আটচল্লিশ ঘণ্টা

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

এ বছর গ্রীষ্মের ছুটিতে দেশে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। ভেবেছিলাম চীনেই একটু ঘুরব। প্রবাস জীবন বছর তিনেকের বেশি হয়ে গেলেও খুব একটা ঘুরে দেখা হয়নি চীন। কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে ঘোরার একটা পরিকল্পনাও করেছিলাম।
কিন্তু বিধি বাম। হঠাৎ​ ভাইয়া ফোন করে বললেন, আব্বু বেশ অসুস্থ, যত তাড়াতাড়ি চলে আসতে দেশে। আমি পরদিনই দেশে চলে যাই। কানেকটিং ফ্লাইট ছিল গুয়াংজু থেকে। হোটেলে একা শুয়ে আছি। রাত কোনোমতে কাটে না, যেন শেষ হওয়ার নয়। ওই রাতটি ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে দীর্ঘ রাত। সেদিন বুঝেছিলাম প্রতীক্ষার প্রহরগুলো কেমন দীর্ঘ হয়, কেমন কষ্টের। মাথার মধ্যে খেলছিল আব্বুকে কী বেঁচে থাকা অবস্থায় দেখব। অবশেষে সকাল হয়। হোটেল থেকে হালকা নাশতা সেরে বিমানবন্দরে যাই। সেখান থেকে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা। ঠিক সময়েই পৌঁছাই। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম তাৎক্ষণিক ফ্লাইট না পেয়ে মালিবাগে এলাম। ওখানেও বাস ছিল না। প্রায় দুই ঘণ্টা অপেক্ষার পর বাস ছাড়ে। কিন্তু পথ যেন ফুরোয় না, বাস চলছে তো চলছেই। প্রায় ঘণ্টা আটেক পর চট্টগ্রাম পৌঁছাই। দামপাড়া থেকে সোজা হাসপাতালে গেলাম। যেখানে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছিলেন আব্বু। গিয়ে আব্বুকে হাসপাতালের বেডে চিনতে কষ্ট হচ্ছিল। এত বেশি শুকিয়ে গেছেন। ডাক্তার শেষ স্টেজের পাকস্থলীর ক্যানসার ডায়াগনোসিস করেছেন। যদিও বা অনেক দেরিতে, তখন চিকিৎসার আর কোনো সুযোগই বলতে গেলে ছিল না।

কিছু সাপোর্টিভ চিকিৎসার পর আব্বু অল্প অল্প করে সেরে ওঠেন। সপ্তাহখানেক পর রিলিজ দিয়ে দিলে বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর অবস্থা মোটামুটি অপরিবর্তিত। এর মাঝে আমি দেশ থেকে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেই। ক্লাসও শুরু হয়ে যাচ্ছিল। গত ২৯ তারিখ ঢাকা হয়ে ফিরে আসি।
আমি আসার আগের সপ্তাহ থেকে আব্বুর হঠাৎ​ করে ডায়রিয়া শুরু হয়। ডাক্তারের পরামর্শে কিছু স্যালাইন আর অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়। আমি যেদিন আসি আব্বুর তখন রক্তচাপ ওঠানামা করছিল।
৩০ তারিখ রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ ছোট বোনের সঙ্গে চ্যাট হয়। সে জানায় স্যালাইন চলছে। কিন্তু মুখে কিছু খেতে পারছেন না আব্বু। এরপর আমি বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মেতে উঠি। মোবাইল ফোন রুমে চার্জে রাখা ছিল। আড্ডা নানান দিকে ঘুরপাক খায়। সবাই ভ্যাকেশনের নানা মজার কথা শেয়ার করতে থাকি অনেক রাত পর্যন্ত। রাত দুটো পর্যন্ত আড্ডা চলে। আমি চলে আসার পরও বন্ধুদের আড্ডা চলছিল।
রুমে এসে ফোনে বেশ কিছু কল দেখি। দেশ থেকে আসা। হঠাৎ​ অজানা আতঙ্ক ভর করে বুকে। কাঁপুনি বেড়ে যাচ্ছিল। এত রাতে সাধারণত দেশ থেকে কল আসে না। বেশ কজনকে কল দেওয়ার পর রিসিভ করে। ওপাশ থেকে আমি যা শুনি তার জন্য আমি একদম প্রস্তুত ছিলাম না। আমি ক্ষণিকের মধ্যেই কেন জানি পাথরের মতো হয়ে যাই।
মাত্র আটচল্লিশ ঘণ্টার ব্যবধান। এর মধ্যেই সব লন্ডভন্ড হয়ে গেল। একটি অসময়োচিত সিদ্ধান্তের কারণে আমি আব্বুকে অন্তিম বিদায় জানাতে পারলাম না। আসলে আমরা কেউই কল্পনা করিনি আব্বু এত তাড়াতাড়ি না ফেরার দেশে চলে যাবেন।
যেদিন আসছিলাম আব্বু বলছিলেন, আমাকে আর দেখবি না শেষ দেখা দেখে নে, তোকে আল্লাহর আমানত করে গেলাম, কাঁদিস না, তোকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল, দেখে যেতে পারলাম না! আমি কাঁদতে কাঁদতে আব্বুকে বিদায় জানাই। তখন ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করিনি আব্বু আর মাত্র আটচল্লিশ ঘণ্টা আছেন।
আব্বুর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। আব্বুর ধী শক্তি অনেক বেশি প্রখর ছিল। যে কোনো কিছু খুব সহজে মনে রাখতে পারতেন। তিরিশ-চল্লিশ বছর আগের ঘটনাও একদম অনায়াসে বলে দিতে পারতেন। সবার জন্ম মৃত্যু দিন খুব যত্ন করে মনে রাখতেন। তবে ওনার সবচে বড় গুন ছিল, মানুষকে অসম্ভব বেশি ভালোবাসতেন, অনেক সহজে আপন করে নিতে পারতেন। অনেক বেশি জনদরদি ছিলেন। নিজে না খেয়ে অন্যকে খাওয়াতেন, নিজের সাধ্যমতো সব সময় অন্যের বিপদে এগিয়ে আসতেন। সব সময় বলতেন, ইবাদতকারীর ওপরে দানশীলের স্থান, কখনো এক টাকা উপার্জন করতে পারলে নিজে পঞ্চাশ পয়সা রেখে আর বাকি পঞ্চাশ পয়সা দান করবি।
আব্বু চলে গেলেন তার মতো করে, কাউকে কষ্ট না দিয়ে, কারও মুখাপেক্ষী না হয়ে। আম্মু বলছিলেন, আব্বুর জন্য পাড়া প্রতিবেশী থেকে ফকির মিসকিন পর্যন্ত কাঁদছে। জানাজার নামাজে বৃহৎ​ জনসমাগম হয়েছে। আর আমি তিন হাজার মাইল দূরে আকাশপানে তাকিয়ে তাকিয়ে সময় কাটাই। পরবাসী জীবন এমনই!
আব্বুর স্বপ্ন ছিল আমি ডাক্তার হয়ে এলাকার মানুষের সেবা করব। আব্বু নেই কিন্তু তার স্বপ্নের বুনে দেওয়া বীজ বুকে নিয়ে আমার পথচলা। আব্বু, তোমার জন্য কিছু করতে পারিনি, তোমার স্বপ্ন পূরণ করতে চাই। আমার এলাকায় একটা চেম্বার হবে। তোমার গরিব দুঃখী বন্ধুরা সেখানে আসবেন। আমি তোমার ছেলে বলে তাদের কাছে গর্বভরা বুকে পরিচয় দেব!
(Email: [email protected])