যন্ত্র কেনায় স্থবিরতা, ব্যবসায়ীদের ভোগান্তি

প্রায় ছয় মাস আগে নিয়ম ভেঙে নিউমুরিং টার্মিনালে কনটেইনার ওঠানো-নামানোর ১৫টি যন্ত্র কেনার প্রক্রিয়া শুরু করেছিল বন্দর কর্তৃপক্ষ। প্রথম ধাপে দুটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিদেশ থেকে ‘সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে’ যন্ত্র কেনার এই প্রক্রিয়া ভেস্তে যায়। গণখাতে ক্রয়বিধি অনুযায়ী সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে এসব যন্ত্র কেনার সুযোগ না থাকলেও এখন নতুন করে আবারও এ পদ্ধতিতে যন্ত্র কেনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে বন্দর।
নিয়ম ভেঙে যন্ত্র কেনায় এমন তৎপরতা থাকলেও নিয়ম মেনে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রে যন্ত্র কেনায় চলছে স্থবিরতা। দুই দফা সময় বাড়িয়ে ছয়টি যন্ত্র কেনার দরপত্র জমা নেওয়া হয়েছে। দরপত্র জমা নেওয়ার পর মূল্যায়ন কার্যক্রমেও স্থবিরতার অভিযোগ ব্যবসায়ীদের।
নিউমুরিং টার্মিনালের ১ হাজার ২২৯ কোটি টাকা প্রকল্পের ৫১টি যন্ত্র ক্রয়ের একটি খণ্ডচিত্র এটি। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে প্রক্রিয়া শুরুর পর এখন পর্যন্ত একটি যন্ত্রও বন্দরের বহরে যুক্ত হয়নি। ফলে এসব যন্ত্র বন্দরের বহরে কখন যুক্ত হবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
নয় বছর আগে একসঙ্গে পাঁচটি জাহাজ ভেড়ানোর সুবিধা নিয়ে এই টার্মিনালের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছিল। টার্মিনাল নির্মিত হলেও যন্ত্রপাতি সংগ্রহ না হওয়ায় প্রথম ধাপে সনাতন পদ্ধতিতে দুটি এবং পরে আরও দুটি জেটি চালু করা হয়। কিন্তু পর্যাপ্ত যন্ত্র না থাকায় জাহাজ থেকে কনটেইনার নামাতে যেমন সময় লাগছে তেমনি কনটেইনার খালাস নিতেও ব্যবসায়ীদের ভোগান্তি বাড়ছে। বন্দরের এ টার্মিনাল থেকে কনটেইনার খালাসে এখন সবচেয়ে বেশি সময় লাগছে।
বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের সহসভাপতি ও বন্দর ব্যবহারকারী ফোরামের সভাপতি মাহবুবুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, স্বচ্ছতার ভিত্তিতে যত দ্রুত সম্ভব এসব যন্ত্র কেনা উচিত। কারণ, প্রয়োজনীয় যন্ত্র না থাকায় বন্দর দিয়ে কনটেইনার পরিবহনে ব্যবসার খরচ বাড়ছে। পণ্য হাতে পেতে দেরি হচ্ছে।
বন্দরের নথিপত্র অনুযায়ী, ৫১টি যন্ত্রের মধ্যে ১৫টি যন্ত্র সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে এবং ৩৬টি যন্ত্র প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রে কেনার সিদ্ধান্ত নেয় বন্দর। এ জন্য সরকারি অনুমোদনও পায় সংস্থাটি। গণখাতে ক্রয়বিধির ৭৬ (ছ) ধারার বিশেষ ক্ষেত্রে সরকারি মালিকানাধীন শিল্প ও কারখানা থেকে সরকারের নিজস্ব অর্থে পণ্য ও সংশ্লিষ্ট সেবা ক্রয়ের ধারা ব্যবহার করে এই কেনার প্রক্রিয়া শুরু করে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
এই ধারা অনুযায়ী বন্দর কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রাম ড্রাই ডক লিমিটেড ও নারায়ণগঞ্জ ডকইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস লিমিটেড থেকে প্রথম ধাপে ১৫টি যন্ত্রের মধ্যে মোট নয়টি যন্ত্র কেনার প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত করে। তবে গত ২৪ নভেম্বর প্রকাশিত এক প্রজ্ঞাপনে সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে কোন ধরনের পণ্য ও সেবা ক্রয় করা যাবে, তা সুস্পষ্ট না করার কারণে এই প্রক্রিয়া আইনগত প্রশ্নের মুখে পড়ে। ছয় মাস পর এসব যন্ত্র বিদেশ থেকে আমদানির জন্য ঋণপত্র কোন প্রতিষ্ঠানের নামে খোলা হবে, তা নিয়ে বন্দরের সঙ্গে ওই দুটি প্রতিষ্ঠানের সমঝোতা হয়নি। ফলে এই উদ্যোগ তখন ভেস্তে গেলেও নতুন করে আবারও একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একই পদ্ধতিতে যন্ত্র কেনার প্রক্রিয়া শুরু করে বন্দর।
একই রকমের আরও ছয়টি যন্ত্র প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রে কেনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল গত ২৫ জুলাই। দুই দফায় দেড় মাস সময় বাড়িয়ে
গত ১০ নভেম্বর দরপত্র জমা নেওয়া হয়। এরপর এখন পর্যন্ত মূল্যায়নই শেষ হয়নি।
বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম খালেদ ইকবাল প্রথম আলোকে বলেন, গত ২৪ নভেম্বরের প্রজ্ঞাপনের বিষয়টি জানা নেই। সরকারি অনুমোদন পাওয়ার পরই গণখাতে ক্রয়বিধির নিয়ম মেনে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে (ডিপিএম) যন্ত্র কেনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। প্রথম দফায় না হলেও এই পদ্ধতিতে এখন অন্য সরকারি সংস্থার মাধ্যমে কেনার প্রক্রিয়া চলছে। ছয় মাসের প্রক্রিয়া ভেস্তে যাওয়ায় এসব যন্ত্র সংগ্রহে বন্দর ছয় মাস পিছিয়ে গেল কি না, জানতে চাইলে তিনি মন্তব্য করেননি। তবে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রে অপর ছয়টি যন্ত্র কেনার দরপত্র এখনো মূল্যায়ন পর্যায়ে রয়েছে বলে তিনি জানান।
বন্দর সূত্রে জানা যায়, নিউমুরিং টার্মিনালে ১০টি গ্যান্ট্রি ক্রেন (জাহাজ থেকে কনটেইনার ওঠানো-নামানোর যন্ত্র) দরকার হলেও এখন একটিও নেই। ফলে জাহাজের ক্রেন ব্যবহার করে ধীরগতিতে কনটেইনার ওঠানো-নামানো হচ্ছে। জাহাজ থেকে নামানোর পর কনটেইনারবাহী গাড়িতে করে এসব কনটেইনার টার্মিনালের চত্বরে নিয়ে রাখা হয়। এরপর সেখান থেকে ‘রাবার টায়ার্ড গ্যান্ট্রি ক্রেন-আরটিজি’ যন্ত্র দিয়ে বন্দর চত্বরে বিভিন্ন স্তরে সাজিয়ে রাখা ও খালাসের জন্য বিভিন্ন স্তর থেকে নামিয়ে রাখা হয়। টার্মিনালটিতে এখন এ ধরনের যন্ত্র ন্যূনতম ২০টি দরকার হলেও রয়েছে কমবেশি ১৩টি। একইভাবে স্ট্র্যাডল ক্যারিয়ারসহ কনটেইনার পরিবহনের যন্ত্রপাতি চাহিদার অর্ধেকসংখ্যক দিয়ে টার্মিনালটি চালানো হচ্ছে।
বন্দরের সাবেক পর্ষদ সদস্য হাদী হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, টার্মিনালের যন্ত্রপাতি কেনার পদ্ধতিতে স্বচ্ছতা না থাকায় বারবার জটিলতা তৈরি হচ্ছে। বারবার সময়ক্ষেপণের কারণে যন্ত্র সংগ্রহ না হওয়ায় ব্যবসায়ীরা সামনে আরও ভোগান্তিতে পড়বেন বলে মনে করেন এই সাবেক কর্মকর্তা। গণখাতে ক্রয়বিধি অনুযায়ী, এসব যন্ত্র সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে কেনার নিয়ম নেই।