম ধাপ। ১২ নভেম্বর সাংহাই জাপানি বাহিনীর আয়ত্তে চলে এলে তারা তিন দিক থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে নানজিংয়ের ওপর। ১৩ ডিসেম্বর নানজিং তাদের দখলে চলে এলে তারা আন্তর্জাতিক সব নিয়ম ভঙ্গ করে চীনা বাহিনী আর নিরস্ত্র জনগণের ওপর চালায় নির্মম হত্যাযজ্ঞ। যা ইতিহাসে নানজিং ম্যাসাকার নামে পরিচিত। ছয় সপ্তাহব্যাপী চলমান নানজিং ম্যাসাকারে প্রাণ হারায় তিন লাখ মানুষ, ধসে পড়ে শহরের এক-তৃতীয়াংশ ভবন; আর ধর্ষণের শিকার হয় ২০ হাজার নারী।
জাদুঘর থেকে যখন বেরিয়ে এলাম তখন সূর্য ঠিক আমাদের মাথার ওপর। পরবর্তী গন্তব্য সানিয়াত সেনের মেমোরিয়াল। কিন্তু ততক্ষণে সবার পেট জানান দেওয়া শুরু করেছে সামনে এগোনোর জন্য জ্বালানির প্রয়োজন। সবাই যখন খাবারের পরিকল্পনা করছে তখন আমার মাথায় শুধু জাদুঘরের ভেতর দেখা জন রেবের* একটা লাইনই ঘুরপাক খাচ্ছে, ‘ফরগিভেবল বাট আনফরগেটেবল’। জন রেব সত্যিই বলেছেন এত মৃত্যু, এত কান্না, এত রক্ত ভুলে যাওয়া অসম্ভব।
*জন রেব (John Rabe), নানজিং নিরাপত্তা জোনের আন্তর্জাতিক কমিটির চেয়ারম্যান।