দুর্নীতির কারণে জিডিপিতে নেই বছরে ১৮ হাজার কোটি টাকা

ইকবাল মাহমুদ
ইকবাল মাহমুদ

দুর্নীতির কারণে প্রতিবছর কমপক্ষে ১৮ হাজার কোটি টাকা মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) যোগ হতে পারছে না। এই হিসাব অবশ্য রক্ষণশীলভাবে করা। জিডিপির চলতি মূল্যকে ভিত্তি ধরে হিসাব করলে বছরে অঙ্কটা দাঁড়াবে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলমের কাছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের পাঠানো এক আধা সরকারি পত্র বিশ্লেষণে বিষয়টি উঠে এসেছে।

চিঠি পাওয়ার পর দুর্নীতি রোধে তদারকব্যবস্থা জোরদার করতে গত ২৮ ডিসেম্বর দেশের সব সচিবের উদ্দেশে চিঠি পাঠিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ গত মঙ্গলবার সচিবদের আবারও মনে করিয়ে দিয়েছে বিষয়টি।

দুদক চেয়ারম্যানের চিঠিতে বলা হয়, ‘এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য যে জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতির অন্যতম প্রধান অন্তরায় হচ্ছে দুর্নীতি। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, দুর্নীতি রোধ করা গেলে প্রতিবছর দেশের জিডিপি ২ শতাংশ বাড়বে।’

গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে জিডিপি ছিল চলতি মূল্যে ১৭ লাখ ৩২ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা এবং স্থিরমূল্যে ৮ লাখ ৮৩ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকা। চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জিডিপি ধরা হয়েছে ১৯ লাখ ৬১ হাজার ১৭ কোটি টাকা। চলতি মূল্যে ২ শতাংশ হিসাবে দাঁড়াবে ৩৯ হাজার ২২০ কোটি টাকা।

জিডিপির পরিমাণ প্রতিবছরই বাড়ছে। পাঁচ বছরের জন্য রক্ষণশীল হিসাব করলে দুর্নীতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৮০ হাজার কোটি টাকা।

সরকারি কেনাকেটা, জনবল নিয়োগ, প্রকল্প গ্রহণ ও প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দুর্নীত প্রতিরোধে কার্যকর তদারকব্যবস্থা গ্রহণের কথা উল্লেখ করা হয় দুদক চেয়ারম্যানের পাঠানো চিঠিতে। এতে তিনি বলেছেন, দুর্নীতি কমাতে মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থাগুলো উদ্যোগ দিলে দুদক সহযোগিতা করতে একান্তভাবে আগ্রহী।

পত্রে সরকারি দপ্তরে দুর্নীতির ‘ধূসর ক্ষেত্র’ চিহ্নিত করার পরামর্শ দিয়ে ইকবাল মাহমুদ বলেন, দুর্নীতি রোধ করা গেলে বৈদেশিক বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান গতিশীল হবে, দারিদ্র্য ও বৈষম্য কমবে।

দুদক চেয়ারম্যানের পত্রের সূত্র উল্লেখ করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম অন্য সচিবদের উদ্দেশে আলাদা পত্র দিয়েছেন। এতে তিনি বলেছেন, ‘আপনি অবগত আছেন যে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সরকারি কেনাকাটা, জনবল নিয়োগ, প্রকল্প গ্রহণ ও প্রকল্প বাস্তবায়নের কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুর্নীতির প্রকোপ থাকতে পারে। এসব ক্ষেত্রে দুর্নীতি প্রতিরোধে কার্যকর তদারকব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।’

২০১৫ সালের জুলাইয়ে ঋণদাতা গোষ্ঠীর স্থানীয় পরামর্শক দলের (এলসিজি) সঙ্গে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক সভায় দুর্নীতির কারণে জিডিপির ২ থেকে ৩ শতাংশ নষ্ট হয় বলে জানিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। একই পরিমাণের কথা বলেছিলেন তিনি সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার খসড়া উপস্থাপনের সময়ও।

তবে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণা তথ্যমতে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুলিশ, বিচার—এসব সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে যে অর্থের দুর্নীতি হয়, তার পরিমাণ জিডিপির ২ দশমিক ৫ শতাংশের মতো হবে। আর সরকারি বড় বড় কেনাকাটায় যোগসাজশের মাধ্যমে যে দুর্নীতি হয়, তার পরিমাণ হবে জিডিপির ৩ শতাংশের মতো। অর্থাৎ সব মিলিয়ে দুর্নীতির আকার দাঁড়াবে জিডিপির ৫ শতাংশ।

দুর্নীতি প্রতিরোধে দুদক ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের চিঠিকে ইতিবাচকভাবেই দেখছে টিআইবি। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুর্নীতির পরিমাণ জিডিপির ২ শতাংশেরও বেশি। তবে পরিমাণ যা-ই হোক না কেন, দুর্নীতি প্রতিরোধে দুদক ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উদ্যোগকে স্বাগত জানাই।’

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘সাম্প্রতিক উদ্যোগে নিশ্চয়ই দুর্নীতি প্রতিরোধে তদারকব্যবস্থা জোরদার হবে। তবে উচিত হবে এর সময়ভিত্তিক মূল্যায়নের। অর্থাৎ বছরওয়ারি দুর্নীতি কত কম হলো, তা যাচাই করতে হবে। এটা কি কমল, না আরও বাড়ল, তা পরীক্ষার একটা ব্যবস্থা রাখতে হবে।’