বাংলাদেশের পোশাক খাতে ব্রেক্সিটের নেতিবাচক প্রভাব

২৮ দেশের জোট ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ত্যাগের যে সিদ্ধান্ত যুক্তরাজ্য নিয়েছে, তার বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের পোশাক খাতে। ব্রেক্সিট নামে পরিচিত এই বিচ্ছেদের ঘোষণায় যুক্তরাজ্যের মুদ্রা পাউন্ডের ব্যাপক দরপতন ঘটে। যার ফলে আমদানি খরচ কমাতে যুক্তরাজ্যের ফ্যাশন প্রতিষ্ঠানগুলো আরও কম দামে পণ্য তৈরির জন্য বাংলাদেশের সরবরাহকারীদের চাপ দিচ্ছে। ফলে চাহিদামতো দাম কমিয়ে বাজার ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা।

গতকাল বৃহস্পতিবার অর্থনীতিবিষয়ক প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের পোশাক খাতের ওপর ব্রেক্সিটের এ প্রভাব তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত ডলারে মূল্য নির্ধারণ করে। কিন্তু গত বছর যুক্তরাজ্যের মানুষ ব্রেক্সিটের পক্ষে রায় দেওয়ার পর থেকে ডলারের বিপরীতে পাউন্ডের দরপতন হয়েছে প্রায় ১৬ শতাংশ, যা যুক্তরাজ্যের আমদানি ব্যয়কে বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু যুক্তরাজ্যের ফ্যাশন প্রতিষ্ঠানগুলো পণ্যের দাম বাড়াতে রাজি নয়। এর বিপরীতে তারা সরবরাহকারীদের আরও কম দামে পণ্য বানিয়ে দিতে চাপ দিচ্ছে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ আসে পোশাক খাত থেকে। আর বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের তৃতীয় বৃহত্তম গন্তব্য যুক্তরাজ্য।

তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, বেক্সিটের প্রভাবে যুক্তরাজ্যের বাজারে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি কমতে শুরু করেছে। চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস অর্থাৎ জুলাই-ডিসেম্বরে ১৬১ কোটি ৬৮ লাখ ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়। এই আয় তার আগের ২০১৫-১৬ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের চেয়ে ৫ দশমিক ১৯ শতাংশ কম। গত অর্থবছরে যুক্তরাজ্যে ৩৫২ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছিল বাংলাদেশ।

ব্রিটিশ ব্র্যান্ড প্রাইমার্ক ও নেক্সটের জন্য পণ্য সরবরাহ করে বাংলাদেশের প্লামি ফ্যাশনস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল হক ব্লুমবার্গকে বলেন, যুক্তরাজ্যের ক্রেতারা দাম কমাতে অনেক চাপ দিচ্ছে। ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিনিয়ত যে বার্তা পাঠাচ্ছে তা হলো, সামনে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।

এনভয় গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, পাউন্ডের দরপতনে ব্যবসার খরচ বাড়ায় ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের দিকে ঝুঁকছে। তবে সেটা আরও কম দামে পণ্য বানিয়ে নিতে। এটাই তাদের কৌশল।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রাইমার্কের একজন মুখপাত্র ব্লুমবার্গকে বলেছেন, বাংলাদেশের পোশাক সরবরাহকারীদের সঙ্গে প্রাইমার্কের দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক আছে। প্রাইমার্ক বিশ্বাস করে সরবরাহকারীরা লাভের একটি অংশ নিতে পারছেন।

জানতে চাইলে বিজিএমইএর সহসভাপতি মাহমুদ হাসান খান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘কমবেশি সব দেশের ক্রেতারাই পোশাকের দাম কমাতে চাপ দিচ্ছে। তবে যুক্তরাজ্যের চাপটা একটু বেশি। ব্রেক্সিটের কারণে তাদের পাউন্ড দুর্বল হওয়ার কারণেই তারা পোশাকের দাম কমিয়ে বিষয়টি সমন্বয় করতে চাচ্ছে। পোশাকের দাম নিয়ে কথা বলতে গেলেই ক্রেতারা সক্ষমতা বাড়াতে বলে। সে বিষয়ে আমরা চেষ্টা করছি। তবে সবকিছুরই তো একটা সীমা-পরিসীমা আছে।’

বর্তমান পরিস্থিতি সামলাতে মাহমুদ হাসান খান বলেন, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করতে ব্যবসায়ীরা কাজ করছেন। সরকারকে নগদ সহায়তা দেওয়ার বিষয়ে এগিয়ে আসা উচিত। এ ছাড়া ক্রয়াদেশ পেতে ক্রেতাদের সঙ্গে পোশাকের দাম নিয়ে ব্যবসায়ীরা যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা করেন, সেটিও বন্ধ করতে হবে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্রেক্সিটের পর যুক্তরাজ্য কেমন বাণিজ্য শুল্ক নির্ধারণ করে, তা নিয়েও উদ্বেগের কারণ আছে বাংলাদেশের। সিঙ্গাপুরভিত্তিক অক্সফোর্ড ইকোনমিকসের অর্থনীতিবিদ ভার্তি ভার্গাভা ব্লুমবার্গকে বলেন, ব্রেক্সিট যে অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে সেটা বড়ই উদ্বেগের কারণ। এমনও হতে পারে যে নতুন চুক্তি সম্পাদনের আগে যুক্তরাজ্য সাময়িক সময়ের জন্য বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা বন্ধ করে দিল।

তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রভাব বাংলাদেশের রপ্তানির জন্য ইতিবাচক হতে পারে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। সিটি গ্রুপের মুদ্রাবিষয়ক পরিকল্পক স্টিভেন ইংল্যান্ডার ব্লুমবার্গকে বলেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চীনের ওপর উচ্চহারে শুল্ক আরোপের যে ঘোষণা দিয়েছেন, তা বাস্তবায়িত হলে উৎপাদনের কাজগুলো বাংলাদেশসহ সস্তা শ্রমের দেশে যেতে বাধ্য হবে।