নাট্যকার মাসুম রেজার সঙ্গে আড্ডা

আড্ডায় অতিথিরা
আড্ডায় অতিথিরা
বক্তব্য দিচ্ছেন মাসুম রেজা
বক্তব্য দিচ্ছেন মাসুম রেজা

টেলিভিশনে এখন আর নাটক দেখা যায় না, বিজ্ঞাপন দেখতে হয় কিংবা এখনকার টিভি নাটক এখন আর তেমন দর্শক টানতে পারে না—কথাগুলোকে ঠিক তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলেন না নাট্যকার মাসুম রেজা। বরং নিজের নাটকের অভিজ্ঞতার বয়ানে যেন খানিকটা তুলনামূলক চিত্রই তুলে ধরলেন। সেই তুলনায় নাটক, টেলিভিশন নাটকের একাল-সেকালটাই যেন আরও বেশি পরিস্ফুট হয়ে উঠল।
তাঁর রঙের মানুষ নাটকের ব্যাপ্তি ১৯ মিনিট। টাইটেল মিলিয়ে ২১ মিনিট। আর নাটকটি যখন প্রচারিত হয়, তাতে বিজ্ঞাপন ছিল ২৯ বা ৩১ মিনিট। তবু দর্শক বিরক্ত হননি, নাটকটি দর্শকদের টেনে ধরে রাখতে পেরেছে। কীভাবে সম্ভব হলো? প্রশ্নটা ছুড়ে দিয়েই ক্ষান্ত হননি তিনি। বর্তমানের নাটক ও নাট্যকাররা যে এই দায়ভাগ এড়াতে পারেন না, সে কথাও অবলীলায় বলে ফেলেছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার বিজয়ী নাট্যকার মাসুম রেজা।
বন্ধু, সুহৃদ আর ভক্তদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ আড্ডায় ঢাকার মঞ্চ ও টেলিভিশন নাটকের একাল সেকালসহ নিজের নাট্যকার হওয়া নিয়ে টরন্টোতে প্রাণবন্ত এক আড্ডায় মেতে উঠেছিলেন লন্ডনে স্থায়ী আবাস গড়া মাসুম রেজা। ১৭ জুলাই রোববার টরন্টোর বাংলাদেশ সেন্টারে অনুষ্ঠিত এই আড্ডায় শহরের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিশিষ্টজনরা এসে হাজির হয়েছিলেন।

বক্তব্য দিচ্ছেন শওগাত আলী সাগর
বক্তব্য দিচ্ছেন শওগাত আলী সাগর

নাট্যকর্মী শারমীন শর্মীর সঞ্চালনায় এই আড্ডায় বাংলাদেশের খ্যাতিমান অভিনেত্রী আফরোজা বানুও বক্তব্য রাখেন। আড্ডায় অংশ নিতে আসা সুধীজন মাসুম রেজার নাটক ও নাট্যজীবনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করেন। অনেকেই তাঁর সঙ্গে কাজ করার ক্ষেত্রে নিজেদের অভিজ্ঞতাও তুলে ধরেন। মাসুম রেজা খোলামেলাভাবে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন ও নাটক নিয়ে নিজের ভাবনা তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে টরন্টোতে বসবাসরত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীরা এসে তাঁকে পৃথকভাবে শুভেচ্ছা জানান।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুশীলন নাট্যচক্রের মাধ্যমে মঞ্চ নাটকে যুক্ত হওয়া মাসুম রেজা পড়াশোনার পাট শেষে ঢাকায় এসে দেশ নাটক নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। বিরস কাব্য, নিত্য পুরান, আরজচরিত, জলবালিকার মতো মঞ্চ সফল নাটকের নাট্যকার মাসুম রেজা ১৯৯৬ সালে টেলিভিশনের জন্য নাটকে হাত দেন। কৈতর দিয়ে শুরুর পর শতাধিক নাটক তিনি লিখেছেন টেলিভিশনের জন্য। রঙের মানুষ, ভবের হাট এখনো নাট্য বোদ্ধাদের কাছে বিস্ময়কর সৃষ্টি হিসেবে বিবেচিত হয়। টিভি নাটকের অন্যতম মেধাবী নাট্যকার মাসুম রেজা নাটকে অত্যন্ত সম্মানজনক বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন।
নাটকের মানুষ মাসুম রেজা কি কেবল নাট্য রচনায় নিজেকে মগ্ন রাখেন? সে কথা বলার বোধ হয় সুযোগ নেই। কবিতা দিয়ে সাদা কাগজে আঁকিঝুকি করা মাসুম রেজা নাটকে নিজেকে বিলিয়ে দিলেও দু দুটো উপন্যাসও লিখে ফেলেছেন এরই মধ্যে। সুতরাং তিনি ঔপন্যাসিকও। কিন্তু মাসুম রেজার মূল সত্তা আসলে তিনি নাট্যকার। হ‌ুমায়ূন আহমদের জীবদ্দশায় টিভি নাটকে তাঁর একচ্ছত্র রাজত্বকালেও একজন মাসুম রেজা যখন দর্শকনন্দিত নাট্যকার হিসেবে মাথা উঁচু করে টিকে যান, তখন তার শক্তিকে কুর্নিশ করতে হয় বৈকি।

মাসুম রেজাকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীরা
মাসুম রেজাকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীরা

প্রবাস জীবন কি তাঁর সৃষ্টিশীলতার জন বাঁধা কিছু? মাসুম রেজার জন্য বোধ হয় সে কথা বলার সুযোগ নেই। বরং সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারের বিলেতেও তাঁকে প্রচণ্ডভাবে ছুঁয়ে দেয় বাংলাদেশ। নইলে শাহবাগের উত্তাল জোয়ারের ঢেউ সুদূর লন্ডনেও তাকে এভাবে আলোড়িত করবে কেন? আর সেই আলোড়নে স্ত্রী সেলিনা শেলী লিখে ফেলেন নাটক, সেটিকে ইংরেজিতে ভাষান্তর করেন তাদের দুই কন্যা, আর শেলি-মাসুম রেজা লন্ডনেই গড়ে তোলেন থিয়েটার ফোকস নামের নাট্য সংগঠন। পশ্চিমের ভিন্ন সংস্কৃতিতে সেই থিয়েটার ফোকস নিয়েই ভিন্ন রকমের এক নাট্য আন্দোলনে সক্রিয় আছেন মাসুম রেজা পরিবার।
মাসুম রেজা বাংলা একাডেমির পুরস্কার পাওয়ার আগের টানা ১০ বছর নাটকে কাউকেই পুরস্কার দেয়নি বাংলা একাডেমি। পুরস্কারটি ছিল, অথচ কাউকেই দেওয়া হয়নি। কেন দেওয়া হয়নি এই প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই হয়তো মাসুম রেজার মেধা ও শক্তিমত্তার পরিচয় পাওয়া যায়।

ছবি: সোলায়মান তালুত