চীনে চিকিৎসা ও প্রকৌশল শিক্ষা

চায়না থ্রি গরজেস ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা
চায়না থ্রি গরজেস ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা

প্রত্যেক লেখকের লেখার অনুপ্রেরণা আর ইচ্ছা দ্বিগুণ হয়ে যায় যখন কেউ তার লেখা পড়ে বলেন, আপনার লেখা পড়ে আমার অনেক উপকার হয়েছে, আপনি লেখালেখি চালিয়ে যান। তবে আমি কোনো লেখক নই কিংবা পেশাদার লেখক হওয়ার ইচ্ছাও নেই। আমি চিকিৎসাবিজ্ঞানের ছাত্র আর আমার কাজ হাসপাতালের চার দেয়ালের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। লেখালেখির জগৎটা অনেক বেশি সর্বজনীন আর বিস্তৃত। তাই লিখতে বসলেই হাত কাঁপে, কিন্তু আজকে যে বিষয় নিয়ে লিখতে বসেছি সেটা নিয়ে লেখা আমার কর্তব্য।

আমি চীন দেশে আছি প্রায় চার বছর। এই চার বছরে চীন আর এখানকার মানুষদের অনেক কাছ থেকে দেখেছি। তাদের জীবনযাপনের সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে নিয়েছি। এখন যারা উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে চীনে পড়ালেখা করতে ইচ্ছুক তাদের জন্যই লিখতে বসেছি। বলা চলে বাধ্য হয়েই লিখতে বসেছি। কারণ গত এক বছর ধরে অসংখ্য মেইল আর ফেসবুক মেসেজের উত্তর দিতে দিতে আমি ক্লান্ত।

লেখক
লেখক

চীনে পড়ালেখার ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করার আগে এবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় যারা পাস করেছেন তাদের সবাইকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। অন্য অনেকের মতো আমিও বলছি ‘জিপিএ-৫ জীবন নির্ধারণ করে না কিংবা করবেও না’। জিপিএ-৫-এর দরকার আছে কিন্তু জিপিএ-৫ না পেলেই যে খারাপ শিক্ষার্থী সেটা সঠিক নয়। সুতরাং ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আপনার যা আছে তা নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়ুন। বিশ্ববিদ্যালয়-মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষাটায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এক-দুই ঘণ্টা সময় একজনের জীবন পরিবর্তন করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
তারপরও কথা থেকে যায়। যারা কোথাও সুযোগ পেলেন না তারা কি খারাপ? কিংবা তাদের ভবিষ্যৎ কি? আমি নিজেই সেই ছাত্র যে মেডিকেলে দুবার ভর্তি পরীক্ষা দিয়েও পাস করতে পারিনি কিংবা কিছু অর্থলোভীর কাছে হেরে গেছি, যারা টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন বিক্রি করে। তাই বলে কি আমি থমকে গেছি? না আমি থামিনি কিংবা থামবও না ইনশা আল্লাহ। এবার আসা যাক আজকের লেখার প্রধান আলোচ্য বিষয়ে।
চীনে প্রায় ১ হাজার ১০০ বিশ্ববিদ্যালয় আছে। যার বেশির ভাগই বিশ্বমানের। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সব বিশ্ববিদ্যালয়ই বিদেশি শিক্ষার্থী পড়ায় না। আবার এমনও বিশ্ববিদ্যালয় আছে যেখানে বিদেশি শিক্ষার্থী পড়ানো হয়। কিন্তু বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা চাইলেই পড়তে পারেন না। চীনে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা যদি এমবিবিএস পড়তে চান তবে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) থেকে একটা সম্মতিপত্র নিতে হবে এবং শুধুমাত্র বিএমডিসির অনুমোদিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনা করলেই সেটা বৈধ বলে গণ্য হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই তালিকাটা প্রতি বছর হালনাগাদ করা হয়।
অবশ্য ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এসব ঝামেলা নাই। যে কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন করলেই হবে। মেডিকেলের শিক্ষার্থীরা চীনে পড়ালেখা শেষ করার পর বাংলাদেশ এসে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের অধীনে একটা পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে। MCQ পদ্ধতির এই পরীক্ষার পূর্ণমান ১০০। পাস মার্কস ৬০। সময় এক ঘণ্টা ৪০ মিনিট। প্রতিটি প্রশ্নের মান ১, কিন্তু ভুল উত্তরের জন্য ০.২৫ করে কেটে নেওয়া হয়। এই পরীক্ষায় Pre-clinical বিষয় থেকে ১০টি, Paraclinical বিষয় থেকে ২০টি ও Clinical বিষয় থেকে ৭০টি প্রশ্ন করা হয়। ছয় মাস অন্তর অন্তর এই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা যায়। এই পরীক্ষায় পাস করলেই মিলবে বাংলাদেশে ইন্টার্নি, ডাক্তারি করা, বিসিএসে অংশগ্রহণ করার সুযোগ ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা। আর ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এমন কোনো ঝামেলা নেই। তারা পড়াশোনা শেষ করে সরাসরি বাংলাদেশে কিংবা পৃথিবীর যে কোনো দেশে চাকরি করতে পারবেন।
চীনে পড়ালেখার জন্য আবেদন করা খুবই সহজ যদি আপনি সঠিক মানুষ কিংবা সঠিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আবেদন করতে পারেন। তা ছাড়া আপনাকে পড়তে বিরাট ঝামেলায়। কারণ ব্যাঙের ছাতার মতো গজে ওঠা অসংখ্য প্রতিষ্ঠান নিমেষেই আপনার স্বপ্ন আর আপনার বাবার কষ্টের জমানো টাকা দুটাই ধূলিসাৎ করে দেবে। চীনে এমবিবিএস কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য বিশেষ কোনো ইংরেজি ডিগ্রি যেমন-IELTS, TOFE ইত্যাদির দরকার হয় না। চীনের এমবিবিএসের খরচ বাংলাদেশের বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর মতোই। পাঁচ বছরে খাওয়াদাওয়া ও অন্যান্য সব খরচ মিলিয়ে এমবিবিএস শেষ করতে প্রায় ২৫-৩০ লাখ টাকার দরকার হয়। তবে একটা সুবিধা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে সব টাকা একসঙ্গে দিতে হয় না। প্রতিবছরের টিউশন ফি দুই কিস্তিতে ছয় মাস অন্তর অন্তর দেওয়া যায়।
আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাকে প্রতি বছর ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হয়। আমি সব সময় দুই কিস্তিতে পরিশোধ করি। ফলে আমার বাবার ওপর তেমন চাপ পড়ে না। কিন্তু বাংলাদেশের বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে ভর্তির প্রথমেই ডোনেশান ফি-এর নামে প্রায় ২০-২৫ লাখ টাকা দিয়ে দিতে হয়। আর প্রতি মাসে ১০-১৫ হাজার টাকা করে বেতন তো রয়েছেই। সঙ্গে কার্ড, টার্ম ও প্রফসহ বিভিন্ন পরীক্ষার ফিও দিতে হয়। চীনে এমবিবিএস পড়ার আরেকটি সুবিধা হচ্ছে উন্নত ল্যাব আর বিশ্বমানের উন্নত প্রযুক্তিসম্পন্ন হাসপাতালে অনুশীলন (প্র্যাকটিস) করার সুবিধা। এখানে এমডিও (Doctor of medicine) করা যায়। প্রতি বছর এমডি করার জন্যও অনেক শিক্ষার্থী চীনে আসেন। তবে এমডি করার জন্য অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপ পাওয়া যায়। অর্থাৎ বিনা খরচে পড়া যায়।
এবার কিছু অসুবিধার কথা বলি। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের বিদেশি শিক্ষক দেওয়া হয় না। চীনা শিক্ষকেরাই পাঠদান করেন। এতে করে কিছুটা অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। কারণ চীনারা ইংরেজিতে খুবই দুর্বল। অবশ্য চীনা শিক্ষকদের মধ্যেও কিছু ভালো ইংরেজি জানা শিক্ষক আছেন যারা খুব সুন্দর ও সাবলীলভাবে ইংরেজি বলতে পারেন। তবে চিন্তার কিছু নেই, দ্বিতীয় বর্ষ থেকেই বিদেশি শিক্ষকেরা ক্লাস নেওয়া শুরু করেন।
এবার আসি ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষা প্রসঙ্গে। চীনে অনেক ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ও বিদেশি শিক্ষার্থীদের বৃত্তি (স্কলারশিপ) প্রদান করে। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় তো টিউশন ও হোস্টেল দুটিই বিনা মূল্যে দেয়। যার ফলে চীনে এখন এমবিবিএসের চেয়ে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থী বেশি আসছেন। তবে একেক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কলারশিপের নিয়ম একেক রকম। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্পূর্ণ টিউশন ফি ফ্রি, কোনোটাতে হোস্টেল ফি ফ্রি আবার কোনোটিতে টিউশন ফির অর্ধেক ফ্রি। আর বিশ্ববিদ্যালয় অনুযায়ী নিয়ম কানুন ও স্কলারশিপের শর্ত ভিন্ন ভিন্ন। তবে বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিটা বিষয়ে ৬০ মার্কস পেলেই স্কলারশিপ পরবর্তী এক বছরের জন্য বহাল থাকে। আর কোনো একটা বিষয়ে ৬০ মার্কস পেতে ব্যর্থ করে হলে পরবর্তী এক বছরের জন্য স্কলারশিপ বাতিল হয়ে যাবে এবং এক বছরের জন্য টিউশন ফি পরিশোধ করতে হয়। এক বছরের টিউশন ফি এক থেকে দেড় লাখ টাকা। ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার্থীরা চতুর্থ বর্ষে গিয়ে চীনের বিখ্যাত কোম্পানিতে ইন্টার্নি করার সুযোগ পান। অবশ্য সবাই সেটা পান না। গ্র্যাজুয়েশনের পরে চীনের বিভিন্ন কোম্পানিতে চাকরি করারও সুযোগ থাকে।
এবার কিছু মৌলিক সুযোগ-সুবিধার কথা বলা যাক। প্রতি মাসে খাওয়া বাবদ ৫-৬ হাজার টাকা খরচ হয়। তবে ভালো ও উন্নত শহরগুলোতে আরও বেশি খরচ হয়। সম্পূর্ণ রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস। সম্পূর্ণ সেশনজট মুক্ত পড়াশোনা। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে চার বছর ও এমবিবিএসে পাঁচ বছরের মধ্যেই গ্র্যাজুয়েশন। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্রি ওয়াই-ফাই সুবিধা। সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়েই রয়েছে হাজার হাজার দেশি-বিদেশি বইসমৃদ্ধ সুবিশাল লাইব্রেরি।
আরেকটা বিষয়, চীনে আসার আগ পর্যন্ত সবাই চীনা ভাষাকে বেশ কঠিন ও আয়ত্ত করা অসম্ভব মনে করেন। কিন্তু যথাযথ অধ্যয়নে চীনা ভাষা আয়ত্ত করা সম্ভব। আর হ্যাঁ, চীনে বিদেশি শিক্ষার্থীদের সম্পূর্ণ ইংরেজি মাধ্যমে পাঠদান করা হয়। সুতরাং চীনা ভাষা নিয়ে ভয়ের কিছু নেই। সবাইকে আবারও শুভকামনা জানিয়ে আজকের মতো শেষ করছি। ধন্যবাদ সবাইকে।

(বেলাল তামজীদ, চায়না থ্রি গরজেস ইউনিভার্সিটি, ইছাং, হুবেই, চীন। ইমেইল: <mailto: [email protected]>, ফেসবুক: Facebook.com/belal. tamjeed)